বল বয় থেকে ফুটবলের রাজপুত্র

ছোট্ট ম্যারাডোনার ছোটবেলায় স্বপ্ন ছিল ফুটবল খেলে তার মায়ের জন্য একটি বাড়ি কিনবেন। পাশাপাশি আর্জেন্টাইন জাতীয় দলের হয়ে খেলে বিশ্বকাপ জেতারও স্বপ্ন ছিল ম্যারাডোনার। এই লক্ষ্য নিয়েই ফুটবলে ডিয়োগো ম্যারাডোনার পথচলা শুরু। এক সময় ছোট্ট ম্যারাডোনার সব স্বপ্ন পূরণ হলেও অল্প সময়েই ফুটবল থেকে ছিটকে পড়েন ম্যারাডোনা। তার জীবনের বিভিন্ন তথ্যই থাকছে এই লেখাটিতে।

ছোট্ট একটি ঘটনা দিয়ে মূল লেখাটি শুরু করি। ২০১০ সালের বিশ্বকাপ ফুটবলে ব্যর্থতার জন্য যখন ব্রাজিলিয়ান কোচ দুঙ্গাকে তার দায়িত্ব থেকে বরখাস্ত হয় তখন আর্জেন্টিনায় ঘটে ঠিক তার উল্টো। ২০১০ বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনাও ব্যর্থ হয়েছিল। কিন্তু বিশ্বকাপ থেকে দেশে ফেরার পর বস্তির ঝাড়ুদার থেকে শুরু করে দেশের প্রেসিডেন্ট পর্যন্ত ফুলের তোড়া নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন ম্যারাডোনাকে স্বাগত জানানোর জন্য। চারিদিকে মাতম উঠে— ডিয়োগো, যেও না।

এই সম্মান ম্যারাডোনা তার কোচিং জীবনে অর্জন করেননি। বিরল এই সম্মান ম্যারাডোনা অর্জন করেছিলেন তার খেলোয়াড়ি জীবনে। সাধারণ মানুষ তাকেই আপন করে নেয় যে খেলাটা হৃদয় দিয়ে অনুভব করে। ফুটবলের প্রতি ম্যারাডোনার যে আবেগ ছিল তা আজও তার নিন্দুকদের নাড়া দেয়, এমন শিল্পের, এমন সৌকর্যের, এমন আবেগের ফুটবল আর কে খেলবে!

বল বয় থেকে ফুটবলের রাজপুত্র 1

গরিব পরিবারে জন্ম

পেলের মতো ম্যারাডোনার জন্মও এক গরিব পরিবারে। ১৯৬০ সালের ৩০ অক্টোবর বুয়েন্স আয়ার্স প্রদেশের লানুস শহরের পলিক্লিনিকো প্রভিতা হাসপাতালে জন্মগ্রহণ করেন ম্যারাডোনা। তবে ম্যারাডোনার ছোটবেলা কাটে ভিয়া ফিওরিতোতে। তিন কন্যাসন্তানের পর চতুর্থ সন্তান হিসেবে ম্যারাডোনা জন্মগ্রহণ করেন। ম্যারাডোনার ছোট আরও দুই ভাই রয়েছে।

নাম নিয়ে বিভ্রান্তি

ম্যারাডোনার নাম নিয়ে রয়েছে এক ধরনের বিভ্রান্তি। সবাই আমরা তাকে ডিয়োগো ম্যারাডোনা নামে চিনলেও তার প্রকৃত নাম দিয়োগো মারাদোনা (সূত্র: উইকিপিডিয়া)। তার পুরো নাম ডিয়েগো আরমান্ডো ম্যারাডোনা। ডাকনাম গোল্ডেন বয়।

