বাদুড়, কোভিড-১৯ এবং প্রাণিজ আমিষ

বাদুড় আমাদের অতি পরিচিত একটি প্রাণী। পৃথিবীতে সহস্রাধিক বাদুড়ের প্রজাতি আছে। বৃহৎ আমাজন জঙ্গল তৈরি হয়েছে বাদুড়ের মাধ্যমেই। পরাগায়ন ঘটিয়ে এরা আমাদের খাদ্য উৎপাদনে বিরাট ভূমিকা পালন করে। বাদুড় যেমন আমাদের ইকোলজিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে, তেমনি উড়ন্ত এই স্তন্যপায়ী প্রাণীটির বাঁচার জন্য খাদ্যের প্রয়োজন হয়। এরা রসালো ফল, পোকামাকড় খেয়ে বেঁচে থাকে। যদিও মাংসাশী বাদুড়ও আছে যারা মাংস জাতীয় খাবারের উপর নির্ভরশীল।

কিন্তু এর পাশাপাশি বাদুড় অনেক মারাত্মক রোগের জীবাণু বহন করে থাকে। উদাহরণস্বরূপ নিপাহ ভাইরাস, রেবিস ভাইরাসের কথা বলা যেতে পারে। যদিও বাদুড় এগুলো বহন করে কিন্তু এসব জীবাণু বাদুড়ের শরীরে কোন রোগ সৃষ্টিতে সক্ষম নয়। বাদুড়ের রোগ প্রতিরাধ ক্ষমতা এসব ভাইরাসকে কাবু করতে সক্ষম। কিন্তু এসব ভাইরাস আমাদের আবার আমাদের অনেক ক্ষেত্রেই কাবু করতে পারে। মানুষ যখন অযাচিতভাবে বৃক্ষ নিধনে লিপ্ত হয় এবং ফলশ্রুতিতে বাদুড়ের খাবার এবং বাসস্থানে আঘাত হানে, তখন বাদুড়ের দেহের এসব ভাইরাস আমাদের দেহে সংক্রমিত হতে পারে। যেমন নিপাহ ভাইরাস বাদুড় থেকে মানুষে আসার মাধ্যম হচ্ছে খেজুরের কাঁচা রস। রাতের বেলায় খাদ্য অন্বেষণের সময় খেজুরের রসের গন্ধে আকৃষ্ট হয়ে এরা রস সংগ্রহের হাড়িতে ভিড় করে। রস পান করার পাশাপাশি এদের রেচন জাত পদার্থ এবং মল-মুত্রের মাধ্যমে ভাইরাস কাঁচা রসে স্থানান্তরিত হয়। আর আমরা আমাদের দেহে ভাইরাসটি নিয়ে আসি কাঁচা রস গ্রহণের মাধ্যমে।

কোভিড-১৯ এটিও বাদুড় থেকে আসা একটি ভাইরাস। যদিও কোভিড-১৯ এর সাথে বাদুড়ের করোনাভাইরাসের জিনগত মিল আছে ৯৭ শতাংশ। এর মানে কোভিড-১৯ এর কিছু অংশ অন্য কোন পোষক থেকে আসতে পারে। এক্ষেত্রে পেঙ্গলিন নামক প্রাণী থেকে বাকি অংশ আসতে পারে বলেও চিন্তা করা হচ্ছে। তার মানে বাদুড়ের করোনাভাইরাস ও পেঙ্গলিনের ভাইরাস একসাথে মিলে কোভিড-১৯ এর উদ্ভব হতে পারে।

প্রশ্ন আসে এ মিলনটি কিভাবে ঘটতে পারে? অবাক করা হলেও সত্যি এই মিলটি ঘটিয়েছি আমরা মানুষরা। অবাক হবেন না!

উহানের যে স্থানে এই ভাইরাসের উৎপত্তি হয়েছে সেটিতে বাদুড় ও পেঙ্গলিনসহ নানা জাতের বন্যপ্রাণী বিক্রি করা হচ্ছে বছরের পর বছর ধরে। এভাবে বছরের পর বছর ধরে এই একসাথে রেখে বন্যপ্রাণী বিক্রি ও তাদের সংমিশ্রণের মাধমেই শক্তিশালী কোভিড-১৯ এর উদ্ভব। যা পরবর্তীতে মানুষে সংক্রমিত হয়ে তার প্রাণঘাতী ভূমিকা অব্যাহত রেখে চলেছে। পরিশেষে মানুষ থেকে মানুষে কোভিড-১৯ সংক্রমিত হচ্ছে বাদুড় বা পেঙ্গলিনের কোন সাহায্য ছাড়াই।

