বায়েজিদ বোস্তামী দরগার আড়াই কোটি মেরে খেল কমিটি ও ডেভেলপার মিলে

আড়াই কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে বায়েজিদ বোস্তামী দরগাহের পরিচালনা কমিটি ও একটি ডেভেলপার প্রতিষ্ঠান মিলে। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে এমন তথ্য।

ওয়াকফ প্রশাসক কর্তৃপক্ষের নিয়ম না মেনে একটি ডেভেলপার কোম্পানির সঙ্গে বহুতল ভবন নির্মাণের চুক্তি করে বায়েজিদ বোস্তামী দরগাহের পরিচালনা কমিটি। সেখানে দুই পক্ষের মধ্যে চুক্তিমোতাবেক ভবনটির চারতলা নির্মাণাধীন থাকা অবস্থায় দোকান বরাদ্দ দিয়ে অগ্রিম সালামি হিসেবে বিভিন্ন লোকজনের কাছ থেকে আদায় করে প্রায় আড়াই কোটি টাকা। পরে অভিনব কৌশলে ওই টাকাটা আত্মসাৎ করে পরিচালনা কমিটি ও ডেভেলপার প্রতিষ্ঠানের লোকজন। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে এমন তথ্য।

শুধু তাই নয়, দরপত্র ছাড়াই বায়েজিদ বোস্তামী (রহ.) দরগা শরীফের পুরাতন আসবাবপত্র ও মালামাল বিক্রি করে সাড়ে ১০ লাখ টাকার আত্মসাৎ করা হয়েছে— এমন অভিযোগও এনেছে দুদক। অর্থ আত্মসাতের এই গুরুতর অভিযোগে দুদকের মামলায় ফেঁসে যাচ্ছেন জেএমজি হোল্ডিং এস্টেট এন্ড ডেভেলপার কোম্পানির পরিচালক, বায়েজিদ বোস্তামী দরগাহের সাধারণ সম্পাদকসহ মোট চারজন।

যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হচ্ছে, তারা হচ্ছেন জেএমজি হোল্ডিং এস্টেট এন্ড ডেভেলপার কোম্পানির পরিচালক লাল মিয়ার পুত্র রফিকুল ইসলাম, হযরত সুলতানুল আরেফিন বায়েজিদ বোস্তামী (রহ.) দরগা শরীফ পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট আনোয়ারুল ইসলাম চৌধুরী, জেএমজি হোল্ডিং এস্টেট এন্ড ডেভেলপার কোম্পানির পরিচালক আব্দুল মালেকের পুত্র ইয়াজ্জেম হোসেন রোমেন এবং অপর পরিচালক পারেছ মিয়ার পুত্র হারুনুর রশিদ।

দুদক সুত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ ওয়াকফ প্রশাসনের আওতায় হযরত সুলতান বায়েজিদ (রহ:) দরগা শরীফের কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। ২০০৭ সালের ৩১ মে কয়েকশ বছরের জরাজীর্ণ দরগা মসজিদ ভেঙ্গে নতুন করে সংস্কারের উদ্যোগ নেয় দরগা পরিচালনা কমিটি।

দরগা পরিচালনা কমিটির সর্বসম্মতক্রমে প্রস্তাবে বলা হয়েছিল, সংস্কারের কাজ শুরু হওয়ার পর অর্থ সংকটের কারণে এটির নির্মাণকাজ বাধাগ্রস্ত হলে সেখানে বিকল্প হিসেবে ডেভেলপার কোম্পানির সহযোগিতায় ভবনটি কাজ সম্পন্ন করা হবে। ২০০৭ সালের ১২ নভেম্বর এ বিষয়ে ওয়াকফ প্রশাসকের কাছে আবেদনও করে দরগা পরিচালনা কমিটি। ২০০৯ সালের ৩ আগস্ট চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ও নকশা করাসহ ১১টি শর্তে অনুমোদন দেওয়ার কথা ছিল ওয়াকফ প্রশাসকের।