বল বয় থেকে ফুটবলের রাজপুত্র

ছোট বেলা থেকেই ফুটবলের প্রতি ম্যারাডোনার আকর্ষণ ছিল। ম্যারাডোনার বয়স তখন ১০ বছর। ১৯৭১ সালের সে সময় তিনি এস্ত্রেয়া রোজার হয়ে খেলতেন। এসময় এক স্কাউটের নজড়ে পড়েন ম্যারাডোনা। এই স্কাউট এর সহায়তায় ম্যারাডোনা ‘দ্য লিটল অনিয়ন’ যার অপর নাম ‘আর্জেন্টিনোস জুনিয়র্স’ এর সাথে যুক্ত হন। প্রথম দিকে খেলোয়াড় হিসেবে নয়, একজন বল বয় হিসেবে কাজ করতেন ম্যারাডোনা। ম্যারাডোনার বয়স যখন ১২ বছর সে সময় আর্জেন্টিনার প্রথম বিভাগের খেলার অর্ধ-বিরতির সময় বল নিয়ে জাদুকরী সব কারুকার্য দেখিয়ে তিনি সবার নজড়ে চলে আসেন। পরবর্তীতে ১৯৭৬ সালের ২০ অক্টোবর ‘আর্জেন্টিনোস জুনিয়র্স’ এর একজন নিয়মিত খেলোয়াড় হিসেবে ম্যারাডোনার অভিষেক ঘটে।

বল বয় থেকে ফুটবলের রাজপুত্র 2

খেলার ধরন

ম্যারাডোনা ছিলেন একজন মিডফিল্ডার। মাঝারি গঠনের ম্যারাডোনা দৈহিক চাপ প্রতিরোধ করার ক্ষমতা রাখেন। তার ছোট ছোট পা দিয়ে তিনি খুব দ্রুত দৌড়াতে পারতেন। সীমিত জায়গার মধ্যেও ম্যারাডোনা নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারতেন। খাটো হওয়া সত্ত্বেও, দৈহিক দিক থেকে তিনি ছিলেন শক্তিশালী। তিনি একজন ডিফেন্ডারের সাথে লম্বা সময় ধরে বল নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারতেন, যতক্ষণ না তিনি দ্রুত শট নেওয়ার মত জায়গা খুঁজে পাচ্ছেন বা কোনো সতীর্থ আক্রমনাত্মক দৌড় শুরু করছেন, যাতে তিনি তাকে বল পাস করতে পারেন।

ম্যারাডোনার জাদুকরি কিছু রণকৌশলের মধ্যে অন্যতম হল ডান উইংয়ে পূর্ণ গতিতে ড্রিবলিং, প্রতিপক্ষের গোললাইনে পৌছানো এবং সতীর্থদের সঠিক পাস প্রদান। তার আরেকটি জাদুকরি নৈপূন্য ছিল পায়ের পিছনের অংশ ব্যবহার করে এক ধরনের রিভার্স-ক্রস পাস শট। এছাড়া ম্যারাডোনা ছিলেন একজন বিপজ্জনক ফ্রি কিক গ্রহণকারী।

বাঁ পায়ের জাদুকর

বাঁ পায়ের জাদুকরী ফুটবল শৈলী দেখিয়ে তিনি জয় করেছেন সারা বিশ্বের ফুটবল অনুরাগীদের হৃদয়। এমনকি বলের সাথে ডান পা ভাল অবস্থানে থাকলেও তিনি বাম পা ব্যবহার করতেন।

ইংল্যান্ডের বিপক্ষে গোল অফ দ্য সেঞ্চুরি করার সময় তিনি একবারের জন্যেও তার ডান পা ব্যবহার করেননি, যদিও তিনি মাঠের ডান পাশ দিয়ে আক্রমন করেন। ১৯৯০ বিশ্বকাপের দ্বিতীয় পর্বে ব্রাজিলের বিপক্ষে ম্যারাডোনা ক্যানিজিয়ার যে গোলে সহায়তা করেন তা ডান পায়ে করেছিলেন, কারণ ব্রাজিলীয় ডিফেন্ডাররা তাকে এমন অবস্থায় রেখেছিলেন যে তিনি বাম পা ব্যবহার করতে পারেন নি।