আমরা ইতিমধ্যেই জেনেছি যে, হাঁচি-কাশির মাধ্যমে আক্রান্ত ব্যক্তি থেকে সহজেই একজন সুস্থ ব্যক্তি সংক্রমিত হতে পারে। তাই বলা হচ্ছে সামাজিক দূরত্ব বজায়ের মাধ্যমে এই ভাইরাসের আক্রমন থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব। তাই যদি আমরা সবাই দূরত্ব বজায় রেখে চলতে পারি তাহলে এই ভাইরাস ধীরে ধীরে নিঃশেষ হয়ে যেতে পারে। পাশাপাশি কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত ব্যক্তিকে আলাদা রেখে চিকিৎসা প্রদান করতে হবে এবং কোভিড-১৯ টেস্ট চালিয়ে যেতে হবে।

এবার আসি, কোভিড-১৯ অন্য প্রাণীতে যেতে পারে কিনা?

আমরা তিনটি বিরল ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছি যেখানে কোভিড-১৯ মানুষের শরীর থেকে বিড়াল, কুকুর ও বাঘের শরীরে প্রবেশ করেছে। কিন্তু এসব প্রাণী থেকে মানুষে সংক্রমিত হওয়ার কোন প্রমাণ নেই। কোভিড-১৯ বিভিন্ন প্রাণীর দেহে ইনফেকশন দিয়ে পরীক্ষা করা হয়েছে যে এটি বাদুড় বা অন্য বন্য প্রাণীর দেহে প্রবেশ করতে পারে। কোভিড-১৯ মানুষ থেকে গবাদি পশু বা মুরগি জাতীয় প্রাণীর দেহে সংক্রমিত হয়নি বা এসব প্রাণী থেকে মানুষে সংক্রমণের প্রমাণ এখনও পাওয়া যায়নি। তাই প্রাণীজ আমিষের মূল উপাদান দুধ, ডিম, মাংস এগুলো আমাদের খাদ্যতালিকায় নিশ্চিতভাবে রাখা যায়।

এবার আসি আমিষের ভূমিকা কী?
আমরা যদি কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে জয়ী হতে চাই তাহলে আমাদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতার উন্নতি ঘটাতে হবে।
১. কোভিড-১৯ মানুষের দেহে প্রবেশদ্বার হচ্ছে শ্বসনতন্ত্র। এখানে অনেক সিলিয়া ও ফ্লাজেলা থাকে যেগুলো ছোট ছোট পদার্থকে আটকে দেয়। কোভিড-১৯ এর ভাইরাস প্রবেশের সময় এখানেই প্রথম বাধার সম্মুখীন হয়।
আমিষ জাতীয় খাবার সিলিয়া ও ফ্লাজেলা গঠনে সাহায্য করে।
২. আমাদের কোষপ্রাচীরের অনেক অংশ প্রোটিন দিয়ে গঠিত। কোষ প্রাচীর সুস্থ থাকলে ভাইরাস সহজে কোষে ঢুকতে পারবে না।
৩. কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হলে প্রচুর এন্টিবডি প্রয়োজন হবে। এসব এন্টিবডি আসলে প্রোটিন।
৪. অন্য খাবার আমাদের শরীরে পুষ্টি সরবরাহ করতে চাইলে সেগুলো ভাঙ্গতে যে এনজাইম প্রয়োজন হয় সেগুলো প্রকৃতপক্ষে প্রোটিন।

তাই আমাদেরকে বেশি বেশি প্রোটিন জাতীয় খাদ্য গ্রহণ করতে হবে। কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে জয়ী হওয়ার জন্য ভাইরাসকে মারতে হবে। ভাইরাসকে মারতে হলে দূরত্ব বজায় রাখতেই হবে। আর যদি কোভিড-১৯ এর ভাইরাস আমাদের শরীরে ঢুকে যায় তখন তার থেকে পরিত্রাণ পেতে রোগপ্রতিরোধ শক্তিশালী হতে হবে। প্রানিজ প্রোটিন (দুধ, ডিম, মাংস) সেই শক্তি অর্জনে মূল ভূমিকা পালন করবে।

লেখক: ড. শাহনেওয়াজ আলী খান
সহযোগী অধ্যাপক (ফিজিওলজি, বায়োকেমিস্ট্রি ও ফার্মাকোলজি বিভাগ), চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও এনিম্যাল সাইন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!