বাংলার ইতিহাসে অবিরল অশ্রুঝরা এক কলঙ্কিত রাত

আজও গোটা জাতিকে রক্তাক্ত আর বিষণ্ন করে তোলে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাতের দুঃসহ স্মৃতি। আজও এ দেশের মানুষ স্তম্ভিত ও ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে ইতিহাসের কলঙ্কিত ও জঘন্যতম সেই অধ্যায়ের কথা ভেবে। সেদিন ভোর রাতে ঘাতকের বুলেটে সপরিবারে শহীদ হন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান। নারী আর শিশুদেরও রেহাই দেয়নি তারা। নিজের জীবন বিপন্ন জানার পরও বঙ্গবন্ধু তৎকালীন কৃষিমন্ত্রী আবদুর রব সেরনিয়াবাতের বাসায় আক্রমণের খবর পেয়ে তাকে বাঁচানোর সর্বাত্মক চেষ্টা করেন। কিন্তু পারেননি। এরপর তিনি নিজেও সপরিবারে শহীদ হন। ঘাতকের বুলেটের আঘাতে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয় বাংলাদেশ।

আড়াই তলা বাড়িটির দুই রুমবিশিষ্ট দোতলায় থাকতেন বঙ্গবন্ধু। বিপথগামী সেনাসদস্যদের হামলার খবর পেয়েই তিনি নিজ কক্ষ থেকে ইন্টারকম টেলিফোনে ব্যক্তিগত সহকারী আ ফ ম মুহিতুল ইসলামকে বলেন, ‘সেরনিয়াবাতের বাসায় দুষ্কৃতকারীরা আক্রমণ করেছে। জলদি পুলিশ কন্ট্রোল রুমে ফোন লাগা।’ কিন্তু কন্ট্রোল রুমের লাইনে সংযোগ হচ্ছিল না। একটু পরে বঙ্গবন্ধু নিজেই তার কক্ষের দরজা খুলে বেরিয়ে আসেন।

এ সময় শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের কথায় গৃহকর্মী আবদুর রহমান শেখ রমা নিচে নেমে বাড়ির প্রধান ফটকের বাইরে আসেন। দেখেন, সেনাবাহিনীর কয়েকজন সদস্য গুলি করতে করতে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির দিকে এগোচ্ছে। রমা বাড়ির ভেতরে ফিরে দেখেন, লুঙ্গি আর গেঞ্জি পরা অবস্থাতেই বঙ্গবন্ধু নিচে অভ্যর্থনা কক্ষে নেমে এসেছেন। মুহিতুলকে তিনি বলছেন, ‘পুলিশ কন্ট্রোল রুমে লাগাতে বললাম, লাগালি না?’

মুহিতুল জানালেন, তিনি চেষ্টা করেও সংযোগ পাচ্ছেন না। একপর্যায়ে গণভবন এক্সচেঞ্জের লাইন পাওয়া গেলেও অপর প্রান্ত থেকে কেউ কথা না বলায় বঙ্গবন্ধু নিজেই টেলিফোন হাতে নিয়ে বললেন, ‘আমি প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিব বলছি।’ কিন্তু বঙ্গবন্ধুর কথা শেষ হওয়ার আগেই দক্ষিণ দিকের জানালার কাচ ভেঙে একঝাঁক গুলি এসে অফিস কক্ষের দেয়ালে লাগল। তারপর গুলি আসতেই থাকল।