ক্লাব ফুটবলে ম্যারাডোনার অভিষেক

আর্জিন্টিনোস জুনিয়র্সের হয়ে ১৯৭৬ সালের ২০ অক্টোবর ক্লাব ফুটবলে ম্যারাডোনার অভিষেক ঘটে। পাঁচ বছরেরও বেশি সময় ধরে এই ক্লাবে খেলেন ম্যারাডোনা। এই ক্লাবের হয়ে ১৬৭ খেলায় ১১৫টি গোল করেন।

১৯৮১ সালে ১ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে বোকা জুনিয়র্সে যোগ দেন ম্যারাডোনা। বোকা জুনিয়র্সে খুব বেশিদিন খেলেননি ম্যারাডোনা। ম্যারাডোনা যোগ দেওয়ার পর ১৯৮২ সালে বোকা জুনিয়র্স প্রথম লীগ চ্যাম্পিয়নশিপ জিতেন।

পরের গন্তব্য ইউরোপ

১৯৮২ সালের বিশ্বকাপ ফুটবলের পর ৫ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে ইউরোপিয়ান ক্লাব বার্সেলোনায় যোগ দেন ম্যারাডোনা। ১৯৮৩ সালে ম্যারাডোনার বার্সেলোনা কোচ সিজার লুইস মেনত্তির অধীনে রিয়াল মাদ্রিদকে হারিয়ে কোপা দেল রে এবং অ্যাথলেতিক বিলবাওকে হারিয়ে স্প্যানিশ সুপার কাপ জয় করে। বার্সেলোনার হয়ে ৫৮ খেলায় ৩৮টি গোল করেন ম্যারাডোনা।

রেকর্ড পরিমাণ অর্থে নাপোলিতে

বার্সেলোনায় মাঠের বাইরে ম্যারাডোনা ক্লাব পরিচালকদের সাথে নানা ধরনের বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন। তাই সে সময় বার্সেলোনা তার জন্য সুখকর ছিল না। ১৯৮৪ সালে রেকর্ড পরিমাণ ট্রান্সফার ফি এর বিনিময়ে বার্সেলোনা থেকে ইতালির ক্লাব নাপোলিতে যোগ দেন ম্যারাডোনা। অর্থের পরিমাণটা ছিল ৬.৯ মিলিয়ন ইউরো।

বল বয় থেকে ফুটবলের রাজপুত্র 3

ম্যারাডোনা জাদুর শুরু

নাপোলিতে যোগদানের পর থেকেই ম্যারাডোনার ফুটবল শৈলী পরিপূর্ণ বিকশিত হয়ে ওঠে। ম্যারাডোনা যখন নাপোলিতে যোগ দেন লীগে তখন নাপোলির অবস্থা খুব বেশি ভালো ছিল না। সেই অবস্থা থেকে ১৯৮৬–৮৭ ও ১৯৮৯–৯০ মৌসুমে সিরি এ চ্যাম্পিয়নশিপ জিতে এবং ১৯৮৯–৮৮ ও ১৯৮৮–৮৯ মৌসুমে তারা রানার-আপ হয়। শুধু তাই নয় ১৯৮৭ সালে কোপা ইতালিয়াও জিতে নাপোলি। এছাড়া ১৯৮৯ সালে রানারআপ হয়। এতো গেলো নাপোলির সাফল্য। নাপোলির হয়ে ম্যারাডোনা ১৯৮৭–৮৮ মৌসুমের সিরি এ-তে সর্বোচ্চ গোলদাতা হন।

আর্জেন্টিনার হয়ে ম্যারাডোনা

আর্জেন্টিনা জাতীয় ফুটবল দলের হয়ে ম্যারাডোনা টানা চারটি বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করে। তবে এর আগে ১৯৭৭ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি ১৬ বছর বয়সে হাঙ্গেরির বিপক্ষে ম্যারাডোনার আন্তর্জাতিক ফুটবলে অভিষেক হয়। আর্জেন্টিনার হয়ে ১৯৭৯ সালে যুব বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করে এবং সেই বিশ্বকাপের আর্জেন্টিনা চ্যাম্পিয়ন হয়।

