বাধ্যতামূলক, তবু খাদ্যশস্যের লাইসেন্সে ব্যবসায়ীদের এতো অনীহা!

খাদ্যশস্যের লাইসেন্স ছাড়াই চট্টগ্রামের অধিকাংশ আমদানিকারক, পাইকারি আড়তদার, মিলার ও খুচরা ব্যবসায়ীরা ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন অবাধে। এই বিষয়ক সরকারি প্রজ্ঞাপন জারির ৮ বছর পেরিয়ে গেলেও ফুড গ্রেইন বা খাদ্যশস্য লাইসেন্স নেওয়ার ব্যাপারে ব্যবসায়ীদের আগ্রহও নেই। বাজার মনিটরিংয়ের প্রসঙ্গ এলে লোকবল সংকট দেখিয়ে কর্তৃপক্ষ দায় সারে। অন্যদিকে আইন না মানার শাস্তি বা জরিমানার পরিমাণও নগণ্য বলে সুযোগের সদ্ব্যবহার করেন ব্যবসায়ীরা।

বাজারে ধান-চালের অবৈধ মজুদ ঠেকাতে ব্যবসায়ীদের ফুড গ্রেইন লাইসেন্স নেওয়ার বিষয়টি বাধ্যতামূলক করে ২০১১ সালের ৪ মে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। এছাড়া ২০১৭ সালের ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত লাইসেন্স নেওয়ার শেষ সময়সীমা বেঁধে দিলেও অধিকাংশ ব্যবসায়ী লাইসেন্স নেননি।

এক্ষেত্রে জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক দপ্তরের নীরব ভূমিকাকে দায়ী করেছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে খাদ্য নিয়ন্ত্রক কার্যালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, ফুড গ্রেইন লাইসেন্স গ্রহণ করার জন্য একাধিকবার আমদানিকারক, আড়তদার, মিলার ও খুচরা ব্যবসায়ীদের চিঠি ইস্যু করা হয়েছে। কিছু ব্যবসায়ী এই লাইসেন্সটি নিলেও অধিকাংশ লাইসেন্সের আওতায় আসেনি। এক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের সদিচ্ছা থাকতে হবে।

তবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, খাদ্যশস্যের লাইসেন্স নেওয়ার বাধ্যবাধকতা এরশাদ সরকারের আমলে চালু ছিল। পরবর্তীতে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় এলে সেটি বাতিল করে দেওয়া হয়। সেই সময় বাধ্যবাধকতা না থাকলেও অনেক ব্যবসায়ীর কাছে এই লাইসেন্সটি ছিল। তবে যেহেতু নতুন করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে তাই সবাইকে এই লাইসেন্সের আওতায় আনতে হবে। সবাইকে লাইসেন্সের আওতায় আনা সম্ভব হলে দেশে ব্যবসায়ীদের কাছে কী পরিমাণ ধান-চাল মজুদ রয়েছে সেটি জানা যাবে। বর্তমানে ১৫ দিন পরপর মজুদের হিসাব দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। যা বাড়তি ঝামেলা হিসেবে দেখেন অধিকাংশ ব্যবসায়ী।

অন্যদিকে লাইসেন্স নেওয়ার বিষয়ে অনীহা বেশি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের মধ্যে। কর্ণফুলী কমপ্লেক্স বাজারের খুচরা ব্যবসায়ী রতন বড়ুয়া চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘পাইকারদের কাছ থেকে প্রত্যেক ক্যাটাগরির এক বস্তা করে চাল কিনে আমরা বিক্রি করে। চালের বাজার অস্থিতিশীল করার পেছনে আমাদের (খুচরা ব্যবসায়ী) কোনো ভূমিকা থাকে না।’

তিনি আরও বলেন, ‘১৫ দিন পর পর চালের রিটার্ন দাখিল করতেও অনেক ঝামেলা পোহাতে হয়। এই নিয়মটা কেবল আমদানিকারক, আড়তদার ও মিলারদের জন্য হলে ঠিক হতো।’

চট্টগ্রাম রাইচ মিল মালিক সমিতির সভাপতি শান্ত দাশগুপ্ত চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমাদের সমিতির অধিকাংশ ব্যবসায়ী লাইসেন্স গ্রহণ করেছেন। যারা লাইসেন্স নেয়নি তাদেরকে চিঠির মাধ্যমে অবহিত করে সময়সীমা বেঁধে দেওয়া উচিত। তাছাড়া ব্যবসা করতে হলে তো সরকারের আইন মানতে হবে। সবাইকে ফুড লাইসেন্সের আওতায় আনা গেলে সরকারের কাছে ধান-চালের মজুদ তদারকি করা সহজ হবে। আমরা সরকারের কার্যক্রমকে সহায়তা করতে প্রস্তুত আছি।’

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম চাউল ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ওমর আজম প্রথমদিকে অস্বীকার করলেও পরে স্বীকার করে চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমাদের সমিতিতে কতজন লাইসেন্স নেননি, সেই হিসাবটা পুরোপুরি জানা নেই। তবে দেড় বছর আগে যখন আমরা খাদ্য বিভাগ থেকে চিঠি পাই, তখন আমাদের প্রায় ৯০ শতাংশ ব্যবসায়ী লাইসেন্সের আওতায় চলে আসে। বর্তমানের চিত্রটা এই মুহূর্তে বলতে পারছি না।’

