বাংলাদেশে বাকস্বাধীনতা নিয়ে নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদন

নিয়ম মেনে সবকিছু করার চেষ্টা করেছেন খ্যাতিমান চলচ্চিত্র নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। সিনেমার শুটিংয়ের আগে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের জন্য তিনি চিত্রনাট্য জমা দেন। দেশীয় শিল্পীদের পাশাপাশি বিশিষ্ট ভারতীয় ও ফিলিস্তিনি শিল্পীদেরও নেওয়ার অনুমতি পান তিনি।

বাংলাদেশে বাকস্বাধীনতা নিয়ে নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদন 1

‘শনিবার বিকেল’ নামের এই সিনেমায় ২০১৬ সালে রাজধানী ঢাকার হলি আর্টিজানে সন্ত্রাসী হামলার ওপরও একটি একক শট নেওয়া হয়। ওই হামলায় ২৪ জন নিহত হয়েছিলেন। বিদেশের উৎসবে অংশ নিয়ে পুরস্কার পেলেও নিজ দেশে চলচ্চিত্রটি মুক্তির অনুমতি দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ।

বাংলাদেশে বাকস্বাধীনতা নিয়ে নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদন 2

তিন বছর ধরে দেশের চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ড মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর আবেদন প্রত্যাখ্যান করে আসছে। বিশ্লেষক ও অ্যাক্টিভিস্টরা বলছে, সরকার কিভাবে বাকস্বাধীনতার জায়গাগুলোকে সংকুচিত করে ফেলছে— এ ঘটনা তারই একটি ইঙ্গিত।

সেন্সর বোর্ডে চলচ্চিত্রটি আটকে যাওয়া প্রসঙ্গে ফারুকী বলেন, ‘তারা আমাদের সুনির্দিষ্ট কোনও কারণ জানায়নি। তারা কেবল বলেছে, ছবিটি দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করতে পারে বা ধর্মীয় অস্থিরতা উসকে দিতে পারে।’

কর্মকর্তারা তাদের কর্মকাণ্ডকে ন্যায্যতা দিতে ইসলামি জঙ্গিবাদ থেকে উদ্ভূত বিশ্বাসযোগ্য হুমকির কথা উল্লেখ করেন। তারা বলছেন, এ ধরনের হুমকি দেশের অর্থনৈতিক সম্প্রসারণ ও দারিদ্র্য বিমোচনের প্রচেষ্টাকে লাইনচ্যুত করতে পারে।

বাংলাদেশে বাকস্বাধীনতা নিয়ে নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদন 3

শাসক দল আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন, তাদের বিরোধীরা চলচ্চিত্র নিয়ন্ত্রক সংস্থার নিয়ন্ত্রণ ও অন্যান্য কর্মকাণ্ডের সমালোচনার রাজনীতি করছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ সহকারী বিপ্লব বড়ুয়া বলেছেন, ‘যারা প্রচার করছে যে স্বাধীন মতপ্রকাশের সুযোগ রুদ্ধ করে দেওয়া হচ্ছে, তারা আসলে সরকারের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রচার চালাচ্ছে। সংবিধানে নিশ্চিত করা হয়েছে, এমন সব অধিকার সমুন্নত রাখতে চাই আমরা।’

বাংলাদেশে অবশ্য অনেকেই বলছেন, বাস্তবে এই অধিকারগুলো লঙ্ঘন করা হচ্ছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সরকার সাংবাদিক, অ্যাক্টিভিস্ট ও বিরোধী দলের সদস্যদের গ্রেফতারের জন্য ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে ভয়ের পরিবেশ তৈরি করেছে।

জাতিসংঘ ২০১৮ সালের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনকে ‘ত্রুটিপূর্ণ আইনের একটি উদাহরণ’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। এতে ‘অস্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত কাজের জন্য বিস্তৃত পরিসরে কঠোর শাস্তি’র কথা বলা হয়েছে।

ঢাকাভিত্তিক থিংক ট্যাংক সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজের তথ্য অনুযায়ী, শুধু গত দুই বছরে প্রায় ২ হাজার ২০০ জনকে এই আইনের অধীনে আটক করা হয়েছে।

গ্রেফতারের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের একজন ৫৩ বছর বয়সী লেখক মোশতাক আহমেদ। তিনি সরকারের কোভিড মোকাবিলা-সংক্রান্ত উদ্যোগের সমালোচনা করেছিলেন। ছয়বার জামিন আবেদন নাকচ হওয়ার পর কারাগারে তার মৃত্যু হয়।

ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের (ডিইউজে) সাধারণ সম্পাদক আক্তার হোসেন এই আইন সম্পর্কে বলেন, ‘এটি সেলফ সেন্সরশিপের পরিবেশ তৈরি করেছে। বাংলাদেশের প্রতিটি নিউজরুম ক্ষমতাসীন দল বা সরকারের জন্য সমালোচনামূলক স্টোরি করার আগে দুইবার চিন্তা করে।’

গত জুলাইয়ে পুলিশ সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপক পরিচিতি পাওয়া একজন অপেশাদার সংগীতশিল্পীকে গ্রেফতার করে, যিনি বিখ্যাত বাঙালি লেখকদের গান গেয়েছিলেন। কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, অনলাইনে হিরো আলম নামে পরিচিত গায়ক আশরাফুল আলম বিকৃত সুরে গান গেয়েছিলেন—এটি বাঙালি সংস্কৃতির অপমান।

উপপুলিশ হাফিজ আল আসাদ বলছেন, একটি লিখিত অঙ্গীকার করার পর হিরো আলমকে মুক্তি দেওয়া হয়। এতে তিনি বলেছেন, ‘বাংলাদেশের সংস্কৃতিকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করে এমন কোনও কিছু তিনি তৈরি বা প্রকাশ করবেন না। ব্যঙ্গাত্মক, মানহানিকর ও অবমাননাকর কিছু বানাবেন না।’

চলচ্চিত্র নির্মাতা এবং অন্য শিল্পীদের জন্য চ্যালেঞ্জ হচ্ছে এমন একটি পরিবেশ, যেখানে কর্তৃপক্ষ যে কোনও কিছুতে হুমকি এবং সাংস্কৃতিক ও জাতীয় মূল্যবোধ-বিরুদ্ধ উপাদান খুঁজে পেতে পারে।

কয়েক সপ্তাহ আগে চলচ্চিত্র পরিচালক এবং অন্য শিল্পীদের একটি দল দফায় দফায় আইনি লড়াই এবং সেন্সরশিপের খড়গের প্রতিবাদে একটি সংবাদ সম্মেলন করে। সেখানে একটি প্রতীকী বিবৃতি দেওয়ার জন্য নির্মিত কাঁটাতারের একটি প্রাচীরের আড়াল থেকে কথা বলতে গিয়ে তারা বলেন, বিধিনিষেধ অব্যাহত থাকলে তাদের পক্ষে স্টোরি বানানো সম্ভব নয়।

বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ—দুই জায়গাতেই জনপ্রিয় অভিনেত্রী জয়া আহসান। তিনি বলেন, ‘শিল্পের ওপর চাপ তৈরির প্রতিটি কাজ বন্ধ করা উচিত। শুধু চলচ্চিত্র নয়, সব ধরনের শিল্প উন্মুক্ত হওয়া উচিত। অন্যথায়, আমরা কীভাবে লিখতে পারি, অভিনয় করতে পারি বা এমনকি আমাদের ভাষায় কথা বলতে পারি?’

এই অভিনেত্রী বলেন, ‘সিনেমায় এটা দেখানো যাবে না, ওটা করা যাবে না- এত শর্ত নিয়ে সিনেমা নির্মাণ করা কি সম্ভব? এভাবে তো হয় না। এভাবে সিনেমা নির্মাণ করা যায় না। গল্প বলা যায় না। স্বাধীন বাংলাদেশে এত কালাকানুন কেন?’

‘হাওয়া’ নামের একটি চলচ্চিত্রের পরিচালকের বিরুদ্ধে খাঁচায় বন্দি পাখি দেখানোর জন্য সরকার মামলা করেছে। দেশের বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ কর্তৃপক্ষ এটিকে আপত্তিকর বলে মনে করেছে। পুলিশ অন্য একটি চলচ্চিত্র ‘নবাব এলএলবি’ নিয়েও আপত্তি জানিয়েছে। কেননা, এটিতে একটি বিষয় নিয়ে প্রশ্ন করার সময় একজন পুলিশ অফিসারকে অশ্লীল ভাষা ব্যবহার করতে দেখা গেছে।

বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ড সম্প্রতি সৈকত নাসির পরিচালিত আরেকটি চলচ্চিত্র ‘দ্য বর্ডার’কে সনদ দিতে অস্বীকার করেছে। এটিতে ভারতীয় সীমান্তের একটি বাংলাদেশি গ্রামকে চিত্রিত করা হয়েছে। এতে একজন ভারতীয় নায়ককে একটি কিলিং মিশন এবং অন্যান্য অপরাধে অংশ নিতে দেখা যায়।

