বায়েজিদ-শেরশাহে হঠাৎ ‘সাম্রাজ্য’ হাতবদল, কুদ্দুছ-শফি ইন

রিপন খুনে এলাকাছাড়া মহিউদ্দিন-দিদার

চট্টগ্রামের শেরশাহ এলাকায় হকার্স লীগ নেতা রিপন খুন হওয়ার পর আত্মগোপনে চলে গেছেন মামলার এক নম্বর আসামি কথিত যুবলীগ নেতা আবু মোহাম্মদ মহিউদ্দিন ও দিদারুল আলম। তারা এলাকাছাড়া হওয়ায় সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে দীর্ঘদিন পর আত্মপ্রকাশ করেছেন আবদুল কুদ্দুছ ওরফে কানা কুদ্দুছ ও শফিকুল ইসলাম ওরফে শফি। শেরশাহ বাজারে রিপন হত্যার প্রতিবাদে মিছিল করে প্রথম শোডাউন করেন এই দুজন। যুবলীগ নেতা মেহেদী হাসান বাদল হত্যার পর থেকে শেরশাহ এলাকায় ফিরতে পারছিলেন না তারা।

জানা গেছে, রিপন খুনের পর মহিউদ্দিন-দিদার এলাকাছাড়া হয়ে যান। আর ঠিক এ সুযোগে শেরশাহ এলাকায় অবস্থান নেন কুদ্দুস ও শফি। শুধু ফেরাই নয়, এলাকায় ফিরেছেন— এ তথ্য জানান দিতে নাসিরাবাদ শিল্প এলাকা, শেরশাহ, বায়েজিদ ও অক্সিজেন এলাকার পাঁচ হাজার মানুষের জন্য মেজবানের আয়োজনও করেছেন শফি। হঠাৎ করে শফি তার মৃত মা-বাবার আত্মার শান্তি কামনা করে এই মেজবানের আয়োজন করছেন রোববার (৫ জানুয়ারি)। শেরশাহ ফকিরপাড়ায় শফির নিজ বাড়িতে এ মেজবানের আয়োজন করা হচ্ছে। এতে চট্টগ্রাম সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিনকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে বলে জানা গেছে।

এ প্রসঙ্গে একাধিক মামলার আসামি কথিত যুবলীগ নেতা শফিকুল ইসলাম শফি চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘যুবলীগের সম্মেলন উপলক্ষে দুবাই থেকে দেশে এসেছি। তিন বছর আগে বাবার জন্য মেজবান দিলেও তখন সবাইকে ভাল করে খাওয়াতে পারিনি। তাই এবার সুযোগ হওয়ায় পাঁচ হাজার মানুষের মেজবানের আয়োজন করা হয়েছে। মেজবানে আমার নেতা আ জ ম নাছির উদ্দিনকেও দাওয়াত দিয়েছি। তিনি আসবেন বলে কথা দিয়েছেন।’

শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমি কোন অপরাধের সঙ্গে জড়িত নই। সবই ষড়যন্ত্রের অংশ। মেজবান দিয়ে আবার বিদেশে চলে যাবো।’

চট্টগ্রামের অন্যতম অপরাধপ্রবণ এলাকা শেরশাহে চাঁদাবাজি, ঝুট ব্যবসা, সরকারি পাহাড় ও খাসজমি দখল-বেদখল, ফুটপাত নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্য বিস্তার নিয়ে গত ১০ বছরে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের অন্তত নয়জন নেতাকর্মী খুন হয়েছে। যুবলীগ নামধারী সন্ত্রাসী দেড় ডজন মামলার আসামি আবদুল কুদ্দুস ওরফে কানা কুদ্দুস, একাধিক মামলার আসামি শফিকুল ইসলাম ওরফে শফি এক গ্রুপের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। আর সাত মামলার আসামি আবু মোহাম্মদ মহিউদ্দিন ও একাধিক মামলার আসামি দিদারুল আলম অন্য গ্রুপের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। কুদ্দুস ও শফি যুবলীগ নেতা মেহেদী হাসান বাদল হত্যামামলার আসামি। আর সম্প্রতি খুন হওয়া আওয়ামী লীগ সমর্থক রিপন হত্যামামলার আসামি মহিউদ্দিন ও দিদার।

