বর্ষা এলেই যত তোড়জোড়, বর্ষা শেষে আবার ‘যেই লাউ সেই কদু’

আদালতে রিটে আটকে যায় উচ্ছেদ কার্যক্রম

চট্টগ্রামে ভারী বর্ষণ হলে নিচু এলাকা ডুবে যায় পানির নিচে আর পাহাড়ি এলাকায় বেড়ে যায় পাহাড় ধসের ঝুঁকি। গত সপ্তাহের দুইদিনের ভারী বর্ষণেও হাঁটুপানিতে ডুবেছে চট্টগ্রাম নগরীর নিচু এলাকা। একইভাবে অতিবৃষ্টিতে পাহাড়ে অবৈধভাবে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসকারীরা রয়েছে পাহাড় ধসে প্রাণহানীর ঝুঁকিতে।

বর্ষা মৌসুম ঘনিয়ে এলেই পাহাড় ধস ও প্রাণহানির আশঙ্কায় প্রশাসনের তোড়জোড় বেড়ে যায়। পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসকারী লোকজনকে সরিয়ে নিতে চলে ব্যাপক তৎপরতা। কিন্তু বর্ষা শেষেই আবার ‘যেই লাউ সেই কদু’। অবৈধ দখলদারদের ক্ষমতা আর প্রভাবে হার মানতে হয় প্রশাসনকে।

২০০৭ সালে ভয়াবহ পাহাড় ধসে ১২৯ জনের প্রাণহানির পর থেকে প্রতি বছর ভারী বৃষ্টিতে বন্দর নগরী চট্টগ্রামে এই তোড়জোড় দেখা যায়। এবারও ভারী বর্ষণে মতিঝর্ণা এলাকাসহ বিভিন্ন পাহাড়ে ঝুকিপূর্ণভাবে বসবাসরত অনেক পরিবারকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু পাহাড়ে অবৈধভাবে বসবাসকারী পরিবারগুলোকে স্থায়ীভাবে কখনো সরানো যায় না। ফলে ভারি বৃষ্টিপাত হলেই পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটে। ঘটে প্রাণহানিও।

প্রতিবছর পাহাড়ে অবৈধভাবে ঝুঁকি নিয়ে বসবাসরতদের সরিয়ে নিতে পদক্ষেপ নেওয়া হয়। এ বছরও বর্ষা মৌসুমকে সামনে রেখে পাহাড়ে অবৈধভাবে বসবাসকারী পরিবারগুলোকে সরিয়ে নিতে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। এ নিয়ে পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির উচ্চপর্যায়ের বৈঠকও হয়েছে।

২৮ মে বিভাগীয় কমিশনার এবিএম আজাদের সাথে সাথে ওয়াসা, গ্যাস বিদ্যুত বিভাগের কর্মকর্তাদের নিয়ে বৈঠকে পাহাড়ের ঝুঁকিপূর্ণ সব ঘরের অবৈধ গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তবে এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হয়নি। ফলে এ বছরও বর্ষায় পাহাড় ধস হলে যথারীতি মাটিচাপায় প্রাণহানির আশঙ্কা করা হচ্ছে।

জেলা প্রশাসনের তথ্যমতে, চট্টগ্রামে নগরে ১৮টি ও নগরের বাইরে ১৬টি সহ মোট ৩৪টি পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণভাবে লোকজন বাস করছে। তারমধ্য নগরের সব কয়টি এবং সীতাকুণ্ড জঙ্গল ছলিমপুর ও হাটহাজারী মানাই ত্রিপুরা এলাকার কয়েকটি পাহাড় বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। এসব পাহাড়ে বসবাসরদের সরিয়ে নিতে কাজ করছে জেলাপ্রশাসন।

জেলা প্রশাসনের সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, ভারী বর্ষণে ঝুঁকি এড়াতে পাহাড়ে বসবাসরতদের সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। ঘরে ঘরে গিয়ে আমরা ২০০ পরিবারকে ১৯টি আশ্রয় কেন্দ্রে সরিয়ে নিয়েছি৷ আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় নেওয়া পরিবারদের জন্য খাবার সহ ত্রাণের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তবে অনেক পাহাড়ে উচ্ছেদে আদালতে রিট থাকায় তা সম্ভব হয় না।