একক অর্জন

ফুটবল ক্যারিয়ারে ম্যারাডোনার অর্জনের কোনো শেষ নেই। তবে তার এমন একটি অর্জন রয়েছে যা অন্য কোনো ফুটবলারের নেই। আর তা হলো ফিফা অনুর্ধ্ব ২০ বিশ্বকাপ ও ফিফা বিশ্বকাপে গোল্ডেন বলের অধিকারী হওয়া।

বিশ্বকাপে ম্যারাডোনা

১৯৮২ সালের বিশ্বকাপটি ছিল ম্যারাডোনার প্রথম বিশ্বকাপ। এই বিশ্বকাপে ম্যারাডোনা তেমন কোনো নৈপুন্য দেখাতে পারেন নি এবং আর্জেন্টিনা টুর্নামেন্টের দ্বিতীয় পর্ব থেকে বাদ নেয়। ১৯৮২ বিশ্বকাপে ম্যারাডোনা ২টি গোল করেছিলেন এবং পাশাপাশি ব্রাজিলের সাথে শেষ খেলায় লাল কার্ড দেখানো হয়েছিল।

১৯৮২ বিশ্বকাপের ব্যর্থতার গ্লানিকে মুছে ম্যারাডোনার নেতৃত্বে ১৯৮৬ বিশ্বকাপ খেলতে আসে আর্জেন্টিনা। এবার আর খালি হাতে নয়, ফিরেছে বিশ্বকাপ জয় করে। ১৯৮৬ বিশ্বকাপের পুরোটাই ছিল ম্যারাডোনার একক আধিপত্য। নিজে করেন ৫টি গোল। এই বিশ্বকাপটি ম্যারাডোনাকে অনন্য উচ্চতায় তুলে ধরে। কেননা এই বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ‘হ্যান্ড অব গড’ ও ‘গোল অব দ্যা সেঞ্চুরি’ এই গোল দুটি করেন। ফাইনালে পশ্চিম জার্মানিকে ৩-২ গোলের ব্যবধানে হারিয়ে শিরোপা জিতে আর্জেন্টিনা। এই বিশ্বকাপে ম্যারাডোনা বিশ্বকাপের সেরা খেলায়াড় হিসেবে গোল্ডেন বল জিতে নেয়।

১৯৯০ এর বিশ্বকাপে ইনজুরি ম্যারাডোনার শত্রু হয়ে দাঁড়ায়। গোড়ালির ইনজুরি কারণে এই বিশ্বকাপে নিজেকে ঠিকভাবে মেলে ধরতে পারেননি ম্যারাডোনা। কোনো রকমে পার হন প্রথম পর্ব। কোয়ার্টার ফাইনাল থেকেই প্রতিপক্ষ দলের তীব্র প্রতিরোধের মুখে পড়ে আর্জেন্টিনা। কোয়ার্টার ফাইনালে ইয়োগোস্লাভিয়ার বিপক্ষে ম্যাচটি ১২০ মিনিটেও কোনো গোলের মুখ দেখেনি। ট্রাইব্রেকারে ম্যারাডোনার দুর্বল ঠেকিয়ে দিলেও আর্জেন্টিনা ৩-২ গোলে ম্যাচটি জিতে। এবার সেমিফাইনাল, প্রতিপক্ষ ইতালি। এই ম্যাচটিও ১২০ মিনিট পর্যন্ত গড়ায়। ফলাফল ১-১, ট্রাইব্রেকারে ইতালিকে হারিয়ে ফাইনালে পৌঁছে যায় আর্জেন্টিনা। কিন্তু বিতর্কিত পেনাল্টিতে পশ্চিম জার্মানির কাছে ১-০ গোলে হেরে যায় ম্যারাডোনার আর্জেন্টিনা।

