ছোট্ট শিশুকে কোলে নিয়ে জীর্ণশীর্ণ শরীরের এক নারী মানুষের ভীড় ঠেলে হাঁটছেন। ক্যামেরার ফুটেজে ঠা ঠা রোদ স্পষ্ট। নারীর চোখে-মুখে রাজ্যের ক্লান্তি এসে ভর করেছে। কিন্তু থামছে না সস্তা স্যান্ডেল পরা পা জোড়া। মুখের সে ক্লান্তিকে ছাপিয়ে ভর করেছে ভয়— এটা করোনায় মারা যাওয়ার ভয় নয়, চাকরি হারানোর ভয়।
পৃথিবীটা ডুবে যাচ্ছে এক পৃথিবী সমান দুঃখ নিয়ে বেঁচে থাকা এমন সব মানুষগুলোর ভারে। আর আমি আমরা আজও নিশ্বাস নিতে পেরে স্বস্তিতে! ভাবছিলাম, কী দিলো এই লকডাউন আমাদের? এত এত মানুষের ঢল ছাড়া আর কিছু? ঢল নয়— পড়ুন, গার্মেন্টস খোলা থাকায় অনুপস্থিতির কারণে বেতন কাটা যাওয়া কিংবা চাকরি হারিয়ে একমাত্র উপার্জনের পথ বন্ধ হওয়ার ভয়ে হাজারো শ্রমজীবীর এই মরণযাত্রা!
রোববার (৫ এপ্রিল) চট্টগ্রামের প্রায় পাঁচ শতাধিক পোশাক কারখানা খুলবে আর হাজির না হলে নাম যাবে কাটা— এমন অশনিসংকেত পেয়ে তাই হাজার হাজার মানুষ মাইলের পর মাইল হেঁটে, ট্রাকে গাদাগাদি করে কোনমতে দাঁড়িয়ে যাত্রাপথে শত বিড়ম্বনার সম্মুখীন হয়েও ফিরেছেন সেই শহরে— যেখানে করোনা ছড়ানো আটকাতে বন্ধ রাখা হয়েছে গণপরিবহন। কিন্তু এ যাত্রা আরও কয়জনকে সংক্রমিত করলো, সে হিসাব করবার সাধ্য আমাদের আছে কি? এ মরণযাত্রায় তাদের বাধ্য করছেন কারা? এই মানুষগুলোকে রাস্তায় নামিয়ে দিয়ে আমরা কি নিজেদেরকেই ঠেলে দিলাম না চরম ঝুঁকিতে?
সব প্রতিষ্ঠান লকডাউনের আওতায় থাকলেও পোশাক কারখানায় কাজ করা এই মানুষগুলো থাকবে লকডাউনের বাইরে!
এমন বিপদগলির বাসিন্দা তারা, যেখানে ভীষণ দ্রুতবেগে মৃত্যু আসছে বলে চিৎকার করলেও সেদিকে তাকাবার ফুরসত নেই তাদের। কী করবে বলুন? খুব ফাজলামো হচ্ছে তো আজকাল!
এবার সমাজের সেই শ্রেণীর কথা বলতে চাই যারা সম্ভবত জীবন বাঁচাতে দেওয়া লকডাউনের ভিন্ন মানে বের করেছেন!
পাশের বাসার কিংবা নিজের বাসার বয়স্ক কি চ্যাঙড়া ছেলেমেয়ে, যাদের অনেকেরই বাসায় মন টেকে না— তাই চুরি করে গলিতে চিপায় গিয়ে আড্ডা দেয়, মজা নেয়, নানা পদের খাবারের ছবি দিয়ে ফ্রাস্টেশন জাহির করে ফেসবুকে! যেন দেশে কোন মহামারীর ভয়ে লকডাউন নয়, ফ্রেন্ডস লিভ চলে! এত এত সম্ভারের মাঝে অভাব বুঝতে না পারাদের কাছে এই মরণযাত্রা তাই কোন মানে রাখে না।
তারাই পরে একসময় এমন সব কারখানা বা প্রতিষ্ঠানের মালিক বনে গিয়ে ‘সর্বহারা’দের রক্ত চুষবে, অথবা সেসব প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার হয়ে তাদের বাধ্য করবে আবারও কোন মরণযাত্রায় হাঁটতে! পরে আবার এসব মৃত্যুর দায় এড়াতে দেওয়া লম্বা ভাষণে বলবে, সব হাপিত্যেশ ‘না থাকাদের’! নেই তো তাই যাদের আছে তাদেরকে হিংসে হয়! কিন্তু সেদিন অমানুষগুলোর কাণ্ডকীর্তি দেখে হিংসে করতেও লজ্জা পাবে মানুষ।
পুরো পৃথিবীতে মানুষ মরছে। দেশে একের পর এক আক্রান্ত হচ্ছে। আমার দেশে হাজারও মানুষ খাদ্যের অনিশ্চয়তায় দিনযাপন করছে। জনসংখ্যার অধিক ঘনত্বের কারণে বাংলাদেশে প্রায় পাঁচ থেকে বিশ লাখ মানুষ মারা যেতে পারে বলে ধারণা করছে জাতিসংঘ। তাহলে আক্রান্ত করতে পারে কয়জনকে ভাবুন! কতটা ভয়াবহ!
