বাংলাদেশের আশায় শুরু হতাশায় শেষের বিশ্বকাপ

শেষ ম্যাচে পাকিস্তানের কাছে হারলো ৯৪ রানের ব্যবধানে

বাংলাদেশের ইতিহাসের সেরা দল নিয়ে ক্রিকেট বিশ্বকাপে অংশ নিতে ইংল্যান্ড পাড়ি জমিয়েছিল। এ নিয়ে কারও দ্বিমত ছিল না। প্রথম পাঁচ বিশ্বকাপের সেরা অভিজ্ঞ দল, সম্ভাব্য সেরা ব্যাটিং লাইনআপ নিয়ে বিশ্বকাপে গিয়েছিল বাংলাদেশ। তাই আশা নয়, বলা চলে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের প্রাথমিক লক্ষ্যই ছিলো বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল খেলা। কিন্তু গত মঙ্গলবার ভারতের কাছে হেরে শেষ হয়ে যায় সে সম্ভাবনা। সেমির স্বপ্ন ভঙ্গ হওয়ার পর আশা ছিলো পাকিস্তানের বিপক্ষে জিতে অন্তত বিশ্বকাপের সমাপ্তিটা ইতিবাচকভাবে করা।

কিন্তু কিসের কি! ক্রিকেটের মক্কাখ্যাত ঐতিহাসিক লর্ডসে পাকিস্তানের কাছে যেন পাত্তাই পেল না মাশরাফি বিন মর্তুজার দল। পারলো না বিশ্বকাপের শেষটা মনের মতো করতে। হতাশাজনক বোলিং-ফিল্ডিংয়ের পর ব্যাটিংটাও আশানুরূপ না হওয়ায়, শেষ ম্যাচের ফলটাও এসেছে নেতিবাচক।

১০ দলের বিশ্বকাপে সপ্তম হয়েই বিশ্বকাপ শেষ করছে বাংলাদেশ। শনিবার দক্ষিণ আফ্রিকা নিজেদের শেষ ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে জয় পেলেই অষ্টম হয়ে যাবে বাংলাদেশ।

বাংলাদেশের আশায় শুরু হতাশায় শেষের বিশ্বকাপ 1
বাংলাদেশের এই আনন্দ খুব বেশি ম্যাচে স্থায়ী হয়নি। তাই এবারের বিশ্বকাপও হতাশা দিয়ে শেষ হলো।

তিন দিন আগেও সেমিফাইনালের আশা দেখছিল বাংলাদেশ। অনেক ‘যদি-কিন্তু’ ছিল, তবুও স্বপ্ন তো ছিল। কিন্তু ভারতের বিপক্ষে হেরে সে আশা জলাঞ্জলি দিয়েছে দল, আর শুক্রবার পাকিস্তানের কাছে নতজানু হয়ে বিশ্বকাপ থেকেই বিদায় নিয়েছে। যে দলকে বাংলাদেশের ইতিহাসের সেরা দল বলে ভাবা হচ্ছিল, তারা বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে উঠতে পারেনি। ইংলিশ কন্ডিশনে কাজটা কঠিন ছিল, কিন্তু বিশ্বকাপে নিজেদের আগের সাফল্যকে তো টপকানো যেত। সেটাও হয়নি। ৯ ম্যাচ থেকে ৩ জয় পেয়েছে বাংলাদেশ। সেই ২০০৭ বিশ্বকাপ থেকেই তো এমন কিছু করছে বাংলাদেশ!

এ ম্যাচ থেকে পাওয়ার কিছু ছিল না, শুধু মর্যাদা ছাড়া। সে ম্যাচে বাংলাদেশের বোলিং ও ফিল্ডিং ছিল দৃষ্টিকটু। এমন অপ্রত্যাশিত সহযোগিতা পেয়ে পাকিস্তানের ব্যাটসম্যানরাও ফায়দা তুলেছেন। ৩১৬ রানের বিশাল লক্ষ্য ছুড়ে দিয়েছেন। তাড়া করতে নেমে বাংলাদেশ পথ হারিয়েছে শুরুতেই। দ্বিতীয় ওভারে জীবন পাওয়া সৌম্য ফিরে গেছেন ষষ্ঠ ওভারে। পুরো বিশ্বকাপে কোনো ফিফটি না পাওয়া সৌম্য আজও তাঁর ধারাবাহিকতা ধরে রেখেছেন। তাঁর ওপেনিং সঙ্গীও দেরি করেননি। দুঃস্বপ্নের এক বিশ্বকাপ কাটানো তামিম ফিরেছেন ১১তম ওভারে। ২১ বলে ৮ রানের আরেকটি প্রশ্নবিদ্ধ ইনিংস খেলেছেন। বিশ্বকাপে ইনিংস গড়ার কাজটা তামিমের আর করে দেখানো হলো না এবার।