১৯৯৪ এর বিশ্বকাপে এসে ম্যারাডোনার জীবনে নেমে আসে ভয়াবহ এক দুর্যোগ। ৯৪ বিশ্বকাপে মাত্র দুটি খেলায় মাঠে নামতে পারেন ম্যারাডোনা। তারপরই ড্রাগ টেস্টে এফিড্রিন ডোপিং ধরা পড়ে এবং বিশ্বকাপ থেকে ম্যারাডোনাকে বহিষ্কার করা হয়। এরপর আর্জেন্টিনা দ্বিতীয় পর্বে এসে বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নেয়।

১৯৯৪ বিশ্বকাপের আগেও ধরা পড়েন ড্রাগ টেস্টে

নাপোলিতে থাকা অবস্থায় ১৯৯১ সালেও একবার ড্রাগ টেস্টে কোকেইনের জন্য ধরা পড়ায় ১৫ মাসের জন্য ফুটবল থেকে নিষিদ্ধ করা হয় ম্যারাডোনাকে। ১৫ মাসের নিষেধাজ্ঞা থেকে ফিরে ১৯৯২ সালে নাপোলি ছেড়ে দেন ম্যারাডোনা। স্যানিশ ক্লাব রিয়াল মাদ্রিদ ও ফরাসী ক্লাব অলিম্পিকে মার্শেই এর আগ্রহকে পাশ কাটিয়ে ম্যারাডোনা আরেক স্যানিশ ক্লাব সেভিয়াতে যোগ দেন। সেভিয়াতে এক বছর খেলার পর যোগ দেন লিওয়েলস ওল্ড বয়েজে। এখানে দুই বছরের মতো খেলে ১৯৯৫ সালে আবার ফিরে যান বোকা জুনিয়র্সে।

ডোপ টেস্টে ধরা পড়ার পর ম্যারাডোনার ভাষ্য

ম্যারাডোনা তার আত্মজীবনীতে ৯৪ বিশ্বকাপে ডোপ টেস্টে ধরার বিষয়ে বলেছেন, তার ব্যক্তিগত প্রশিক্ষক তাকে এনার্জি ড্রিংক রিপ ফুয়েল দেওয়ার কারণে তিনি ড্রাগ টেস্টে ধরা পড়েছেন। তার দাবি ছিল, পানীয়টির যুক্তরাষ্ট্রীয় সংস্করণ আর্জেন্টিনীয় সংস্করণের মত নয়, যার মধ্যে ওই রাসায়নিক দ্রব্যটি ছিল এবং তার প্রশিক্ষক অনিচ্ছাকৃতভাবে তা ব্যবহার করে। এছাড়া ম্যারাডোনা আরও দাবি করেন যে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের আগে ওজন কমানোর জন্য ওই রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহারে ফিফার সাথে তার একটি চুক্তি হয়েছিল।

সর্বকালের সেরা গোলের রেকর্ড

‘হ্যান্ড অব গড’ ও ‘গোল অব দ্যা সেঞ্চুরি’ এই দুটি গোলকে বলা হয় সেরা গোল। এই দুটি গোলই করেন ফুটবল ঈশ্বর ডিয়োগো ম্যারাডোনা। গোল দুটি হয় একই ম্যাচে এবং মাত্র চার মিনিটের ব্যবধানে। ১৯৮৬ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে ‘চিরশত্রু’ ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সেই দুটো গোল করেন ডিয়েগো ম্যারাডোনা।ম্যাচের ৫১ মিনিটে রেফারিকে ফাঁকি দিয়ে হাত দিয়ে বল জালে ঠেলেছিলেন এই আর্জেন্টাইন তারকা। এই গোলটি হয়তো ইতিহাসে কলঙ্কিত হয়েই থাকত। কিন্তু চার মিনিট পরেই যে অবিশ্বাস্য গোল তিনি করে দেখালেন, তাতে সব মিলিয়ে পুরো গল্পটা হয়ে উঠল ফুটবলীয়-পুরাণের অংশ। ছয় ইংলিশ ফুটবলারকে কাটিয়ে মাঝমাঠেরও ভেতর থেকে একাই বল টেনে নিয়ে গিয়ে করেন ম্যাচের এবং নিজের দ্বিতীয় গোল।