এ সময় বঙ্গবন্ধু টেবিলের ওপর শুয়ে পড়ে মুহিতুলকেও হাত ধরে কাছে টেনে শুইয়ে দেন। গোলাগুলি একটু থামলে দোতলা থেকে কাজের ছেলে মোহাম্মদ সেলিমের এনে দেওয়া পাঞ্জাবি ও চশমা পরে গাড়ি রাখার বারান্দায় আসেন তিনি। পাহারারত সেনা ও পুলিশ সদস্যদের বলেন, ‘এত গুলি হচ্ছে, তোমরা কী করছো?’ এরপর তিনি দোতলায় নিজের কক্ষে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দেন। তখন বঙ্গবন্ধু তার মিলিটারি সেক্রেটারি কর্নেল জামিল উদ্দিনকে ফোনে বলেন, ‘জামিল, তুমি তাড়াতাড়ি আসো। আর্মির লোক আমার বাসা অ্যাটাক করেছে। সফিউল্লাহকে ফোর্স পাঠাতে বলো।’ বঙ্গবন্ধু সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল কে এম সফিউল্লাহকেও ফোন করে বলেন, ‘সফিউল্লাহ, তোমার ফোর্স আমার বাড়ি অ্যাটাক করেছে। কামালকে (শেখ কামাল) বোধ হয় মেরে ফেলেছে। তুমি জলদি ফোর্স পাঠাও।’ এর কিছুক্ষণ পরই শহীদ হন তিনি।

বাঙালির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সন্তান শেখ মুজিব ফোন করার পর বন্ধ দরজা খুলে বাইরে আসেন। মেজর এ কে এম মহিউদ্দিনের নেতৃত্বে কয়েকজন সেনাসদস্য ঘিরে ধরে তাকে। তারা বঙ্গবন্ধুকে নিচে নিয়ে যেতে থাকে। সিঁড়ির বারান্দায় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ঘাতকদের তর্ক-বিতর্ক হয়। মেজর মহিউদ্দিনকে বঙ্গবন্ধু চড়া স্বরে ধমক দিয়ে এসবের কারণ জানতে চান। বঙ্গবন্ধুর মতো ব্যক্তিত্বের এ প্রশ্নের মুখে মহিউদ্দিন দারুণ ঘাবড়ে যায়। সে দুর্বল কণ্ঠে বঙ্গবন্ধুকে বন্দি করে নিয়ে যেতে চায়। ওই সময় মেজর বজলুল হুদা এসে ঔদ্ধত্যপূর্ণ স্বরে বঙ্গবন্ধুকে নিচে নেমে আসতে বলে। বঙ্গবন্ধু সিঁড়ির বারান্দার মুখে এসে দাঁড়ান। ঠিক তখনই মেজর নূর চৌধুরী সিঁড়ির গোড়ায় এসে উপস্থিত হলে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ পাল্টে যায়। একজন ঘাতক উচ্চকণ্ঠে চিৎকার করে ওঠে, ‘কেন সময় নষ্ট করা হচ্ছে’?

মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েও বঙ্গবন্ধু স্বাভাবিক কণ্ঠে প্রশ্ন করেন, ‘তোরা কী চাস? কোথায় নিয়ে যাবি আমাকে? কী করবি? বেয়াদবি করছস কেন?’ বলতে বলতে সিঁড়ির কয়েক ধাপ নামতেই নিচের দিক থেকে ৭ থেকে ৮ ফুট দূরে অবস্থানকারী দুই ঘৃণিত ঘাতক মেজর নূর চৌধুরী ও মেজর বজলুল হুদার স্টেনগান থেকে বেরিয়ে আসে ১৮টি তাজা বুলেট। সিঁড়ির ধাপে গড়িয়ে পড়েন বঙ্গবন্ধু। ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটে চলে সিঁড়ি বেয়ে।

