রাজীব সেন প্রিন্স, বিশেষ প্রতিনিধি ::
রোববার বেলা ১০ টা ৪২। দামপাড়া পুলিশ লাইন মাঠে অবতরণ করে ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা একটি হেলিকপ্টার। যেটিতে চড়ে এসেছেন জঙ্গিদের আতঙ্ক বাবুল আক্তার। অতচ তার আজ সকালেই ঢাকা পুলিশ সদর দপ্তরে পুলিশ সুপার (এসপি) পদে যোগদান করার কথা ছিল। কিন্তু তার স্ত্রী দুর্বৃত্তের গুলিতে নিহত হওয়ার পর সকালেই ঢাকা থেকে পুলিশের হেলিকপ্টারে চট্টগ্রামে চলে আসতে হয় তাকে।
আগের মত সহকর্মীদের সাথে রসিকতা করারও সময় ছিল না তার, হেলিকপ্টার থেকে নেমেই গাড়িতে করে ছুটলেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উদ্দ্যেশে। কারণ তার প্রিয় সহধর্মীনি যে সেখানে চিরদিনের মতো শুয়ে আছে।
১০ মিনিটের মধ্যেই পৌছাল হাসপাতালে, কিন্তু আসার পরপরই কান্নায় ভেঙে পড়েন অসম সাহসী মানুষটি। মানসিক ভাবে তাকে দেখাচ্ছিল বিপর্যস্ত। তার কান্না আর আহাজারিতে ভারী হয়ে ওঠে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল প্রাঙ্গণ। আগে থেকে প্রস্তুত থাকা প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার আলোচিত্রির ক্যামেরায় ধরা পড়ে শুধু বাবুল আকতার নন, এসময় তার সঙ্গে কাঁদছেন চট্টগ্রাম নগর পুলিশের সদস্যরা। লাইভ টেলিকাষ্টের সুবাধে সেই ফুটেজ বিভিন্ন টিভিতে প্রচার হতেই আর্তনাথ ছড়িয়ে পড়ে গোটা পুলিশ বিভাগে।
চমেক হাসপাতালে এমন চিত্র যে কারো চোখের জল স্থির থাকার কথা নয়, কেঁদেছে তার সহকর্মী পুলিশ বাহিনী, কাঁদছে তার প্রাণপ্রিয় বন্ধু সংবাদকর্মীরাও। চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এক এক করে সান্তনা দেওয়ার লক্ষ্যে বাবুল আকতারকে জড়িয়ে ধরে ভেঙ্গে পড়ছে কান্নায়। কোনো সান্ত্বনাই যেন বাঁধ মানছিল না। ভারি হয়ে উঠছে চমেক হাসপাতালের পরিবেশ।
বাবুল আক্তারকে সান্ত্বনা দিতে চমেক হাসপাতালে ছিলেন নগর পুলিশের কমিশনারসহ সবগুলো বিভাগের অতিরিক্ত কমিশনার, উপকমিশনার এবং বিভিন্ন থানার অফিসার ইনচার্জরা। বাবুল আক্তারের আহাজারিতে সব পুলিশ কর্মকর্তা এবং পুলিশ সদস্যদের চোখ বেয়ে পানি ঝরতে দেখা গেছে। বাবুল আক্তার চট্টগ্রামের সাংবাদিকদের কাছেও অনেক প্রিয়ভাজন এবং তাদের ঘনিষ্ঠ একজন পুলিশ কর্মকর্তা।
সাংবাদিকদের জড়িয়ে ধরেও বাবুল আক্তার বিলাপ করে কান্নায় ভেঙে পড়ছেন বারবার। আর মায়ের জন্য অবিরাম কেঁদেই চলেছে তার দুই শিশুসন্তান মাহির ও তাবাসসুম। দুই শিশু আর তাদের বাবার কান্না দেখে উপস্থিত কেউ কান্না থামিয়ে রাখতে পারেননি।
বাবুল আক্তারের প্রতিবেশী সহকর্মী পুলিশ কর্মকর্তা বায়েজিদ বোস্তামী থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোহাম্মদ মহসিন বলেন, ‘স্যারকে সান্ত্বনা দেওয়ার কোনো ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না। এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড কোনোভাবেই সহ্য করা যায় না। স্যার পুরোপুরি ভেঙে পড়েছেন। দুই সন্তানকে জড়িয়ে ধরে তিনিও আহাজারি করে চলেছেন।
যে পুলিশ কর্মকর্তার ভয়ে সমগ্র চট্টগ্রামের জঙ্গি সন্ত্রাসীরা আতঙ্কে থাকত প্রতি মুহূর্ত, সেই পুলিশ কর্মকর্তার স্ত্রীকে এমন নৃশংসভাবে হত্যা পুরো পুলিশ বিভাগকেই ভাবিয়ে তুলেছে। হত্যাকারীদের গ্রেপ্তারে চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ ইতিমধ্যে অভিযান শুরু করেছে বলে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
অন্যদিকে নগরীর দামপাড়া পুলিশ লাইন মাঠে বাবুল আকতারের স্ত্রীর প্রথম নামাজে জানাজায় গিয়ে নিজেও কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছেন সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন। প্রাণপ্রিয় স্ত্রী মাহমুদা আকতার মিতুর মৃত্যুতে স্তব্ধ,শোকার্ত এসপি বাবুল আক্তারকে সান্তনা জানাতে গিয়েছিলেন তিনি। অশ্রু সংবরণ করতে পারেননি তিনিও। সেখানেও তৈরি হয় এক হৃদয় বিদারক দৃশ্যের। এরপরও মনকে শক্ত করে সান্তনা জানায় মেয়র।
রোববার সকাল পৌনে ৭টার দিকে নগরীর জিইসি মোড়ে ছুরিকাঘাত ও গুলি করে পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা অাক্তার মিতুকে হত্যা করা হয়। তার দুটি ছেলে ও মেয়ে রয়েছে। তাদের ক্যান্টন্টমেন্ট স্কুলে নিয়ে যাওয়ার সময় এ ঘটনা ঘটে। বাবুল অাক্তার ঢাকায় অবস্থান করলেও তার স্ত্রী ও ছেলেমেয়েকে নিয়ে নগরীর জিইসি এলাকার একটি ফ্ল্যাটে থাকতেন।
জঙ্গিবিরোধী অভিযানে এসপির সক্রিয় ভূমিকার কারণে তাঁর স্ত্রীকে হত্যা করা হতে পারে বলে ধারণা পুলিশের। প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য, এই দুর্বৃত্তরাও মোটরসাইকেলে করে এসেছিল।
পিবিআই চট্টগ্রাম প্রধান অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বশির আহমেদ খান জানান, এই হত্যাকাণ্ডের ধরন জঙ্গিদের দ্বারা সংঘটিত আগের হত্যাকাণ্ডগুলোর সঙ্গে মিল আছে। এটি একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। ঘটনাস্থলের অাশপাশের সিসিটিভির ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছে। খুনিদের ধরতে অভিযান চলছে।
রিপোর্ট : রাজীব সেন প্রিন্স
এ এস / জি এম এম / আর এস পি :::