১০ নম্বর জার্সি অন্য কারও নয়

ম্যারাডোনা নাপোলিতে ১০ নম্বর জার্সি পড়ে খেলতেন। ম্যারাডোনা যখন নাপোলিতে যোগ দেন তখন নাপোলি ছিল একটি সাধারণ মানের দল। সেই নাপোলিকে ম্যারাডোনা একে একে এনে দেন সিরিএ, ইউরোপ সেরার মুকুট। ম্যারাডোনার বা পায়ের জাদুতে নাপোলি হয়ে ওঠে ইউরোপ জায়ান্ট। ম্যারোডোনার সেই কৃতিত্বকে সম্মান জানিয়ে নাপোলি তাদের ১০ নম্বর জার্সিটি তুলে নেন। আজও পর্যন্ত এই জার্সি কাউকে দেওয়া হয় নি। বর্তমান সময়েও নাপোলিতে রয়েছে তরুণ ফরোয়ার্ড লরেনজো ইনসি। দারুণ ফর্মে থাকা এই স্ট্রাইকারকে অনেকেই ১০ নম্বর জার্সিটি দিতে বলেন। কিন্তু নাপোলি কর্তৃপক্ষ সরাসরি জানিয়ে দেয়, ১০ নম্বর শুধুমাত্র ম্যারাডোনার।

কোচ ম্যারাডোনা

খেলোয়াড়ি জীবন হওয়ার বেশ কিছুদিন পর কোচ হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেন ম্যারাডোনা। আর্জেন্টিনার কয়েকটি জুনিয়র ক্লাবে কোচের দায়িত্ব পালন করেন ম্যারাডোনা। অবশেষে ২০০৮ সালে আর্জেন্টিনা জাতীয় দলের দায়িত্ব পান ম্যারাডোনা। তবে বিশ্বকাপ ব্যর্থতার কারণে সরে দাঁড়াতে হয় তাকে। এরপর যোগ দেন আরব আমিরাতের আল ওয়াসল ক্লাবে। সেখান থেকে পরবর্তীতে আসেন আর্জেন্টিনার পঞ্চম সারির ক্লাব দির্পোতিভো রিস্ত্রায় পার্টটাইম কনসালটেন্ট হিসেবে।

বরাবরই সমালোচনার জনক

ফুটবল খেলে যেমন অর্জন করেছেন অনেক সম্মান তেমনি ব্যক্তি জীবনে জন্ম দিয়েছেন বহু সমালোচনার। ম্যারাডোনা ফুটবলার হিসেবে যতটা জনপ্রিয়, ততটাই ‘বিতর্কিত’ তার উচ্ছৃঙ্খল জীবনাচারের জন্য। মদ্যপান, ড্রাগ কেলেঙ্কারি, নারীঘটিত ব্যাপার, ভক্তদের সঙ্গে হাতাহাতি, গণমাধ্যমের সঙ্গে বৈরিতা—নিজেকে বিতর্কিত করে তোলার জন্য কী করেননি ম্যারাডোনা!

সর্বকালের সেরা ফুটবলার

পেলে নাকি ম্যারাডোনা কে সর্বকালের সেরা তা নির্বাচন করার জন্য ফুটবলের সর্বোচ্চ সংস্থা ফিফা ২০০০ সালে একটি ভোটের আয়োজন করেছিল। যেখানে সারা বিশ্বের ফুটবল প্রেমী সাধারণ মানুষ ভোট দেন। সেই ভোটে পেলেকে হারিয়ে সর্বকালের সেরা ফুটবলার হয়েছিলেন ম্যারাডোনা। কিন্তু ফুটবলবোদ্ধাদের অনুরোধে পরবর্তীতে ফিফা ম্যারাডোনা-পেলে দুজনকেই যৌথভাবে সর্বকালের সেরা ফুটবলার হিসেবে ঘোষণা করেন।