আমাদের দেশের ভঙ্গুর স্বাস্থ্য ব্যবস্থার কারণেই এত প্রাণ যাবে বলে মনে করছে সংস্থাটি। ১৬০ মিলিয়ন লোকের দেশে এ পর্যন্ত মাত্র ২ হাজার ৫৪৭ জনের টেস্ট করেছে বাংলাদেশ। যেখানে আক্রান্ত ৭০ এবং মৃতের সংখ্যা ৮, অর্থাৎ প্রায় প্রতি ৯ জনে একজনের মৃত্যু। এত মানুষের টেস্ট করবার পর্যাপ্ত কিট নেই বাংলাদেশের। স্বাস্থ্যকর্মীদের অপর্যাপ্ত সুরক্ষা এবং ভেন্টিলেটরসহ উন্নত চিকিৎসা সরঞ্জামাদির অপ্রতুলতা তো রয়েছেই। তাই ছড়িয়ে পড়লে ভয়াবহতা কত বেশি হবে আঁচ করা যায়। বোঝা যায়, এ দেশে সামান্য অবহেলায় ইঁদুর বিড়ালের মত প্রাণ যাবে মানুষের।
প্রশ্ন হল, এত কিছু বুঝেও আমরা এসব হতে দিচ্ছি কী করে! নগর পুড়লে যে দেবালয় এড়ায় না— এতটুকুন বোধশক্তি কি আমাদের হবে না? নাকি আজও ‘আমি ভাল আছি’ চিন্তায় মশগুল আমরা! সরকারি কিংবা বেসরকারি যে প্রতিষ্ঠান ই হোক, যদি এমন ভয়াবহ পরিস্থিতিতে প্রতিষ্ঠান খোলা থাকে তবে তাদের নিরাপত্তা তো সে প্রতিষ্ঠানকেই নিশ্চিত করতে হবে।
আর যাতায়াত প্রসঙ্গে কাকে দোষ দেবো? সব গণপরিবহন বন্ধ করে যখন সেবামূলক প্রতিষ্ঠান খোলা রাখা হচ্ছে, তখন সেবাদানকারীরা কি ব্যাটম্যানের মত পাখা লাগিয়ে যাবে আশা করা হয়?
কোয়ার্টার বা ট্রান্সপোর্টেশন নিয়ে কোন মহাপরিকল্পনা কি আছে আদৌ? তাহলে ডাক্তার, নার্স, ব্যাংকার, বিদ্যুৎ-গ্যাস- পানি খাতে কিংবা অন্য সব সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের আজও গণপরিবহন বন্ধ হলেই ট্রান্সপোর্টেশন নিয়ে হাহাকার কেন করতে হচ্ছে? অন্তত এখন প্রতিষ্ঠানগুলো ট্রান্সপোর্টেশন সেবাটা নিশ্চিত করুন। নয়তো এমন অরক্ষিতভাবে সেবা দিতে দিতে সেবাদানকারীরাই একটা একটা করে গায়েব হয়ে যাবে।
আজ এত এত সীমাবদ্ধতার মাঝেও কাজ করছে কিছু মানুষ। নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও এগিয়ে আসছে স্বেচ্ছাসেবীরা। সেবা দিচ্ছে চিকিৎসক। এদের কাঁধে ভর দিয়ে আমরা স্বপ্ন দেখি সুন্দর একটি দেশের যেখানে মহামারী কাটিয়ে মানুষ সুন্দর জীবনে ফিরবে, যেভাবে প্রকৃতি ফিরছে নিজ রূপে।
চট্টগ্রাম