বাঁশখালীতে ৭ বছরে ১৭ হাতির মৃত্যু, নামমাত্র ময়নাতদন্তে মৃত্যুরহস্য বের হয় না

পাহাড় ধ্বংস করে বনকর্তার ‘অনুমতিতে’ ইটভাটা

চট্টগ্রামের বাঁশখালীর পাহাড়ে একের পর এক হাতির মৃত্যু ঘটছে। পাহাড়ি এলাকায় বন উজাড় ও খাদ্য সংকটের কারণে হাতির দল লোকালয়ে নেমে আসছে। অনেক সময় নষ্ট করছে ফসলি জমির ধান। ক্ষতির হাত থেকে বাঁচতে স্থানীয়রা বৈদ্যুতিক সংযোগ দিয়ে ফাঁদ পেতে রাখেন মাঠে। এতে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়েও মারা যাচ্ছে হাতি। আবার দাঁত চুরি করতেও হত্যা করা হচ্ছে হাতি।

রোববার (১৭ এপ্রিল) বাঁশখালীর কালীপুর ইউনিয়নের জঙ্গল কালীপুর গভীর জঙ্গলে আবারও পাওয়া গেছে মৃত হাতি শাবক। এই শাবকটি এক সপ্তাহ আগে মারা গেলেও বন বিভাগের প্রহরী এবং বিট কর্মকর্তার কেউ জানেন না। শাবকটি উদ্ধারের পর বনবিভাগ ও উপজেলা প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর ময়নাতদন্তের জন্য সুরতহাল সংগ্রহ করে ওই পাহাড়ে মাটিচাপা দেয়।

এর আগে গত বছরের ৩০ নভেম্বর বাঁশখালীর সাধনপুর ইউনিয়নের লটমনি পাহাড়ে দুস্কৃতকারীরা একটি হাতিকে মেরে মাটিচাপা দিয়েছিল। ওই ঘটনায় মামলা হওয়ার পাঁচ মাস পর আবারও হাতির মৃত্যু ঘটলো বাঁশখালীতে। এর আগে ১২ নভেম্বর বাঁশখালীর চাম্বল বনবিট অফিসের অদূরে আরও ১টি হাতি মৃত অবস্থায় উদ্ধার হয়।

বনবিভাগের তথ্যমতে, বাংলাদেশে ২০০৪ সাল থেকে ২০২১ সালের নভেম্বর পর্যন্ত ১১৮টি হাতি মানুষের হাতে মারা গেছে। এছাড়া চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে ২০১৪ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত গত ৭ বছরে বাঁশখালীর বনাঞ্চলে মারা গেছে ১৭টি হাতি। এরমধ্যে কালীপুর রেঞ্জে মারা গেছে ১১টি এবং জলদী ও পুঁইছড়ি রেঞ্জে ৬টি। এছাড়া অসুস্থ ৩টি হাতিকে সুস্থ করে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে বনাঞ্চলে।

বনবিভাগের কালীপুর রেঞ্জের রেঞ্জ কর্মকর্তা আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘জঙ্গল কালীপুরের পাহাড়ে উদ্ধার হওয়া মৃত হাতির শাবকটি ময়নাতদন্ত শেষে মাটিচাপা দেওয়া হয়েছে। হাতি শাবকটি কখন মারা গিয়েছে কোনো বনবিট কর্মকর্তা নিশ্চিত নন। তবে ময়নাতদন্তকারী ডাক্তাররা জানিয়েছেন, কমপক্ষে সাতদিন আগে হাতি শাবকটি মারা গেছে।’

বাঁশখালী উপজেলা সহকারী প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তা অজিন চক্রবর্তী বলেন, ‘গভীর জঙ্গলে মৃত হাতি শাবকটি পাওয়ার পর ময়নাতদন্তের জন্য সুরতহাল সংগ্রহ করেছি। ধারণা করা হচ্ছে পাহাড়ের ঢালু থেকে পড়ে শাবকটি মারা গেছে। শরীরে পচন ধরেছে। আনুমানিক ৭দিন আগে মারা গেছে হাতিটি।’

