বিকেলে প্রায় তিন লক্ষ কোটি টাকার বাজেট পেশ : রেকর্ড গড়তে যাচ্ছেন অর্থমন্ত্রী মুহিত

রাজীব সেন প্রিন্স, বিশেষ রিপোর্ট :

 

দেশের ইতিহাসে টানা ৭ বার বাজেট পেশ করে গতবছর রেকর্ড করেছিলেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। নিজেই সেই রেকর্ডকে টপকে নতুন রেকর্ড গড়তে যাচ্ছেন তিনি। টানা ৮ বছর জাতীয় বাজেট ঘোষণা করতে যাচ্ছেন মুহিত।

 

এর আগে বাংলাদেশের কোন অর্থমন্ত্রী টানা ছয়টির বেশি বাজেট দেননি। এর আগে টানা ৬ বার বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে বাজেট পেশের রেকর্ড গড়েছিলেন সাবেক অর্থমন্ত্রী এস.এ.এম.এস. কিবরিয়া। ১৯৯৬-৯৭ অর্থবছর থেকে ২০০১-০২ অর্থবছর পর্যন্ত টানা ৬টি বাজেট পেশ করেছিলেন তিনি। তবে সবচেয়ে বেশি বাজেট দেয়ার রেকর্ড গড়েন আরেক প্রয়াত অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমানের। তিনি মোট ১২টি বাজেট দিয়েছেন।

 

২০০৯-১০ অর্থবছর থেকে ২০১৬-১৭ অর্থবছর পর্যন্ত ৮টি 20150604012655বাজেট এবং তার আগে ১৯৮২-৮৩ ও ১৯৮৩-৮৪ অর্থবছরের বাজেট পেশ করেছিলেন মুহিত। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের টানা দ্বিতীয় মেয়াদের তৃতীয় বাজেট আজ বৃহস্পতিবার বিকেল ৩টায় জাতীয় সংসদে আনুষ্ঠানিকভাবে বাজেট উপস্থাপন করবেন অর্থমন্ত্রী। ২০১৫-১৬ অর্থ বছরের নতুন বাজেট হতে যাচ্ছে স্বাধীন দেশের ৪৪তম বাজেট।

 

এবছর তিনি দিতে যাচ্ছেন এবারও ডিজিটাল পদ্ধতিতে অর্থাৎ পাওয়ার পয়েন্টের মাধ্যমে বাজেট উপস্থাপন করা হবে। ঐ দিন বাজেট বক্তৃতা, সম্পূরক আর্থিক বিবৃতি, প্রজাতন্ত্রের সরকারি হিসাব, সংযুক্ত তহবিল-প্রাপ্তি, মঞ্জুরি ও বরাদ্দের দাবিসমূহ (অনুন্নয়ন ও উন্নয়ন), বিস্তারিত বাজেট (উন্নয়ন), নারী উন্নয়ন ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় চল্লিশটি মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম, শিশুদের নিয়ে বাজেট ভাবনা, মধ্যমেয়াদি সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি বিবৃতি, মধ্যমেয়াদি বাজেট কাঠামো, বার্ষিক আর্থিক বিবৃতি, বাজেটের সংক্ষিপ্তসার, দক্ষতা উন্নয়ন- উচ্চতর প্রবৃদ্ধি অর্জনের অগ্রাধিকার, কাঠামো রূপান্তরে বৃহৎ প্রকল্প, প্রবৃদ্ধি সঞ্চারে নতুন মাত্রা, বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা-২০১৬ এবং ডিজিটাল বাংলাদেশের পথে অগ্রযাত্রা: হালচিত্র ২০১৬ ওয়েবসাইটে প্রকাশসহ জাতীয় সংসদ থেকে সরবরাহ করা হবে। একই সঙ্গে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ প্রণীত ব্যাংক, বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহের কার্যাবলী ২০১৫-১৬ জাতীয় সংসদে পেশ করা হবে।

ওয়েবে বাজেট চিত্র :