খাতুনগঞ্জের শীর্ষ খাদ্যশস্য আমদানিকারক বিএসএম গ্রুপের কর্ণধার আবুল বশর চৌধুরী বলেন, ‘অনেক আমদানিকারকের কাছে ফুড গ্রেইন লাইসেন্স আছে। তবে এটাও ঠিক অনেকেই লাইসেন্সের আওতায় নেই। আবার কারও কারও থাকলেও হয়তো দেখা যাবে মেয়াদ শেষ। নতুন করে নবায়ন করেননি। যারা লাইসেন্স নেয়নি বা মেয়াদ শেষ হয়ে যাবার পরও নবায়ন করেনি তাদের উচিত দ্রুত এই লাইসেন্সটি গ্রহণ করা। তাহলে সরকার দেশের মধ্যে কার কাছে কী পরিমাণ ধান-চাল মজুদ আছে সেটি জানতে পারবে।

পাহাড়তলী বণিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক এসএম নিজাম উদ্দিন চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘পাহাড়তলী চাল বাজারের অধিকাংশ আড়তদার ফুড গ্রেইন লাইসেন্সের আওতায় আসেনি। আসলে লাইসেন্স নেওয়া নিয়ে ব্যবসায়ীদের মধ্যে এক ধরনের অনীহা রয়েছে। মনিটরিং হচ্ছে না। আমরাও চাই সব ব্যবসায়ী ফুড গ্রেইন লাইসেন্সের আওতায় আসুক। শুধুমাত্র চাক্তাইয়ের চালপট্টি কিংবা পাহাড়তলী বাজারের আড়তদারদের ফুড লাইসেন্স নিশ্চিত করলে হবে না। এর বাইরে অন্য এলাকার ব্যবসায়ীদেরও লাইসেন্স আছে কি না সেটি নিশ্চিত করতে হবে।

আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক মো. মাহবুবুর রহমান চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘এটা ঠিক লাইসেন্স নেওয়ার ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীরা অনীহা দেখায়। যখন যৌথবাহিনী ছিল তখন ধাক্কা খেয়ে অনেকেই নিয়েছে। এরপর ভাটা পড়েছে।আবার জরিমানার পরিমাণও অতো বেশি না। তাছাড়া আমাদের সুনির্দিষ্ট কোনো আইন নেই তাই জরিমানা বা তেমন শাস্তিও দেয়া যায় না। আড়তদার এবং মিল মালিকদের কাছে লাইসেন্স থাকলেও পাইকারি আর খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে পাওয়া যায় না। তারা অনীহা দেখিয়ে পার পেয়ে যায়। কেউ কেউ ব্যবসায় পরিবর্তন করে অন্য ব্যবসায়ে নেমে পড়েন। তখন আর কিছুই হয়না।

অভিযান এবং জরিমানার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘অভিযানে যাওয়া দরকার কিন্তু লোকবল সংকট এবং নানান কারণে যাওয়া হয়না। মোবাইল কোর্টের কথা প্রশাসনকে জানালে তারাও তেমন গুরুত্ব দেয় না।

উল্লেখ্য, ২০১১ সালের ৪ মে গেজেট জারি করে কী পরিমাণ খাদ্যশস্য কতদিন মজুদ রাখা যাবে তা নির্ধারণ করে দেয় খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়। গ্যাজেট অনুযায়ী, লাইসেন্স ছাড়া কোনো ব্যবসায়ী এক টনের বেশি খাদ্যশস্য বা খাদ্যসামগ্রী মজুদ রাখতে পারবেন না। এছাড়া আমদানিকারক, পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ী এবং চালকল মালিকরা সরকার নির্ধারিত হারে ধান ও চাল নির্ধারিত সময়ের জন্য মজুদ করতে পারবেন। অটোমেটিক, হাসকিং ও মেজর চালকলের মালিকরা তাদের পাক্ষিক ছাঁটাই ক্ষমতার পাঁচ গুণ ধান ৩০ দিনের জন্য মজুদ করতে পারবেন। অটোমেটিক ও মেজর চালকলের মালিকরা পাক্ষিক ছাঁটাই ক্ষমতার দুই গুণ চাল এবং হাসকিং চালকলের মালিকরা সর্বোচ্চ ১০০ মেট্রিক টন চাল ১৫ দিন পর্যন্ত মজুদ রাখতে পারবেন। পাইকারি বিক্রেতারা সর্বোচ্চ ৩০০ টন ধান বা চাল ৩০ দিন মজুদ রাখতে পারবেন। অন্যদিকে খুচরা বিক্রেতারা ১৫ দিনের জন্য সর্বোচ্চ ১৫ টন এবং আমদানিকারকরা আমদানিকৃত ধান বা চালের সবটুকু ৩০ দিন পর্যন্ত মজুদ করতে পারবেন।

বাংলাদেশের ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে মজুদদারি নিষিদ্ধ করে কঠোর সাজার বিধান রাখা হয়েছে। আইনে মজুদদারির সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, কোনো আইন দ্বারা বা আইনের আবর্তে কোনো ব্যক্তি মজুদ অথবা গুদামজাত করার সর্বোচ্চ পরিমাণের বেশি দ্রব্য মজুদ বা সংরক্ষণ করলে তা মজুদদারি হিসেবে গণ্য করা হবে। এ আইনে মজুদদারি বা কালোবাজারির সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড বা আজীবন কারাদণ্ড। অপরাধের মাত্রা ভেদে অন্যান্য মেয়াদের কারাদণ্ড ও জরিমানাও করা যেতে পারে। তবে অভিযুক্ত ব্যক্তি যদি প্রমাণ করতে পারেন যে, তিনি আর্থিক বা অন্যভাবে লাভের জন্য মজুদ করেননি, সেক্ষেত্রে তাকে সর্বোচ্চ তিন মাসের জেল ও জরিমানা করা যাবে।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!