বহুল আলোচিত সুইমিংপুলের উদ্বোধন করলেন ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী

সুইমিংপুল নির্মাণ বন্ধের দাবিতে ছাত্র-পুলিশ সংঘর্ষ, মামলা, পক্ষে-বিপক্ষে নানান যুক্তি-তর্ক দেশের আর কোথাও হয়েছে বলে জানা নেই। কিন্তু চট্টগ্রাম জেলা ক্রীড়া সংস্থার উদ্যোগে আর জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের অর্থায়নে সুইমিংপুল নির্মাণ স্থান আউটার স্টেডিয়াম নির্বাচিত করার পর থেকে এর সরাসরি বিরোধিতা করেছিলেন সাবেক মেয়র ও মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি প্রয়াত মহিউদ্দিন চৌধুরী। তিনিসহ যারা সুইমিংপুল স্থাপনের বিরোধী ছিলেন তাদের বক্তব্য ছিল চট্টগ্রামের জন্য সুইমিংপুল দরকার, কিন্তু তাই বলে খেলার মাঠে কেন? এ নিয়ে ২০১৭ সালের এপ্রিল মাসে মহিউদ্দিন চৌধুরীর অনুসারী মহানগর ছাত্রলীগ এটির বিরুদ্ধে অবস্থান নিলে পুলিশের সাথে সংঘর্ষ হয়। যার প্রেক্ষিতে মহানগর ছাত্রলীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক নুরুল আজিম রনিসহ আরও অনেকের বিরুদ্ধে মামলা হয়। সেই বহুল আলোচিত সুইমিংপুলটি অবশেষে আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হলো মঙ্গলবার (১০ সেপ্টেম্বর)।

বেলুন উড়িয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে সুইমিংপুলের উদ্বোধন করছেন যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী মো. জাহিদ আহ্সান রাসেল এমপিসহ অন্যান্য অতিথিবৃন্দ।
বেলুন উড়িয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে সুইমিংপুলের উদ্বোধন করছেন যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী মো. জাহিদ আহ্সান রাসেল এমপিসহ অন্যান্য অতিথিবৃন্দ।

প্রধান অতিথি হিসেবে বেলা ১২টার দিকে সুইমিংপুলের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী মো. জাহিদ আহসান রাসেল এমপি। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী মো. জাহিদ আহসান রাসেল বলেন, ‘শহর অঞ্চালের ছেলে মেয়েরা সুইমিং ভুলে গেছে। আজকের ছেলে-মেয়েদদের সুইমিং করার মতো জায়গা নেই। আমরা ছোটকালে বাসার আশে-পাশে অনেক পুকুর, ডোবা পেতাম যেখানে মনের সুখে সাঁতার কাটতাম। এখন সেসব হারিয়ে যাচ্ছে। তাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্যোগ নিয়েছেন দেশের সব জেলায় সুইমিংপুল নির্মাণের।’ তিনি আরও বলেন, ‘চট্টগ্রামবাসীর দীর্ঘদিনের দাবী ছিল আধুনিক সুযোগ সুবিধা সম্বলিত একটি সুইমিংপুল নির্মাণের। নতুন এ সুইমিংপুল উদ্বোধনের মধ্যে দিয়ে তাদের সেই স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। তাই এ দিনটা চট্টগ্রামের মানুষের জন্য আনন্দের। আমি ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই সুইমিংপুল নির্মাণের সাথে সংশ্লিষ্ট সকলকে।’

সুইমিংপুল উদ্বোধন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে রাখছেন যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী মো. জাহিদ আহসান রাসেল এমপি।
সুইমিংপুল উদ্বোধন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে রাখছেন যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী মো. জাহিদ আহসান রাসেল এমপি।

মানুষের জীবনে সাঁতারের গুরুত্বের কথা উল্লেখ করে ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘এখন শহরের ছেলে-মেয়েরা সাঁতার কি তা ভুলতে বসেছে। শহরে সাঁতার শেখার জন্য পর্যাপ্ত জায়গার অভাব। সাঁতার শুধু খেলা বা ব্যায়ামের জন্যই নয়, জীবনের নিরাপত্তা বিধানের জন্যও সাঁতার শেখাটা জরুরি। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় ইতিমধ্যে ২২টি সুইমিংপুল নির্মাণ করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে প্রত্যেক জেলাতেই সুইমিংপুল নির্মাণ করা হবে। কিন্তু অনেক জায়গায় এই সুইমিংপুলের সুষ্ঠ ব্যবস্থা নেই। সুইমিংপুল কিভাবে সুষ্ঠভাবে ব্যবহার করতে হবে তার জন্যও সকল প্রকার ব্যবস্থা রাখতে হবে।

জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ ইলিয়াস হোসেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন সিটি মেয়র মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মো. জাফর উদ্দীন।

সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন বলেন, একটি সুইমিংফুল নির্মাণ করতে অনেকে না বুঝে বিরোধিতা করেছিলেন। কিন্তু ক্রীড়া ক্ষেত্রে নতুন নতুন ক্রীড়াবিদ তৈরি করা দরকার। সুইমিং অনেকগুলো ক্রীড়ার মধ্যে লাইফলাইন হিসেবে কাজ করে। ফিটনেস যদি ধরে রাখতে হয় সুইমিংয়ের কোনো বিকল্প নেই। তাছাড়া চট্টগ্রাম জেলা ক্রীড়া সংস্থা হলো একমাত্র সংস্থা যেখানে প্রতি বছর নিয়মিত ক্রীড়ার আয়োজন করে থাকে। বাংলাদেশের অন্য কোথাও এর দৃষ্টান্ত নেই ‘এ সময় মেয়র এম এ আজিজ স্টেডিয়ামের ফ্লাডলাইট ও জিমনেশিয়ামের সংস্কারের জন্য মন্ত্রীর প্রতি আহবান জানান।

ড. মোহাম্মাদ জাফর উদ্দিন বলেন, সারা বাংলাদেশে আমরা নবজাগরণ সৃষ্টি করবো। আমাদের ক্রীড়া সংস্থা নিয়ে ২০টি প্রজেক্ট ছিলো। নতুন করে আরো ৪১ টি যোগ করা হয়ে। বর্তমানে ক্রীড়া সংস্থার অধীনে ৬১টি প্রজেক্ট রয়েছে। এসময় তিনি সুইমিংপুল সুষ্ঠু ব্যবহার ও রক্ষনাবেক্ষণের জন্য আহ্বান জানান।

জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ ইলিয়াস হোসেন বলেন, আমাদের চগ্রামবাসীর জন্য আজ শুভদিন। কারণ বহুল প্রতীক্ষিত সুইমিংপুল উদ্বোধন করা হবে। চট্টগ্রামের যেগুলো নান্দনিক জায়গার রয়েছে তার মধ্যে একটি হবে এই এলাকাটি। এই জায়গায় এক সময় মাদকসেবিরা মাদক সেবন করতো। আজ যেখানে সুমিংপুল শোভা পাচ্ছে।

অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন চট্টগ্রাম জেলা ক্রীড়া সংস্থা (সিজেকেএস) সহসভাপতি মোজাম্মেল হক, মো. শাহ আলম, চট্টগ্রাম সুইমিং উপ কমিটির চেয়ারম্যান এহছানুল হায়দার চৌধুরী বাবুলসহ বিভিন্ন ক্রীড়া সংগঠকগণ।

সুইমিংপুল কারা কীভাবে ব্যবহার করবে
সিজেকেএস সূত্রে জানা গেছে, শিক্ষানবিশ (সাঁতার না জানা) ক্যাটাগরিতে ছেলে-মেয়েদের ১ মাসের কোর্সে ভর্তি ফি ৩ হাজার টাকা। ১ ঘণ্টার ক্লাস হবে সপ্তাহে ৪ দিন। মাসের যেকোনো দিন ভর্তি হওয়া যাবে। প্রতি ব্যাচে সর্বোচ্চ ৩০ জন সাঁতারু অংশ নিতে পারবে। বিভিন্ন ইভেন্টের জাতীয় দল ও চট্টগ্রাম জেলা দলের সাঁতারুরা সপ্তাহে ৪ দিন দৈনিক ১ ঘণ্টা সাঁতার কাটতে পারবেন। জনপ্রতি প্রতিঘণ্টা ২০০ টাকা।