বোর্ড বলেছে, ভারতের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করে এমন কোনও চলচ্চিত্রের অনুমতি দেওয়া যাবে না। তবে এমন একটি কারণও উল্লেখ করা হয়েছে, যেটিতে ফিকশনাল কাজের ক্ষেত্রে বিভ্রান্তি বা ভুল-বোঝাবুঝির অবকাশ থাকে।

বোর্ডের পরিচালক স্থানীয় সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, ‘চলচ্চিত্রে দেশের সাতক্ষীরা অঞ্চলের একজন গডফাদারকে দেখানো হয়েছে, যার কাছে মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যরা জিম্মি। কিন্তু বাংলাদেশে এমন কোনও পরিস্থিতি নেই।’

‘হাওয়া’র পরিচালক মেজবাউর রহমান সুমন বলেন, যে পরিবেশে ‘যেকোনও কিছু যে কারও অনুভূতিতে আঘাত দিতে পারে’, সেই পরিবেশে ভালো শিল্প তৈরি করা অসম্ভব হয়ে পড়েছে।

তার চলচ্চিত্রে সরকারের আপত্তির কেন্দ্রে থাকা প্রাণীটি সম্পর্কে সুমন বলেন, ‘পাখিটিকে কিছুক্ষণ খাঁচায় বন্দি রেখে ছেড়ে দেওয়া হয়’, চলচ্চিত্র নিয়ে সরকারের আপত্তির কেন্দ্র হচ্ছে সেই জায়গাটি। তিনি আরও বলেন, ‘পাখিটিকে মুক্ত করার পর, আমার এখন মনে হচ্ছে আমি নিজেকে খাঁচায় বন্দি করেছি।’

‘শনিবার বিকেল’-এর পরিচালক ফারুকী বাংলাদেশের দর্শকদের কাছে ছবিটি মুক্তি দেওয়ার তিন বছরের লড়াইয়ের সবচেয়ে কঠিন অংশটি ছিল, তার সিনেমায় ঠিক কোন বিষয়টি আপত্তিজনক, সেটি খুঁজে বের করা।

সন্ত্রাসীদের জিম্মি করার সময় মানুষের সংগ্রামের উত্তেজনাপূর্ণ মুহূর্তগুলোকে চিত্রিত করা এই চলচ্চিত্রটি স্পষ্টতই সন্ত্রাসীদের ভণ্ডামিকে উন্মোচন করে।

হামলায় আটকে পড়া বেশ কিছু চরিত্র সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো সাধারণ নাগরিক। একজন হিজাব পরিহিত নারী অশ্রু সংবরণ করে অন্য নারীদের রক্ষার জন্য পাল্টা লড়াই করেন, যাদের আক্রমণকারীরা অপমান বা তাচ্ছিল্য করছিল। এই নারীদের মধ্যে তার নিজের মা-ও ছিলেন। সেখানে ছিঁড়ে যাওয়া জিনস ও সোয়েটার পরা এক তরুণীকে ধার্মিকতার পরীক্ষায় ব্যর্থ হওয়ার জন্য গুলি করে হত্যা করা হয়।

সেন্সর বোর্ডের সদস্য মুশফিকুর রহমান গুলজার জানান, ছবিটি নিয়ে তার কোনও আপত্তি নেই। আর বোর্ডের ভাইস চেয়ারম্যান মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বলেন, ছবিটিকে সনদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নির্ভর করছে তথ্য মন্ত্রণালয়ের ওপর।

এ বিষয়ে সম্প্রতি স্থানীয় গণমাধ্যমে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেছেন, পরিচালক সেন্সর বোর্ডের পরামর্শ মেনে চললে মন্ত্রণালয় ছবিটির সনদ দেবে।

তবে ফারুকী বলেন, তিনি বোর্ডের কাছ থেকে সুনির্দিষ্ট কোনও পরামর্শ পাননি।

মন্ত্রী অবশ্য সাক্ষাৎকারে আরেকটি বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন। সেটি হচ্ছে, চলচ্চিত্রটিতে হলি আর্টিজানের হামলায় নিহত দুই পুলিশ কর্মকর্তার আত্মত্যাগ দেখানো হয়নি।

আর ফারুকী বলেন, ‘আমার চলচ্চিত্রটি হামলার তথ্যচিত্র নয়। এটি একটি ফিকশনাল ফিচার, যেখানে কোনও বাস্তব চরিত্রের অস্তিত্ব নেই।’ তার ভাষায়, ‘এমনকি যদি আমার সত্যিকারের চরিত্রগুলোকে চিত্রিত করার অভিপ্রায় থাকতো তাহলেও কি তারা একটি গল্পের নির্দেশনা দিতে পারে?’

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!