বাজেটকে আরো অংশগ্রহণমূলক করার লক্ষ্যে অর্থ বিভাগের ওয়েবসাইট www.mof.gov.bd -এ বাজেটের সকল তথ্যাদি ও গুরুত্বপূর্ণ দলিল যে কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান পাঠ ও ডাউনলোড করতে পারবে এবং দেশ বা বিদেশ থেকে উক্ত ওয়েবসাইটের মাধ্যমে ফিডব্যাক ফরম পূরণ করে বাজেট সম্পর্কে মতামত ও সুপারিশ প্রেরণ করা যাবে।

প্রাপ্ত সকল মতামত ও সুপারিশ বিবেচনা করা হবে। জাতীয় সংসদ কর্তৃক বাজেট অনুমোদনের সময়ে ও পরে তা কার্যকর করা হবে।

ব্যাপকভিত্তিক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সরকারি ওয়েবসাইট লিংক www.bangladesh. gov.bd, www.nbr-bd.org, www.plancomm.gov.bd,www.imed.gov.bd, www. bdpressinform.org, www.pmo.gov.bd এবং বেসরকারি ওয়েবসাইট লিংক www. bdnews24.com  ঠিকানায় বাজেট সংক্রান্ত তথ্য পাওয়া যাবে।

পূর্বের বাজেটের ইতিহাস যা বলে :

নথিপত্র ঘেটে জানা যায়, সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের শাসন আমলে ১৯৮২-’৮৩ ও ১৯৮৩-৮৪ এই দুই অর্থ বছরের বাজেট দেন আবুল মাল আব্দুল মুহিত। প্রথম বাজেটের আmuhith-speech-01কার ছিলো ৪ হাজার ৭৩৮ কোটি টাকা, দ্বিতীয় বাজেট ছিলো ৫ হাজার ৮৯৬ কোটি টাকা।

এরপর দল পরিবর্তন করে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে ২০০৮ সালে গঠিত মহাজোট সরকারের আমলে অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পান আবুল মাল আব্দুল মুহিত। দায়িত্ব নিয়ে ২০০৯-১০ অর্থবছরে তৃতীয় বারেরমতো বাজেট পেশ করেন তিনি। সে বাজেটের আকার ছিলো ১১৩,৮১৫ কোটি টাকা, চতুর্থ বাজেট ২০১০-১১ আকার ১৩২,১৭০ কোটি টাকা, পঞ্চম বাজেট ২০১১-১২ অর্থ বছরের বাজেট আকার ছিলো ১৬৫,০০০ কোটি টাকা, ৬ষ্ঠ বাজেট দেন ২০১২-১৩ অর্থ বছরে যার আকার ছিলো ১৯১,৭৩৮ কোটি টাকা, ৭ম বাজেট ২০১৩-১৪ আবুল মাল আবদুল মুহিত ২ লাখ ২২ হাজার ৪৯১ কোটি টাকা। সর্বশেষ (২০১৪-১৫) অর্থবছরের ৮ম বাজেটের আকার ছিলো ২ লাখ ৫০ হাজার ৫০৬ কোটি টাকা। বৃহস্পতিবার (০৪ জুন) সংসদে আবুল মাল আবদুল মুহিত (২০১৫-১৬) অর্থ বছরের বাজেট পেশ করবেন। এই বাজেটের আকার নির্ধারণ করা হয়েছে ২ লাখ ৯৭ হাজার ১০০ কোটি টাকা। যা কমতে বা বাড়তে পারে।

উল্লেখ্য, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে বাজেট দিয়েছিলেন প্রয়াত তাজউদ্দীন আহমদ। ঐ বাজেটের আকার ছিল ৭৮৬ কোটি টাকা। পরের দুটি বাজেটও দিয়েছিলেন বাংলাদেশের প্রথম অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন।

 

অর্থমন্ত্রী মুহিতের জীবনী :

প্রসঙ্গত, ১৯৩৪ সালে সিলেটের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন আবুল মাল আবদুল মুহিত। তিনি একজন অর্থনীতিবিদ, কূটনীতিক, ভাষাসৈনি5e83aef9f4ca7048e9bc8d9c6a6210deক ও মুক্তিযোদ্ধা।