কিন্তু ওয়াকফ প্রশাসকের অনুমোদন পাওয়ার আগেই কোনো শর্ত না মেনে তড়িঘড়ি করে বায়েজিদ বোস্তামী (রহ.) দরগা শরীফের সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট আনোয়ারুল ইসলাম চৌধুরী এবং জেএমজি হোল্ডিং এস্টেট এন্ড ডেভেলপার কোম্পানির চেয়ারম্যান মাকসুদুর রহমানের মধ্যে একটি দ্বিপক্ষীয় চুক্তি সম্পাদন করা হয়। যা সম্পূর্ণ নিয়মবর্হিভূতভাবে করা হয়েছে বলে জানিয়েছে দুদক।

ওয়াকফ প্রশাসনের ১১টি শর্তের মধ্যে রয়েছে ওয়াকফ এস্টেটের নিজস্ব অর্থায়নে মসজিদ নির্মাণ ও বহুতল ভবন নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করা হবে, ওয়াকফ সম্পত্তি ব্যাংক ও অর্থলগ্নিকারী কোন প্রতিষ্ঠানের নিকট বা ব্যক্তির নিকট দায়বদ্ধ রাখা যাবে না, কোন অবস্থাতে ওয়াকফ প্রশাসকের অনুমতি ব্যতিত নির্মিত ভবনের কোনো দোকান ও দীর্ঘমেয়াদি পজেশনসহ মালিকানা স্বত্ত্ব হস্তান্তর করা যাবে না।

দুদক বলছে, জেএমজি হোল্ডিং এস্টেট এন্ড ডেভেলপার কোম্পানি সরকারের ক্রয়-বিক্রয় নীতিমালা বা পিপিআর আইন না মেনে বিনা দরপত্রে পুরাতন মসজিদের সাড়ে ১০ লাখ টাকার মালামাল বিক্রি করে শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছে।

দুদক আরও জানায়, প্রস্তাবিত বহুতল বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণের সময়ে দোকান বিক্রির লিফলেট ও ব্রশিওর ছেপে বিজ্ঞাপন প্রচার শুরু করে ওই প্রতিষ্ঠানটি। দোকান বরাদ্দ দেওয়ার কথা বলে অগ্রিম সালামি হিসেবে প্রতিটি দোকান বাবদ ২০ লাখ টাকার মূল্য হিসেবে প্রথম কিস্তিতে ৫ লাখ টাকা করে মোট ৫০ জনের কাছ থেকে আড়াই কোটি টাকা আদায় করা হয়। পুরো এই টাকাটা দুই পক্ষের লোকজন আত্মসাৎ করেছে বলে দুদকের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। এতে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে দন্ডবিধির ৪০৯, ৪২০, ৪৬৭, ৪৬৮, ৪৭১, ১০৯, ৫১১ ধারাসহ ১৯৪৭ সালের ২ নম্বর দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনে ৫(২) ধারায় তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়।

জানতে চাইলে দরগা শরীফের সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট আনোয়ারুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘দুদক আমার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ এনেছে তা সঠিক নয়। আমি দেশের বাইরে আছি। এসেই এ ব্যাপারে বিস্তারিত কথা হবে।’

দুর্নীতি দমন কমিশন জেলা সমন্বিত কার্যালয় চট্টগ্রাম-১ এর নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, ‘অভিযুক্তরা আইন ভঙ্গ করে ওয়াকফ প্রশাসক কর্তৃপক্ষ থেকে দেওয়া ১১টি শর্ত ভঙ্গ করে দোকানপ্রত্যাশী ৫০ ব্যক্তির কাছ থেকে এককালীন পজেশন হস্তান্তর বিক্রি করে আড়াই কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে। এছাড়া ডেভেলপার কোম্পানি দরপত্রবিহীন মসজিদের সাড়ে ১০ লাখ টাকার পুরাতন মালামাল বিক্রি করে দেয়— যা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে অনুসন্ধানে দেখা যায়।’

এ ঘটনায় দরগা শরীফের সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট আনোয়ারুল ইসলাম চৌধুরী, জেএমজি হোল্ডিং এস্টেট এন্ড ডেভেলপার কোম্পানির পার্টনার রফিকুল ইসলাম, ইয়াজ্জেম হোসেন রোমেন ও মো. হারুনুর রশিদের বিরুদ্ধে কমিশন বরাবরে নিয়মিত মামলার দায়ের করতে সুপারিশ করা হয়েছে।

মুআ/সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!