বাকলিয়ায় উপনির্বাচন/ আ. লীগে প্রার্থীর ভিড়ে সুবিধায় বিএনপি, ভোটে অনাগ্রহ মানুষের
চট্টগ্রাম নগরীর দেওয়ানবাজারের কালভার্টটি পার হতেই চোখে পড়বে সারি সারি পোস্টার! সাদাকালো পোস্টার ঝুলছে মানুষের মাথার ওপর! আবার থেমে থেমে দলে দলে বিভিন্ন প্রার্থীর মিছিলও প্রদক্ষিণ করছে এলাকার অলিগলি। নানা প্রার্থীর পক্ষে নানা স্লোগানে কিছুক্ষণ পর পর মুখরিত হচ্ছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ১৭ নম্বর পশ্চিম বাকলিয়া ওয়ার্ডের রাস্তাঘাট। তবে মিছিল শেষ হতেই সেই উত্তেজনা নিমিষেই বিলীন! এলাকার ভোটারদের মধ্যে এই উপনির্বাচন নিয়ে নেই কোনও আগ্রহ।
তার কারণ হিসেবে বলছেন, প্রথমত এই নির্বাচনের আট মাস পরই অনুষ্ঠিত হবে মেয়র নির্বাচন। এছাড়া নির্বাচন আদৌ সুষ্ঠু হবে কিনা সেই প্রশ্নটিও তাদের মাঝে ঘুরপাক খাচ্ছে। সাধারণ জনগণের সঙ্গে সুর মিলিয়ে একই প্রশ্ন উপনির্বাচনে বিএনপি সমর্থিত তরুণ প্রার্থী সাবেক কাউন্সিলর মরহুম একেএম জাফরুল ইসলামের পুত্র একেএম আরিফুল ইসলাম ডিউকেরও।
অন্যদিকে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীরা বলছেন, নির্বাচন শতভাগ সুষ্ঠু হবে। ভোটাররা তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবেন। একই কথা জানিয়েছেন রিটার্নিং অফিসার মো. হাসানুজ্জামানও। এ নির্বাচনকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে শতভাগ প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে নির্বাচন কমিশন। তবে এ উপনির্বাচন কেমন হয় তা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে আগামী ২৫ জুলাই পর্যন্ত।
নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা যায়, গত ১৭ এপ্রিল বাকলিয়া ১৭ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর একেএম জাফরুল হক মারা যাওয়ায় ১২ জুন ওই ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদটি শূন্য ঘোষণা করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। এরপর নির্বাচন কমিশন এ ওয়ার্ডে উপনির্বাচনের তফশিল ঘোষণা করে।
মঙ্গলবার (২৩ জুলাই) মধ্যরাত থেকে ১৭ নম্বর ওয়ার্ডে উপনির্বাচনের প্রচার প্রচারণা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। নির্বাচনের জন্য সব ধরণের প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে নির্বাচন কমিশন। চসিকের ১৭ নম্বর পশ্চিম বাকলিয়া ওয়ার্ডে মোট ভোটার সংখ্যা রয়েছে ৪৯ হাজার ৮শ ২৫ জন। এর মধ্যে ২৩ হাজার ৭৪৮ জন পুরুষ এবং ২৬ হাজার ৭৭ জন রয়েছে মহিলা ভোটার। এ ওয়ার্ডে মোট ১৭টি ভোট কেন্দ্রে ভোট কক্ষ আছে ২২৪টি। আগামী ২৫ জুলাই ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) অনুষ্ঠিত হবে এই উপ-নির্বাচন।
এখানে বিএনপির সমর্থন নিয়ে মিষ্টি কুমড়া প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন সাবেক কাউন্সিলর মরহুম একেএম জাফরুল ইসলামের পুত্র একেএম আরিফুল ইসলাম ডিউক। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ থেকে সরাসরি সমর্থন না পেলেও নিজ নিজ অনুসারী নেতাদের নিয়ে মাঠে আছেন পাঁচ প্রার্থী। রেডিও প্রতীক নিয়ে লড়ছেন মাসুদ করিম টিটু। তিনি চট্টগ্রাম সরকারি সিটি কলেজ ছাত্র সংসদের সাবেক ভিপি ও পশ্চিম বাকলিয়া ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক। তিনি নগর আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সাধারণ সম্পাদক ও মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিনের অনুসারী হিসেবে পরিচিত।