সিঁড়ির ধাপেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন মুক্তিযুদ্ধের অবিসংবাদিত নেতা, স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান। সিঁড়ির ধাপেই পড়ে থাকে তার রক্তাপ্লুত মৃতদেহ। মৃত্যুর পরও বঙ্গবন্ধুর চেহারা ছিল সম্পূর্ণ স্বাভাবিক, সৌম্য ও শান্ত। বুকের অংশটুকু ছিল ভীষণভাবে রক্তাক্ত। বাঁ হাতটা ছিল বুকের ওপর ভাঁজ করা। বুলেটের আঘাতে তর্জনী ছিঁড়ে চামড়ার সঙ্গে ঝুলছিল। তার বুক ঝাঁঝরা হয়েছিল ব্রাশফায়ারে। পেট, পা এবং হাতসহ শরীরের বিভিন্ন অংশ ছিল গুলিবিদ্ধ। একটা গুলি বিদ্ধ হয় মাথার পেছনে। নয়টা গুলি চক্রাকারে বুকের নিচে লাগে। খুনিদের পৈশাচিক নির্মমতা-বর্বরতা ছিল চরম পর্যায়ের। মৃত্যু নিশ্চিত করার পরও তারা বঙ্গবন্ধুর দুই পায়ের গোড়ালির রগ কাটে। ওই সময় বঙ্গবন্ধুর পরনে ছিল সাদা গেঞ্জি, পাঞ্জাবি এবং সাদা-কালো চেক লুঙ্গি। পাঞ্জাবির পকেটে ছিল চশমাটি।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের দিনটি ছিল শুক্রবার। শ্রাবণের শেষ দিন। বাতাস ছিল ভেজা। ঘড়ির কাঁটা তখনও ভোর ৫টার ঘর স্পর্শ করেনি। মসজিদ থেকে ভেসে আসছিল ফজর নামাজের আজানের সুমধুর ধ্বনি। ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরের ৬৭৭ নম্বর বাড়িটির চারপাশে তখন ভোরের আলো। বাড়ির শীর্ষে বিউগলের সুরে জাতীয় পতাকা উত্তোলিত হচ্ছিল। তখনই ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড ঘটাতে বাড়িটি লক্ষ্য করে দক্ষিণ দিক থেকে আক্রমণ শুরু।

বঙ্গবন্ধু ভবন সৈন্য পরিবেষ্টিত হলে রমা তিনতলায় গিয়ে শেখ কামালকে ঘুম থেকে উঠিয়ে সেনা আক্রমণের খবর দেন। সুলতানা কামাল খুকু স্বামী শেখ কামালের পিছু নিয়ে দোতলা পর্যন্ত আসেন। শেখ কামালের রুম থেকে দোতলায় এসে রমা সেনা হামলার কথা শেখ জামালকে জানান। জামাল তার নবপরিণীতা স্ত্রী পারভীন জামাল রোজীকে সঙ্গে নিয়ে মায়ের রুমে আসেন।

শেখ কামাল ওপর থেকে নিচে নেমে বললেন, ‘আর্মি ও পুলিশ ভাই, আপনারা আমার সঙ্গে আসেন।’ তখন মেজর বজলুল হুদা তিন-চারজন কালো ও খাকি পোশাকধারী সশস্ত্র সেনাসদস্য পরিবেষ্টিত হয়ে শেখ কামালের পায়ে গুলি চালায়। শেখ কামাল নিজের পরিচয় দিলে তাকে সঙ্গে সঙ্গে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র দিয়ে ব্রাশফায়ারে হত্যা করা হয়। ক’জন সেনাসদস্য গুলি ছুড়তে ছুড়তে উপরে ওঠে।

ওই সময় বঙ্গবন্ধুর উচ্চ কণ্ঠস্বর ভেসে আসে। অতঃপর অসংখ্য গুলির শব্দ। দোতলায় নারীদের আহাজারি-আর্তচিৎকার। তারপর নেমে আসে সুনসান নীরবতা। বেগম মুজিব তখন কামালপত্নী, শেখ জামাল, জামালপত্নী, শেখ রাসেল, শেখ আবু নাসেরকে নিয়ে বাথরুমে। রমাই বঙ্গবন্ধুকে হত্যার কথা বেগম মুজিবকে জানান। এ সময় সেনাসদস্যরা দরজা ভাঙার চেষ্টা করলে বেগম মুজিব ‘মরলে সবাই একসঙ্গে মরব’ এ কথা বলে দরজা খোলেন।