বাংলাদেশের আশায় শুরু হতাশায় শেষের বিশ্বকাপ 2
বিশ্বকাপে এবারের আসরের প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে ৬০০ রানের মাইলফলকে নাম লেখালেন সাকিব আল হাসান

তিনে নেমে মুশফিকও খুব বেশিক্ষণ টিকেননি, ১৬ করেই দায়িত্ব শেষ বলে ধরে নিয়েছেন। একমাত্র ব্যতিক্রম ছিলেন সাকিব আল হাসান। আজও ফিফটি পেরিয়েছেন। এতেই শচীন টেন্ডুলকারের পর মাত্র দ্বিতীয় খেলোয়াড় হিসেবে এক বিশ্বকাপে সাতটি ইনিংসে পঞ্চাশোর্ধ্ব ইনিংস খেলার রেকর্ড গড়েছেন। শচীনের কীর্তি ছিল ১১ ম্যাচে, আর সাকিব সেটা করেছেন মাত্র ৮ ম্যাচে। এর মাঝেই মাত্র তৃতীয় ক্রিকেটার হিসেবে এক বিশ্বকাপে ৬০০ রান তুলেছেন সাকিব।

মাঝে লিটন দাস (৩২) এসে সাকিবকে কিছু সঙ্গ দিয়েছেন। দুজনের ৫৮ রানের জুটির সময়ই যা একটু ম্যাচে সমতা ছিল। কিন্তু ২৯তম ওভারে সেটাও থামল। সেটাই যে ইনিংসের সবচেয়ে বড় জুটি হবে সেটা তখনো ভাবা যায়নি। ৬৪ রান করে সাকিব ফেরার পর বাংলাদেশের ইনিংসের গল্পটা খুব সাধারণ। ব্যাটসম্যানরা এসেছেন, সময় কাটানোর ব্যর্থ চেষ্টা করেছেন এবং একটু পরেই ফিরে গেছেন। মাহমুদউল্লাহর ২৯, কিংবা মোসাদ্দেকের ১৬ রান হারের ব্যবধান খুব একটা কমাতেও পারেনি। এর মাঝেই সবচেয়ে কম বয়সে বিশ্বকাপে ৫ উইকেট প্রাপ্তি হয়ে গেছে শাহিন আফ্রিদির। বিশ্বকাপে নিজের শেষ ইনিংসে কিছু ছকা মেরে আনন্দ দিয়েছেন মাশরাফি (১৫)। কিন্তু পাকিস্তানের বিপক্ষে এত বিশাল ব্যবধানে (৯৪ রানের হার) হারের দুঃখ কি আর তাতে ঢাকে?

বাংলাদেশের আশায় শুরু হতাশায় শেষের বিশ্বকাপ 3
শাহীন শাহ আফ্রিদি সবচেয়ে কম বয়সে পাঁচ উইকেট শিকার করে বাংলাদেশকে হতাশায় ভাসান।

তবে এত বড় জয়ের পরেও সেমিফাইনালে খেলার আশা পূরণ হচ্ছে না পাকিস্তানের। কেননা ৯ ম্যাচ শেষে তাদের পয়েন্ট নিউজিল্যান্ডের সমান ১১ হলেও, নেট রানরেটে এগিয়ে থাকার সুবাদে চতুর্থ দল হিসেবে শেষ চারের টিকিট পেয়েছে কিউইরাই। সেমিফাইনালে তাদের খেলতে হবে টেবিলের শীর্ষে থাকা দলের বিপক্ষে।

এর আগে মোস্তাফিজুর রহমানের শেষ সময়ের বোলিং ঝলকের পরও ৯ উইকেটে ৩১৫ রানের চ্যালেঞ্জিং পুঁজি পেয়ে যায় পাকিস্তান। সেঞ্চুরি করেন দলটির ওপেনার ইমাম উল হক। টস জিতে ব্যাটিংয়ে নেমে পাকিস্তানের শুরুটা তেমন ভালো হয়নি। বাংলাদেশি বোলারদের নিয়ন্ত্রিত বোলিংয়ে বেশ অস্বস্তিতেই ছিল তারা। স্পিনার মেহেদি হাসান মিরাজকে দিয়ে বোলিং উদ্বোধন করান টাইগার অধিনায়ক মাশরাফি।