ঘুড়ি প্রতীক নিয়ে লড়ছেন চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের উপ-প্রচার সম্পাদক শহিদুল আলম। তিনি এর আগেও ওই ওয়ার্ড থেকে তিনবার কাউন্সিলর পদে নির্বাচিত হয়েছিলেন। নগর আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে প্রয়াত এবিএম মহিউদ্দীন চৌধুরীর অনুসারী হিসাবে পরিচিত শহিদুল আলম।
মূলত আরিফুক হক চৌধুরী ডিউক, মাসুদ করিম টিটু এবং শহিদুল আলমের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হওয়ার সম্ভাবনার কথা বলছেন এলাকাার ভোটাররা। এছাড়া ভোটের মাঠে রয়েছেন, লাটিম প্রতীকে ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ নেতা মোহাম্মদ শফি, টিফিন ক্যারিয়ার প্রতীক নিয়ে লড়ছেন নগর যুবলীগের সাবেক সহ-সাংস্কৃতিক সম্পাদক শাহেদুল ইসলাম শাহেদ, ওয়ার্ড যুবলীগ নেতা শেখ নাঈম উদ্দীন লড়ছেন ঠেলাগাড়ি প্রতীক নিয়ে।
ভোটারদের আগ্রহ নেই নির্বাচনে
ডিসি রোডের ভাড়াটিয়া জাহানারা বেগম। তিনি বাসাবাড়িতে গৃহকর্মীর কাজ করেন। ঘুড়ি প্রতীকের একটি মিছিল রাস্তা দিয়ে পার হতে দেখে তিনি বাসা থেকে বের হন তা দেখতে। তবে দেখার পর তার মন্তব্য ছিল ‘ভোট নিয়ে আমার কোনও আগ্রহ নেই। এখন আর আগের মত ভোট হয় না। ভোট নিয়ে গতবারও মারামারি হয়েছে। এখন যা দেখছি খুব মারামারি হবে। আর আমাদের তো ভোট দিতে দিবে না। পোলাপাইনরা নিজেরাই দিয়ে দেবে।’
তার পাশেই দাঁড়ানো পোশাককর্মী মমতাজ বেগম বলেন, ‘আমরা তো এখানকার অস্থায়ী বাসিন্দা। ভোটার হলেও শুধু সার্টিফিকেট ছাড়া কমিশনাররা কোনও কাজে আসে না। তাই এসব ভোট নিয়ে আমাদের কোনও আগ্রহ নেই।’
মুদির দোকানি অনিল দে বলেন, ‘এই নির্বাচনে জয়ী কাউন্সিলরের মেয়াদ হবে মাত্র ৮ থেকে ৯ মাস। এখন যিনি কাউন্সিলর হবেন তিনি তেমন উন্নয়ন করতে পারবে কিনা সেটাও একটা কথা। তাই এ নির্বাচন নিয়ে আমাদের কোনও আগ্রহ নেই। এরপরও যদি ভোট দেওয়ার সুযোগ পাই ভোট দিতে যাব।’
স্ক্র্যাপ ব্যবসায়ী ইলিয়াস বলেন, ‘নির্বাচন যেভাবেই হোক। এখানকার জনগণ প্রার্থী ঠিক করে রেখেছে। যদি সুযোগ পায় তাহলে যোগ্য প্রার্থীকেই ভোট দিবে।’
ফার্নিচার ব্যবসায়ী রহুল আমীন বলেন, ‘এ ওয়ার্ডে সাবেক কাউন্সিলর জাফর সাহেব অনেক কাজ করেছেন। এলাকার মানুষ তার পুত্রকেই তার স্থানে বসাতে চায়।’
এ ওয়ার্ডটি জনবহুল হওয়ায় সড়কগুলো অনেকটা সরু। বেশকিছু এলাকায় এখনো কাঁচা সড়ক রয়েছে। নালা পরিস্কার হওয়ায় জলাবদ্ধতা না হলেও ময়লা আবর্জনা পরিস্কারে ধীরগতির কারণে রাস্তার ওপর অনেক জায়গায় ময়লার স্তুপ থাকে। এছাড়া মাদক ছিনতাইসহ নানা সন্ত্রাসী কার্যক্রম এ ওয়ার্ডের অন্যতম সমস্যা। তবে এটি সরাসরি পুলিশের কাজ হলেও জনপ্রতিনিধিদের ভূমিকা কেমন হবে তা দেখতে চান এলাকার ভোটাররা।
আওয়ামী লীগের ঠেলাঠেলিতে সুবিধায় বিএনপি