লে. কর্নেল আজিজ পাশাসহ বিপথগামী সেনাসদস্যরা বেগম মুজিবসহ শেখ আবু নাসের, শেখ রাসেল ও রমাকে সিঁড়ি দিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। সিঁড়িতে বঙ্গবন্ধুর নিথর দেহ দেখে বেগম মুজিব কান্নায় ভেঙে পড়েন এবং চিৎকার দিয়ে বলেন, ‘আমি যাব না, আমাকে এখানেই মেরে ফেল।’ কিন্তু সৈন্যরা তাকে দোতলায় তার কক্ষে নিয়ে যায়। সেখানেই লে. কর্নেল আজিজ পাশা ও রিসালদার মোসলেহ উদ্দিনের গুলিতে শহীদ হন বেগম মুজিব।

এরপর ঘাতকের বুলেটের আঘাতে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেন শেখ জামাল, সুলতানা কামাল ও রোজী জামাল। বেগম মুজিবের নিথর দেহটি দরজার পাশে পড়ে থাকে। বাঁদিকে পড়ে থাকে শেখ জামালের মৃতদেহ। রোজী জামালের মুখে গুলি লাগে। রক্তক্ষরণে বিবর্ণ হয়ে যায় সুলতানা কামালের মুখ। এরপর সৈন্যরা শেখ আবু নাসের, শেখ রাসেল ও রমাকে নিচে নামিয়ে আনে।

শেখ আবু নাসের সৈন্যদের বলেন, ‘আমি তো রাজনীতি করি না। কোনো রকম ব্যবসা করে খাই।’ প্রহরারত এক সৈনিক বলে, ‘শেখ মুজিব ইজ বেটার দেন শেখ নাসের।’ এ সময় শেখ আবু নাসেরকে পাশের কক্ষে গিয়ে বসার মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে বলা হয়, তাকে কিছুই করা হবে না। অথচ তাকে বাথরুমে নিয়ে গুলি করে খুন করা হয়। মৃত্যুর আগে তিনি পানি চেয়েও পাননি।

এ সময় ওপর থেকে ভীত-বিহ্বল শিশু শেখ রাসেলকে নিয়ে আসে আরেকদল সেনাসদস্য। মুহিতুলকে জড়িয়ে ধরে ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে থাকা শিশু রাসেল জানতে চায়, ‘ভাইয়া, আমাকে মারবে না তো।’ তখনই এক সৈন্য শেখ রাসেলকে আলাদা করে ফেললে সে মায়ের কাছে যাওয়ার আকুতি জানায়। এক সৈন্য তাকে মায়ের কাছে নিয়ে যাওয়ার প্রবোধ দিয়ে দোতলায় নিয়ে যায়। সেখানে মায়ের রক্তমাখা মরদেহ দেখার পর অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে রাসেল মিনতি করে, ‘আমাকে হাসু (প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ডাক নাম) আপার কাছে পাঠিয়ে দাও।’ সৈন্যদের মন গলেনি। গুলিতে শহীদ হয় বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ পুত্র। গুলিতে তার চোখ বেরিয়ে যায়। মাথার পেছনের অংশ থেঁতলে থাকে। নিথর দেহটি পড়ে থাকে সুলতানা কামালের লাশের পাশে। শেখ রাসেল ছিল ঘাতকের শেষ শিকার।

শেখ রাসেল শহীদ হওয়ার পর উদ্ধত কণ্ঠে সৈন্যরা তাদের কর্মকর্তাদের খবর দেয়, ‘স্যার, সব শেষ।’ বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে ইতিহাসের নৃশংসতম ওই হত্যাকাণ্ডের পর জাতির পিতার স্বপ্নের বাংলাদেশে কারফিউ শুরু হয়। সামরিক আইন জারি করা হয়। গণতন্ত্র ও সংবিধান ভূলুণ্ঠিত হয়। এক সাগর রক্তে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের লাল টকটকে ও গাঢ় সবুজের মানচিত্র খামচে ধরে পুরনো শকুনেরা।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!