পাকিস্তান আন্দোলনের অন্যতম বিশিষ্ট নেতা ছিলেন মুহিত। তৎকালীন সিলেট জেলা মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতা অ্যাডভোকেট আবু আহমদ আব্দুল হাফিজের তৃতীয় সন্তান তিনি। তার মা সৈয়দ শাহার বানু চৌধুরী বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডসহ রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন।

ছাত্রজীবনে অত্যন্ত উজ্জ্বল ও মেধাবী ছিলেন মুহিত। ১৯৫১ সালে সিলেট এমসি কলেজ থেকে তৎকালীন সারা প্রদেশে আইএ পরীক্ষায় প্রথম স্থান, ১৯৫৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে বিএ (অনার্স) পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম এবং ১৯৫৫ সালে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃতিত্বের সাথে এমএ পাস করেন তিনি। চাকরিরত অবস্থায় অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নসহ হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমপিএ ডিগ্রি লাভ করেন মুহিত।

১৯৫৬ সালে পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে (সিএসপি) যোগদানের পর জনাব মুহিত তৎকালীন পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার, পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক সরকার এবং পরবর্তীকালে বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেছিলেন আবুল মাল আবদুল মুহিত।

পাকিস্তান পরিকল্পনা কমিশনের চিফ ও উপসচিব থাকাকালে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যে বৈষম্য বিরাজমান ছিল তার ওপর ১৯৬৬ সালে একটি প্রতিবেদন প্রণয়ন করেছিলেন আবুল মাল আবদুল মুহিত। সংবিধানের বাধ্যবাধকতা পালনে পাকিস্তান ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে এটিই ছিল এবিষয়ে প্রথম প্রতিবেদন। ওয়াশিংটন দূতাবাসের তিনি প্রথম কূটনীতিবিদ, যিনি স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ১৯৭১ সালের জুন মাসে পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করেন।

স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের পরিকল্পনা সচিব এবং ১৯৭৭ সালে অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বহিঃসম্পদ বিভাগে সচিব পদে নিযুক্ত হন মুহিত। অর্থনৈতিক কূটনীতিতে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন তিনি। বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক ও জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থায় সুপরিচিত একজন ব্যক্তি তিনি।

১৯৮১ সালে চাকরি থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নিয়ে অর্থনীতি ও উন্নয়ন পরামর্শক হিসেবে ফোর্ড ফাউণ্ডেশন ও ইফাদে কাজ শুরু করেন মুহিত। ১৯৮২ সালের মার্চ থেকে ১৯৮৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশের অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। পরবর্তীকালে বিশ্বব্যাংক ও জাতিসংঘের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে পরামর্শক হিসেবে কাজ করেছিলেন। ১৯৮৪ ও ১৯৮৫ সালে প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে উড্রো উইলসন স্কুলে ভিজিটিং ফেলো ছিলেন।

লেখক হিসেবেও সমান পারদর্শী আবুল মাল আবদুল মুহিত। মুক্তিযুদ্ধ, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, ইতিহাস, জনপ্রশাসন এবং রাজনৈতিক সমস্যা বিষয়ক গ্রন্থসহ বিভিন্ন বিষয়ে তার ২৩টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের একজন পথিকৃৎ এই রাজনীতিবিদ। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন এবং এর পূর্বসুরি ‘পরশ’-এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন তিনি।

আবুল মাল আবদুল মুহিতের স্ত্রী সৈয়দ সাবিয়া মুহিত একজন ডিজাইনার। তাদের তিন সন্তানের মধ্যে প্রথম কন্যা বেগম সামিনা মুহিত একজন ব্যাংকার এবং মুদ্রানীতি ও আর্থিক খাতের বিশেষজ্ঞ হিসেবে নিউইয়র্কে, বড় ছেলে সাহেদ মুহিত স্থপতি ও তথ্যপ্রযুক্তিবিদ হিসেবে ঢাকায় কর্মরত রয়েছে। ছোট ছেলে সামির মুহিত টেক্সাসের হিউস্টনে শিক্ষকতা করছেন।

 

রিপোর্ট : রাজীব সেন প্রিন্স

এ এস / জি এম এম / আর এস পি ::

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!