পাহাড় ধ্বংস করে ইটভাটা

বাঁশখালীর কালীপুর রেঞ্জের ২ হাজার ৭৭ দশমিক ১৭ একর সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ভেতর গড়ে উঠেছে ৬টি ইটভাটা। বনাঞ্চল ঘেঁষে কালীপুর রেঞ্জে লটমনি পাহাড়ের ভেতর বাঁশখালী-সাতকানিয়া অংশে গড়ে উঠেছে ইটভাটাগুলো। এইসব ইটভাটা উচ্ছেদে বন কর্মকর্তাদের কোনো পদক্ষেপ নেই। এমনকি ইটভাটা স্থাপনে বনবিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ‘অনুমতিও’ দিয়েছেন বলে জানা গেছে। ফলে হাতির দল খাদ্যের সন্ধানে লোকালয়ের ও ফসলি মাঠে হানা দিচ্ছে।

গত ৭ এপ্রিল চট্টগ্রাম ভারপ্রাপ্ত এডিশনাল চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে এক ইটভাটার মালিকের বিরুদ্ধে মামলার প্রতিবেদন দাখিল করেছেন চট্টগ্রাম বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (দক্ষিণ) মো. সফিকুল ইসলাম।

কিন্তু সেই প্রতিবেদনে বলা হয়, ইটভাটা থেকে দুই কিলোমিটার দূরত্বে কোনো পাহাড় নেই।

অথচ পাহাড়ঘেঁষে স্থাপন করা হয়েছে ইটভাটাগুলো। এসব অবৈধ ইটভাটা উচ্ছেদে হাইকোর্টের কয়েক দফা নির্দেশনা থাকলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ উচ্ছেদ অভিযান চালায় দায়সারাভাবে।

চট্টগ্রাম বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (দক্ষিণ) মো. সফিকুল ইসলাম বলেন, ‘লটমনি পাহাড়ের কোনো ইটভাটার মালিককে এ ধরনের প্রতিবেদন দিয়েছি কিনা তা আমার জানা নেই। বিষয়টি খতিয়ে দেখবো।’

ময়নাতদন্তে পর্যাপ্ত সরঞ্জামের অভাব

হাতি মারা যাওয়ার পর মৃতদেহটি ময়নাতদন্ত করে মারা যাওয়ার কারণ উদঘাটন করেন ভেটেরিনারি ডাক্তাররা। কিন্তু এই ময়নাতদন্ত করতে যেসব রাসায়নিক ও সরঞ্জাম লাগে তা পর্যাপ্ত নেই। ফলে অনেকে হাতি হত্যা করলেও পার পেয়ে যান সঠিক ময়নাতদন্ত রিপোর্টের অভাবে।

বাঁশখালী উপজেলা প্রাণীসম্পদ কর্মকর্তা ডা. সমরঞ্জন বড়ুয়া বলেন, ‘হাতি জাতীয় সম্পদ। অনেক মৃত হাতির ময়নাতদন্ত করেছি। প্রকৃতভাবে এভাবে ময়নাতদন্তে কিছুতেই হাতি মৃত্যুর রহস্য বের হবে না। হাতির ময়নাতদন্ত আমরা শুধুমাত্র চোখে দেখা পর্যবেক্ষণের ওপর দিই। আমি ব্যক্তিগতভাবে আমার সিনিয়র বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের কাছ থেকেও পরামর্শ নিই। তাতেই আমিও সন্তুষ্ট নই। হাতির মৃত্যু রহস্য বের করতে বনবিভাগকে শক্তিশালী পদক্ষেপ নিতে হবে।’

হাতি মারা যাবার পর প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পরীক্ষা করার মতো যন্ত্র, সরঞ্জাম ও রাসানিক উপকরণ থাকতে হবে। দায়সারা পরীক্ষা হয় বলে হাতি মৃত্যুর রহস্য বের হচ্ছে না। এভাবে চললে ভবিষ্যতে সংরক্ষিত বনাঞ্চল হাতি শূন্য হয়ে পড়বে বলে জানান এই প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা।

ডিজে

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!