এ নির্বাচনে সাবেক কাউন্সিলর ও বিএনপি নেতা মরহুম একেএম জাফরুল ইসলামের পুত্র একেএম আরিফুল ইসলাম ডিউক বিএনপির রাজনীতিতে যুক্ত না থাকলেও নির্বাচনে নগর বিএনপির সমর্থন পেয়েছেন। এমনকি তার জন্য প্রচারণায় এসেছেন বিএনপির কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান ও সাবেক মন্ত্রী আব্দুল্লাহ আল নোমান ও নগর বিএনপির সভাপতি ডা. শাহদাত হোসেন। এছাড়া স্থানীয় নেতাকর্মীরাও তার সঙ্গে দিনরাত কাজ করে যাচ্ছেন। বিএনপির সমর্থনে একক প্রার্থী হওয়ায় ভোটের রাজনীতিতে সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছেন মিষ্টি কুমড়া প্রতীক নিয়ে ভোটের মাঠে থাকা জাফরপুত্র ডিউক।
অন্যদিকে এ নির্বাচনের আওয়ামী লীগের পাঁচজন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। উদ্যোগ নিয়েও একক প্রার্থীকে ভোট যুদ্ধে রাখতে ব্যর্থ হয়েছে নগর আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ। গত ১১ জুলাই মনোনয়ন প্রত্যাহারের শেষ দিন হওয়ায় আগের দিন ১০ জুলাই আওয়ামী লীগ থেকে একক প্রার্থী নির্ধারণে জরুরি এক সভায় বসেছিলেন নগর আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ। তবে নগর আওয়ামী লীগ নেতাদের মতভেদে একক প্রার্থী নির্ধারণের বিষয়টি ভেস্তে যায়। মূলত আ জ ম নাছিরের সমর্থন নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী মাসুদ করিম টিটু এবং মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের সমর্থন নিয়ে ভোট যুদ্ধে থাকা সাবেক কাউন্সিলর শহিদুল আলমকে কেন্দ্র করে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছে চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের রাজনীতি। এই দুই প্রার্থীর মধ্যে সমঝোতা করতে না পারায় আওয়ামী ঘরানার বাকি প্রার্থীদেরও নির্বাচন থেকে সরিয়ে আনতে পারেনি দলটি। ফলে অন্য তিন প্রার্থী শফি, শাহেদ ও নাঈমকেও সরানো যায়নি।
ডিসি রোডে প্রচারণার সময় প্রতিবেদকের সঙ্গে দেখা হয় মিষ্টি কুমড়া প্রতীকের প্রার্থী আরিফুল হক চৌধুরী ডিউকের। তিনি জয়ের বিষয়ে শতভাগ নিশ্চিত তবে ভোটাররা যদি তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন। ডিউক বলেন, ‘আমি জয়ের বিষয়ে শতভাগ আশাবাদী। তবে ভোটাররা যদি সুষ্ঠুভাবে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন আমি বিজয়ী হব। জনগণ আমার বাবার অসম্পূর্ণ কাজ শেষ করতে আমাকে সুযোগ দেবেন। এলাকার মাদক সমস্যার নিরসন, বাকি কাঁচা রাস্তা পাকাকরণ সর্বোপরি এলাকার মানুষের সুখ-দুঃখের ভাগিদার হতে চাই।’
লাটিম প্রতীক নিয়ে মিছিল করছিলেন ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ নেতা আলহাজ মো. শফি। তিনি বলেন, ‘এলাকার প্রধান সমস্যা জলাবদ্ধতা, আবর্জনামুক্ত পরিবেশ ও মাদকমুক্ত এলাকা গড়তে এলাকার জনগণ আমাকে নির্বাচিত করবে। আমি জয়ের বিষয়ে শতভাগ আশাবাদী।’ নির্বাচন শতভাগ সুষ্ঠু হবেও বলে মন্তব্য করেন তিনি।
ঘুড়ি প্রতীকের মাসুদ করিম টিটু নিজের জয়ের ব্যাপারে শতভাগ আশার কথা জানিয়ে বলেন, ‘ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ ও থানা আওয়ামী লীগের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে আমি কাউন্সিলর প্রার্থী হয়েছি। তাই স্থানীয় নেতৃবৃন্দ আমার সঙ্গেই আছেন। এছাড়া জনগণকে সঙ্গে নিয়েই আমি কাজ করছি। আমি নির্বাচিত হলে ময়লা অপসারণে দ্রুত সময়ের মধ্যে কার্যকর ব্যবস্থা নিব। এছাড়া ছয় মাসের মধ্যে মাদক ও ইভটিজিংমুক্ত ওয়ার্ড এলাকাবাসীকে উপহার দেব।’