কে সেরা, মেসি নাকি ম্যারাডোনা

ম্যারাডোনার সমকক্ষ কি মেসি কোনোদিন হতে পারবেন? কয়েক বছর ধরেই এই প্রশ্নটি সারা ফুটবল বিশ্বে ঘুরছে। ম্যাচের পরিসংখ্যানের দিক দিয়ে মেসি এগিয়ে থাকলেও মনের দিক থেকে ম্যারাডোনা ছিলেন মেসির চেয়ে এগিয়ে। লিগে ধুকতে থাকা নাপোলিকে এসে লিগ শিরোপা, কাপ শিরোপা, চ্যাম্পিয়নস লিগ সবই জিতিয়েছিলেন ডিয়াগো ম্যারাডোনা। বর্তমান সময়ে মেসির চারপাশে যারা খেলেন তারা এক একজন তারকা খেলোয়াড়। আর ম্যারাডোনার চারপাশে যারা খেলতেন তারা সবাই তারকা ছিলেন না। ম্যারাডোনা নিজের কাঁধে করে নাপোলিকে খাদের কিনারা থেকে তুলে আনেন। ১৯৮৬ বিশ্বকাপ জয়ে ম্যারাডোনাই প্রধান ভূমিকা পালন করেন। তার পরের বিশ্বকাপেও ভাঙাচোরা দল নিয়ে ম্যারাডোনা ফাইনালে তুলেছিলেন আর্জেন্টিনাকে। সেদিক থেকে বিচার করলে মেসির চেয়ে যোজন যোজন এগিয়ে রয়েছেন ম্যারাডোনা। তবে কৌশলের ক্ষেত্রে তুলনামূলক এগিয়ে মেসি। ‘ড্রিবলিং’, গতি, বল পাসিংয়ে মেসিই সেরা।

সর্বকালের সেরা একাদশে ম্যারাডোনা

এখানে অবাক হওয়ার কোনো কারণ নেই। যদি ম্যারাডোনা সর্বকালের সেরা একাদশে না থাকতেন তবেই তা অবাক হওয়ার বিষয় হতো। সর্বকালের সেরা একাদশ তৈরি হলে ম্যারাডোনা থাকবেন না—এমন ব্যাপার বোধহয় ভাবতে পারেন না খোদ ম্যারাডোনার শত্রুও।

ম্যারাডোনার জীবনে ছিলেন চার জন নারী

নতুন নতুন সব গার্লফ্রেন্ড নিয়ে কয়েক দিন পর পরই নতুন নতুন শিরোনাম হন ম্যারাডোনা। তবে জীবনে একবারই বিয়ের পিঁড়িতে বসেছেন ম্যারাডোনা। ১৯৮৪ সালে ক্লদিয়ার সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন ম্যারাডোনা। দীর্ঘ ২০ বছর পর ২০০৪ সালে ক্লদিয়ার সাথে ম্যারাডোনার বৈবাহিক সম্পর্কের ইতি ঘটে। কাগজে কলমে তাদের সম্পর্ক বিচ্ছেদ হলেও ম্যারাডোনা ও ক্লদিয়াকে এরপরও একসাথে দেখা গেছে। ম্যারাডোনা ও ক্লদিয়ার সংসারে রয়েছে দালমা ও জিয়ান্নিনা নামে দুই মেয়ে।