সাঁতার জানা শৌখিন সাঁতারুদের প্রতি ঘণ্টা ৪০০ টাকা, এককালীন মাসিক মেম্বারশিপ ৮ হাজার টাকা, ছয় মাসের মেম্বারশিপ ২০ হাজার টাকা। সপ্তাহে ৪ দিন সাঁতার কাটতে পারবেন তারা। এ ছাড়া নাটক, সিনেমা, শর্টফিল্মের শ্যুটিংয়ের জন্য প্রতিঘণ্টায় দিতে হবে ১০ হাজার টাকা। সকাল ৭টা থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত পুরুষরা, বেলা ১১টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত নারীরা, এরপর এক ঘণ্টা করে পুরুষ, ছেলে ও মেয়ে এবং রাত ৮টা থেকে ৯টা পর্যন্ত শুধু পুরুষরা (যারা সাঁতার জানে) সুইমিং পুলটি ব্যবহার করতে পারবেন।

ইতোমধ্যে সিজেকেএস সুইমিং কমপ্লেক্সটিকে ২ জন নারী প্রশিক্ষক, ২ জন পুরুষ প্রশিক্ষকসহ ১৯ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দিয়েছে।

একনজরে সুইমিং পুল:
২০১৭ সালের মার্চ মাসে ১১ কোটি ৬১ লাখ টাকা ব্যয়ে চট্টগ্রামের আউটার স্টেডিয়ামে এই সুইমিং কমপ্লেক্সটির নির্মাণ কাজ শুরু হয়। ১ একর জায়গাজুড়ে নির্মিত সুইমিং কমপ্লেক্সে রয়েছে ৫০ মিটার দৈর্ঘ্য, ২২ মিটার প্রস্থ এবং ১ দশমিক ৮ মিটার গভীর ৮ লাইনের সুইমিং পুল। রয়েছে খোলোয়াড়দের জন্য অত্যাধুনিক ড্রেসিং রুম, প্লেয়ার্স লাউঞ্জ, দেড় হাজার দর্শকের ধারণক্ষমতা সম্পন্ন গ্যালারি, বিশুদ্ধ পানির পিউরিফিকেশন প্ল্যান্ট, ডিপ টিউবওয়েল, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সংযোগের জন্য ২৫০ কেভি’র বিদ্যুৎ সাবস্টেশন এবং নিজস্ব পার্কিংয়ের ব্যবস্থা।

আউটার স্টেডিয়ামে সুইমিংপুল নির্মাণে বিরোধীতাকারীদের মন্তব্য:
চট্টগ্রামের আউটার স্টেডিয়ামে নবনির্মিত সুইমিংপুলের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের পর চট্টগ্রাম প্রতিদিনের সাথে কথা হয় তৎকালীন মহানগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নুরুল আজিম রনির সাথে। তিনি বলেন, ‘চট্টগ্রাম শহর নিয়ে সিডিএ’র যে মাস্টার প্ল্যান ছিল সেখানে এই জায়গাটি উন্মুক্ত জায়গা হিসেবে চিহ্নিত করা ছিল। যা সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত থাকবে। কিন্তু উন্মুক্ত জায়গাটিতে আজকে বাণিজ্যিক সুইমিংপুল স্থাপন করা হলো। যাতে করে সর্বসাধারণের জন্য যে খেলার মাঠ ছিল তা বিশেষগোষ্ঠীর জন্য নির্দিষ্ট করে ফেলা হয়েছে। যেটি চট্টগ্রামের ষাট লক্ষ মানুষের সাথে প্রতারণা করা হয়েছে। যেখানে আমরা সুষ্ঠু নগারয়ণের কথা বলি, সিটি কর্পোরেশন, সিডিএ-ও তা বলেন, সেখানে মাস্টার প্ল্যানকে নষ্ট করে, খেলার মাঠ ধ্বংস করার কোন অর্থ হয় না।’ তিনি আরও বলেন, ‘বর্তমান সিটি মেয়র একইসাথে সিজেকেএস সাধারণ সম্পাদকও। অথচ, তিনি খেলাধুলার জন্য কোন মাঠ সংস্কার বা তৈরি না করে উল্টো খেলার মাঠ ধ্বংস করলেন। তিনি সিটি মেয়র বিশেষগোষ্ঠীর চিন্তা বাদ দিয়ে তরুণ সমাজের জন্য কিছু করবেন এই আশা করি।’

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!