চট্টগ্রাম নগরীর বায়েজিদ বোস্তামী থানার ওসি প্রিটন সরকার বলেন, ‘শেরশাহ এলাকার ৯৯ ভাগ মানুষই ভালো। এই একভাগ সন্ত্রাসীর কারণে পুরো এলাকা কিছুদিন পর পর অশান্ত হয়ে ওঠে। কুদ্দুস, শফি, মহিউদ্দিন, দিদার যে অপরাধ করবে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।’

চট্টগ্রাম শহরের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা হলো শেরশাহ কলোনী এলাকা। পলিটেকনিক, বায়েজিদ, জালালাবাদ ও অক্সিজেন এলাকায় রয়েছে সবচেয়ে বেশি সরকারি খাসজমি ও পাহাড়ের পর পাহাড়। মেহেদী হাসান বাদল খুনের পর শেরশাহ ছাড়তে বাধ্য হন কুদ্দুছ ও শফি। এবার রিপন খুনের সুযোগে তারা এলাকায় ফিরে এসেছেন। রিপন খুনের পর শেরশাহ বাজারে কুদ্দুস ও শফির নেতৃত্বে দীর্ঘদিন পর মিছিল ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। বাজারের মিনার এলাকায় তার সমাবেশও করেন।

স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, এই মিছিল ও সমাবেশের মাধ্যমে তারা এলাকায় জানান দিয়েছেন তারা এলাকায় ফিরে এসেছেন। এই ফিরে আসা পাকাপোক্ত করার জন্য শফি তার মা-বাবার মেজবানের আড়ালে বিচ্ছিন্ন হওয়া অনুসারী ও অনুগত কর্মী-সমর্থকদের সংগঠিত করার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছেন। সেই সঙ্গে শিল্পকারখানার মালিকদের জানান দিচ্ছেন এখন শেরশাহ এলাকা তাদের দখলে চলে এসেছে। আধিপত্যের লড়াইয়ে ২০১৫ সালের ১ সেপ্টেম্বর রাতে যুবলীগ নেতা মেহেদী হাসানকে গুলি করে হত্যা করা হয়। তারপর মেহেদীর গ্রুপ নিস্তেজ হয়ে যায়। এতোদিন এলাকায় দাপিয়ে বেড়িয়েছিলেন মহিউদ্দিন ও দিদার গ্রুপ।

শেরশাহ বাংলাবাজার এলাকার এক ব্যবসায়ী নেতা জানান, বায়েজিদ ও বাংলাবাজার এলাকার অবৈধ প্রায় ৩০০ দোকান থেকে দৈনিক ২০০ টাকা হারে চাঁদা আদায় করে মহিউদ্দিন-দিদারের অনুসারীরা। এসব দোকান থেকে চাঁদা আদায়ের বিরোধী ছিলেন হকার্স লীগ নেতা রিপন ও কাউন্সিলরের অনুসারীদের কয়েকজন। এ নিয়ে বিরোধের মধ্যেই গত জুনে সিটি করপোরেশনের ভ্রাম্যমাণ আদালত এসব অবৈধ দোকান উচ্ছেদে অভিযান চালান। এখন এই চাঁদা চলে যাবে কুদ্দুছ গ্রুপের হাতে। কারণ মহিউদ্দিন-দিদার গ্রুপের সবাই আত্মগোপনে চলে গেছেন গ্রেফতার হওয়ার ভয়ে।

পলিটেকনিক্যাল আবাসিক এলাকার বাসিন্দা এক প্রকৌশলী জানান, তিনি তার জায়গায় পুরোনো বাড়ি ভেঙে নতুন বাড়ি তৈরির কাজ শুরু করেন। কিন্তু এই সন্ত্রাসীদের চাঁদাবাজির কারণে তিনি তার বাড়ি তৈরি করতে পারছেন না। একইভাবে বাংলাবাজার এলাকায় সরকারি পাহাড় ও আমিন জুট মিলের পেছনে সরকারি খাসজমি দখল করে অবৈধ বাণিজ্য করছে মহিউদ্দিন-দিদার ও শফি-কুদ্দুসের অনুসারীরা। সরকারি জমি দখল-বেদখল নিয়ে প্রায় সময়ই ঝামেলা হয় বলে জানায় বায়েজিদ থানা পুলিশ। এ ছাড়া নাসিরাবাদ শিল্প এলাকা ঝুট ব্যবসা ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদাবাজি নিয়েই সন্ত্রাসীরা সক্রিয়। তাদের ভয়ে শেরশাহ এলাকার শিল্পপতি, ব্যবসায়ী, বাসা-বাড়ির মালিক কেউ কথা বলতে পারেন না।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!