আর্জেন্টিনা বিদ্বেষী

ছোটবেলায় আর্জেন্টিনা জাতীয় দলের হয়ে খেলে বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্ন থাকলেও বুড়ো বয়সে এসে আর্জেন্টিনার প্রতি এক ধরনের বিদ্বেষ তৈরি হয় ম্যারাডোনার। বিদ্বেষের শুরুটা আর্জেন্টিনা জাতীয় দলের কোচ হওয়ার পর থেকেই। সে সময় তাকে অসহযোগিতার অভিযোগ এনে ম্যারাডোনার আর্জেন্টিনা বিদ্বেষী হয়ে ওঠেন। এই কারণে আর্জেন্টিনার খেলা দেখাও ছেড়ে দিয়েছেন। তবে তিনি এও বলেছেন, আকাশী-নীল জার্সি দেখলে এখনো আমার আবেগ উপচে ওঠে।

ঝামেলা বরাবরই ম্যারাডোনার সঙ্গী ছিল

ইতালিয়ান ক্লাব নাপোলিতে খেলার সময় ম্যারাডোনার জীবনে বিভিন্ন ধরনের বিতর্ক দেখা দেয়। এর মধ্যে একটি ছিল ট্যাক্স ফাঁকির মামলা। এই কারণে দীর্ঘদিন ইতালিতে যেতে পারেননি ম্যারাডোনা। কারণ তাকে কর ফাঁকির অভিযোগে খুঁজছিল দেশটির পুলিশ।

তার বিরুদ্ধে ট্যাক্স কর্তৃপক্ষের অভিযোগ, তিনি ইতালিতে থাকা অবস্থায় যে সব ব্যবসা করেছেন, আয় করেছেন; তার কর সময়মতো শোধ করেননি। এই অভিযোগে ২০০৭ সালে তার ইতালি সফরের সময় পুলিশ ধরে বিমানবন্দরে তার কাছ থেকে বেশ কিছু অর্থ ও দুটি রোলেক্স ঘড়ি খুলে রাখে। পরে আর্জেন্টিনা জাতীয় দলের কোচ থাকা অবস্থায় ২০০৯ সালে এক ক্লিনিকে কর-পুলিশ গিয়ে চড়াও হয় ইতালি সফররত ম্যারাডোনার ওপর। সে যাত্রা নগদ ৪ হাজার পাউন্ড ও কানের দুল কেড়ে নিয়ে রেহাই দেয় তাকে। প্রতিবারই ম্যারাডোনা দাবি করেছেন, তার কোনো বকেয়া নেই। শেষমেষ আদালত রায় দেন ম্যারাডোনার পক্ষে। কেননা কর বিভাগের কাছে ম্যারাডোনার কর ফাঁকির কোনো প্রমাণ নেই।

মৃত্যুঞ্জয়ী ম্যারাডোনা

ফুটবল ক্যারিয়ারে বহু শিরোপা জিতেছেন ম্যারাডোনা। ম্যারাডোনার জীবনে মৃত্যুকে জয় করার রেকর্ডও রয়েছে। মাদকের ভয়াবহ ছোবলে ২০০৪ সালে মৃত্যুর একেবারে কাছ থেকে ফিরে আসেন ম্যারাডোনা।

পরিসংখ্যান

পরিসংখ্যান চার্টে ম্যাচের তুলনায় ম্যারাডোনার গোল সংখ্যা কম দেখে অনেকে অবাক হতে পারেন। ম্যারাডোনা ছিলেন মিডফিল্ডার। মিডফিল্ড থেকে স্ট্রাইকারদের গোল বানিয়ে দেওয়াই ছিল তার কাজ। সে কারণে ম্যারাডোনার গোল সংখ্যা ম্যাচের তুলনায় কম।

অবশেষে না ফেরার দেশে

ফুটবল ঈশ্বর ডিয়েগো ম্যারাডোনা অবশেষে চলে গেলেন না ফেরার দেশে। বুধবার (২৫ নভেম্বর) হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে পৃথিবী ছেড়ে চিরবিদায় নিলেন ১৯৮৬ সালে আর্জেন্টিনাকে প্রায় একাই বিশ্বকাপ জেতানো এই কিংবদন্তী। মৃত্যুকালে ম্যারাডোনার বয়স হয়েছিল ৬০ বছর।
সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!