বাঁকখালী নদী ভরাট করে আবাসন প্রকল্প তৈরির প্রস্তুতি!

বালুর বস্তা ফেলা, নদীর বালু দিয়ে নদী ভরাট করা এবং মূল বাঁধের নিচে নদীর গতিপথ পরিবর্তনের ছোট স্পার বাধ নির্মাণ কেন করা হয়েছে, এমন প্রশ্নের উত্তরে আতিকুল ইসলাম নামে এক প্রভাবশালী ঠিকাদার বলেন, এসব নিয়ে নিউজ করে কী লাভ? সন্ধ্যায় ফোন দিয়েন। দেখা করে কিছু খরচাপাতি দেবো।

কক্সবাজার শহরের কস্তুরাঘাট এলাকায় চলছে সেতু নির্মাণের কাজ। অন্যদিকে নানা কৌশলে বাঁকখালী নদী গিলে খাচ্ছে অবৈধ দখলবাজ চক্র।

নির্মাণাধীন সেতুর পূর্ব পাশে নদী ভরাটের প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে উত্তোলন করা বালি দিয়ে ইতিমধ্যে ভরাট করা হয়েছে নদী ও নদী তীরের বিশাল এলাকা। নদীর গতিপথ পরিবর্তনের জন্য দেওয়া হয়েছে বাঁধ। আগেই নিধন করা হয়েছে নদী তীরের বিশাল আয়তনের প্যারাবন।

coxsbazar-bakkhali-river

সরেজমিনে গিয়ে এলাকাবাসীর সাথে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। ভূমিদস্যুরা নদীর তীর দখল করে নানা স্থাপনা নির্মাণ করলেও প্রশাসন কিছু করতে পারছেনা। এতে পরিবেশ বিপন্নের পাশাপাশি নদীর মাছ ও জীব-বৈচিত্র্য ধ্বংস হচ্ছে।

এলাকাবাসী জানান, আতিকুল ইসলাম নামে একজন প্রভাবশালী ঠিকাদার কস্তুরাঘাট এলাকার দখলযজ্ঞে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তিনি একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মালিক। বর্তমানে আতিকুল ইসলামের দখলে রয়েছে নদী তীরের একশ’ একরেরও বেশি জায়গা। তার নিয়োগ করা শ্রমিকরা প্রতিনিয়ত নতুন করে নদীর তীর ভরাটের কাজ করছেন। ইতিমধ্যে দখল হয়েছে বিশাল আয়তনের তীরভূমি। মূলত নদী ড্রেজিংয়ের সাথে জড়িত লোকজনের সাথে আঁতাত করে চালাচ্ছে এ দখল প্রক্রিয়া। নদী থেকে তোলা বালি দিয়েই ভরাটের কাজ চলছে।

বাঁকখালী নদী ভরাট করে আবাসন প্রকল্প তৈরির প্রস্তুতি! 1সরেজমিনে দেখা যায়, কস্তুরাঘাট এলাকায় বাঁকখালী নদীর পানিতে শত শত বালির বস্তা ফেলে বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। একপাশে স্কেভেটরের মাধ্যমে বালু ফেলে মাটি সমতল করার কাজ চলছে। অন্যপাশে বাঁধ টেকসই করতে কাজ করছেন শ্রমিকরা। বাঁধের নিচের অংশে নদীতে বড় বড় খুঁটি গেড়ে পাঁচটি স্পার বাঁধ তৈরি করা হয়েছে। পুঁতে দেয়া হয়েছে লাল পতাকা। প্যারাবনের ডালপালা কেটে এনে তা বাঁধের কিনারে বালির বস্তার উপর রাখা হচ্ছে। প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে প্যারাবন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে মাটি ভরাটের কাজে নিয়োজিত এক শ্রমিক বলেন, নদী থেকে উত্তোলন করা বালি দিয়ে বিশাল এলাকা ভরাট করা হয়েছে। বাঁধ নির্মাণের পর বাঁধের পাশে আরও পাঁচটি ছোট স্পার বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে নদীর স্রোতের গতিপথ পরিবর্তন করা হচ্ছে। এতে বাঁধের নিচে নদীর তলদেশে পলি জমবে। বাঁধের উপর স্রোতের আঘাত আসবেনা। ক্রমে নদীর ওই অংশটুকুও ভরাট হয়ে যাবে। বাঁধ ভরাট ও স্কেভেটর দিয়ে নদী তীর সমতলের কাজ দেখভাল করছিলেন মোকতার আহমেদ নামে একজন। তিনি আতিকুল ইসলামের বিশ্বস্ত লোক বলে পরিচিত।

বাঁকখালী নদী ভরাট করে আবাসন প্রকল্প তৈরির প্রস্তুতি! 2মোকতার আহমেদ বলেন, এখানে কেউ নদী দখল করছেনা। নদীর তীর রক্ষণাবেক্ষণ করা হচ্ছে। এই পুরো জায়গাটার মালিক আতিকুল ইসলাম। এখানে তার একশ’ একরের বেশি জমি রয়েছে। এখানে মসজিদ, মাদ্রাসা, স্কুল প্রতিষ্ঠা করা হবে।