বাংলাদেশের আশায় শুরু হতাশায় শেষের বিশ্বকাপ 4
বিশ্বকাপে টানা দ্বিতীয় ম্যাচে পাঁচ উইকেটের দেখা পেলেন কাটার মাস্টার মোস্তাফিজুর রহমান। বিশ্বকাপে ২০ উইকেট শিকার করে রয়েছেন তালিকায় দুই নম্বরে।

প্রথম ওভার থেকে মাত্র ১ রান দেন মিরাজ। ৭ ওভারে আসে মাত্র ২৩ রান। ইনিংসের অষ্টম ওভারে নিজের চতুর্থ ওভার করতে এসে দ্বিতীয় বলেই পাকিস্তানের উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান ফাখর জামানকে মিরাজের ক্যাচ বানান সাইফউদ্দীন। কিন্তু এরপর দ্বিতীয় উইকেটে বড় জুটি গড়ে তুলেন ইমাম উল হক আর বাবর আজম। ১৫৭ রানের এই জুটিটি ভাঙেন সেই সাইফউদ্দীনই। সেঞ্চুরির দোরগোড়ায় পৌঁছে যাওয়া বাবর আজমকে এলবিডব্লিউয়ের ফাঁদে ফেলেন টাইগার পেসার। ৯৮ বলে ১১ বাউন্ডডারিতে বাবর তখন ৯৬ রানে।

তবে ১৮০ রানে ২ উইকেট হারানোর পর আরও একটি জুটি পায় পাকিস্তান। তৃতীয় উইকেটে ইমাম আর মোহাম্মদ হাফিজ তুলেন ৬৬ রান। এই জুটি ভাঙার পরই বেশ কয়েকটি উইকেট তুলে নিয়েছে টাইগাররা। ইমাম উল হক সবেমাত্র সেঞ্চুরিটা তুলেছেন। এক বল পরই মোস্তাফিজের দুর্দান্ত এক ডেলিভারি ব্যাকফুটে খেলতে গিয়ে হিটউইকেট হন পাকিস্তানি ওপেনার। ১০০ বল মোকাবিলায় গড়া তার কাটায় কাটায় ১০০ রানের ইনিংসটিতে ছিল ৭টি বাউন্ডারির মার।

পরের ওভারে এসে মেহেদী মিরাজ তুলে নেন আরেক সেট ব্যাটসম্যান হাফিজকে (২৭)। সুইপ করতে গিয়ে ডিপ ব্যাকওয়ার্ড স্কয়ারে সাকিবের সহজ ক্যাচ হন তিনি। ১০০তম ওয়ানডে উইকেট হাত দিয়ে ডাকছিল মোস্তাফিজকে। খুব বেশি দেরি করেননি কাটার মাস্টার। আগের ওভারে ইমামকে ফিরিয়েছেন, পরের ওভারে হারিস সোহেলকে (৬) সৌম্য সরকারের ক্যাচ বানিয়ে মাইলফলক স্পর্শ করেন মোস্তাফিজ।

বাংলাদেশের আশায় শুরু হতাশায় শেষের বিশ্বকাপ 5
বাবর আজম শতক থেকে ৪ রান দূরে থাকতে আউট হলেও শতক তুলে নেন ইমাম-উল-হক।

এর মধ্যে আবার সাউফউদ্দীনের ইয়র্কারে রিটায়ার্ড হার্ট হয়ে মাঠ ছাড়েন পাকিস্তানি অধিনায়ক সরফরাজ আহমেদ (২)। ওয়াহাব রিয়াজকেও (২) ফেরান এই পেসারই, দুর্দান্ত এক ইয়র্কারে বোল্ড করে। তবে ইমাদ ওয়াসিম একটা প্রান্ত ধরে মেরে খেলছিলেন।

৪৮তম ওভারের প্রথম বলেই অসাধারণ ক্যাচ ধরেন মোস্তাফিজ। টাইগার পেসারকে সোজা ব্যাটে খেলতে গিয়েছিলেন শাদাব খান। এক হাতে দুর্দান্ত এক ফিরতি ক্যাচ নিয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন মোস্তাফিজ। তবে পাকিস্তানের কাজের কাজটা করে দিয়েছেন ইমাদ ওয়াসিম। ২৬ বলে ৬ চার আর ১ ছক্কায় ৪৩ রানের এক ঝড় তুলে ইনিংসের শেষ ওভারে মোস্তাফিজের শিকার হন তিনি।

এই মোস্তাফিজই ইনিংস শেষে টাইগারদের সেরা বোলার। ৭৫ রান খরচ করলেও তার নামের পাশে ৫টি উইকেট। ৩টি উইকেট নিয়েছেন মোহাম্মদ সাইফউদ্দীন।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!