বালুর বস্তা ফেলা, নদীর বালু দিয়ে নদী ভরাট করা এবং মূল বাঁধের নিচে নদীর গতিপথ পরিবর্তনের ছোট স্পার বাধ নির্মাণ কেন করা হয়েছে, এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, এসব নিয়ে নিউজ করে কী লাভ? সন্ধ্যায় ফোন দিয়েন। দেখা করে কিছু খরচাপাতি দেবো।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে আতিকুল ইসলাম বলেন, নির্মাণাধীন সেতুর পূর্ব পাশে আমার প্রায় ১০০ একর জমি রয়েছে। এখানে সেতুর জন্য নদী ড্রেজিং করায় আমার লাভ হয়েছে। সেই বালু দিয়ে জায়গাগুলো সমতল করতে পারছি। তিনি আরও বলেন আমি নদী ভরাট করছিনা। বাঁধ রক্ষণাবেক্ষন করছি। ভরাট করা হচ্ছে আমার মালিকানাধীন জমি। নদী গর্ভেও আমার কিছু জমি রয়েছে। এসব জমি পড়েছে খুরুশকুল মৌজায়। তিনি আরও বলেন, সেতু নির্মাণের দায়িত্বপ্রাপ্ত ঠিকাদারি সংস্থা আমার কাছ থেকে কিছু দিনের জন্য জমি লিজ নিয়ে এখানে কাজ করছে। তারা সেতু নির্মাণের জন্য আরও যন্ত্রপাতি আনবে। ওইসব যন্ত্রপাতি ও গাড়ি রাখার জন্যই আমার মালিকানাধীন জমির কিছু অংশ ভরাট করা হচ্ছে।

কক্সবাজারে বাঁকখালী নদী ড্রেজিংয়ের দায়িত্বে থাকা নুরুল ইসলাম বলেন, এখানে কেউ নদী ভরাট করছে না। আমরাও কাউকে নদী ভরাটে সহযোগিতা করছিনা। আতিকুল ইসলাম নিজের জমি নিজেই ভরাট করছেন। ড্রেজিংয়ের বালিগুলো দিয়ে তীরের জায়গা সমতল করা হচ্ছে। যাতে সেতুর নির্মান কাজের জন্য আনা গাড়ি ও যন্ত্রপাতি রাখা যায়।

সেভ দ্য নেচার অব বাংলাদেশ এর চেয়ারম্যান মোয়াজ্জেম হোসেন রিয়াদ বলেন, বাঁকখালী নদীর সীমানা চিহ্নিত করা হয়েছে কয়েক বছর আগে। অথচ চিহ্নিত সীমানার মধ্যে প্রকাশ্য দিবালোকে ড্রেজিং এর নামে নদীর জমিতে ভ‚মিদস্যুতা চলছে প্রতিনিয়ত। নদী থেকে বালি তুলে নদী ভরাট করে নদীর মোহনায় জমিতে আবাসন প্রকল্প করার প্রস্তুতি চলছে। বাঁকখালী নদীর উপরে ৫৯৫ মিটারের দ্বিতীয় বক্স গার্ডার সেতুর বদলে সড়ক নির্মাণ করার পরিবেশ গড়ে তোলা হয়েছে ইতিমধ্যে। ফলে আগামী বর্ষা মৌসুমে রামুসহ কক্সবাজারের বিশাল এলাকা বন্যায় তলিয়ে যাবার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। নদীর যেসব অংশে অবশ্যই ড্রেজিং প্রয়োজন নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ নিশ্চিত করার জন্য তা না করে, ভূমি মালিক ও দখলদারদের সাথে আঁতাত করে নদীর অপ্রয়োজনীয় অংশে বালি উত্তোলন হচ্ছে নির্বিচারে।

তিনি আরও বলেন, ইতিমধ্যে নদীর দুই তীর দখল করে গড়ে উঠেছে চিংড়ি ঘের, লবণ মাঠ, পোলট্রি খামার, চাল ও ময়দার মিল, ঘরবাড়ি-দোকানপাটসহ কয়েকশ’ স্থাপনা।

সম্প্রতি বাঁকখালী নদীর উপর একটি বক্স গার্ডার সেতু নির্মানের প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর দখল প্রক্রিয়া বেড়েছে দ্বিগুণ। এতে ক্রমশ সংকুচিত হয়ে আসছে নদী। প্রতিনিয়তই চলছে দখল প্রক্রিয়া। কক্সবাজারে দুর্নীতি দমন কমিশনের এক গণশুনানিতে সম্প্রতি কক্সবাজারের ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক আশরাফুল আবছার বলেছেন, বাঁকখালী নদীর তীরভূমি দখল করা ৯২ জনের একটি তালিকা তৈরি করা হয়েছে। সেই তালিকা ধরে পর্যায়ক্রমে দখলদারদের উচ্ছেদ করা হবে।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!