জানা গেছে, নগরী ও নগরের বাইরে ৩৪টি পাহাড়ে কয়েক লাখ মানুষ বাস করছে। পাহাড় কেটে সমতল করে প্রতিদিন নির্মাণ করা হচ্ছে স্থাপনা। এলাকাভিত্তিক প্রভাবশালী লোকজন এসব ঘর নির্মাণ করে ভাড়ায় দিয়েছেন। এসব প্রভাবশালীদের রয়েছে রাজনৈতিক ছত্রছায়া।

নগরীর খুলশী, লালখান বাজার, মতিঝর্না, জিলাপি পাহাড়, বাটালি পাহাড়, বাঘঘোনা, পোড়া কলোনি, একে খান পাহাড়, ডেবার পাড়, ফয়’স লেক এলাকার ১ নং, ২ নং ও ৩ নং ঝিল পাহাড়, ফারক চৌধুরী মাঠ, কবরস্থান, পলিটেকনিক এলাকার বিভিন্ন পাহাড়, পাহাড়তলীর ফয়’স লেক পাহাড়, মিয়ার পাহাড়, বিজয় নগর, মধ্যম শান্তি নগর পাহাড়, চট্টেশ্বরি ট্যাংকি পাহাড়, ফরেস্ট হিল, সীতাকুণ্ড এলাকায় ত্রিপুরা পল্লী, সন্দীপ পাড়া, আদর্শ গ্রাম, জঙ্গল ছলিমপুর ও হাটহাজারী মানাই ত্রিপুরা এলাকায় পাহাড় কেটে নির্মাণ করা হয়েছে বহুতল ভবনসহ নানা স্থাপনা।

এসব ঘরে রয়েছে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির সংযোগ। একটি মিটার থেকে ১০-১২ ঘরে দেওয়া হয়েছে গ্যাস-বিদ্যুৎ সংযোগ। সংশ্নিষ্ট সেবা সংস্থাগুলোর অসাধু কর্মচারীদের সহযোগিতায় দেওয়া সংযোগ পাহাড়ে ঝুকিপূর্ণ বসবাসের অন্যতম কারণ। কারণ এসব সুবিধা না থাকলে এতবেশী লোক পাহাড়ে বসবাসে আগ্রহী হত না। এসব পাহাড়ে উচ্ছেদ ঠেকাতে ভূমিদস্যুরা উচ্চ আদালতে রিট করে রেখেছে। ফলে অনেকে পাহাড়ে উচ্ছেদে রয়েছে নিষেধাজ্ঞা।

এসব কারণে প্রশাসন বর্ষা মৌসুমে পাহাড়ে অবৈধভাবে ঝুঁকি নিয়ে বসবাসকারীদের সরিয়ে নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে এনে কয়েকদিন নিরাপদ রাখলেও আবারো আগের অবস্থায় ফিরে যায় তারা। তবে পাহাড়ে অবৈধভাবে ঝুঁকি নিয়ে বসবাসকারীদের স্থায়ী উচ্ছেদে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া না হলে পাহাড় নিধন ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা ও বর্ষা মৌসুমে পাহাড় ধসে মানুষের মৃত্যু ঠেকানো সম্ভব নয়।

পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য ও জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মামনুন আহমেদ অনিক বলেন, ‘ভারী বর্ষণে পাহাড় ধসে প্রাণহানী রোধে আমরা তাদের নিরাপদে সরিয়ে নিতে কাজ করছি। ইতিমধ্যে কয়েকশ পরিবারকে ১৯টি আশ্রয় কেন্দ্র এনে খাবার সহ ত্রাণের ব্যবস্থা করা হয়েছে৷ পাহাড়ে বসবাসরতদের স্থায়ীভাবে সরিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে অনেক পাহাড়ে উচ্চ আদালতে রিট করা করা হয়েছে। অনেক পাহাড়ে আবার নিষেধাজ্ঞাও রয়েছে। তারপরেও আমরা উচ্ছেদ অভিযান চালিয়ে তাদের উচ্ছেদ করি৷ গত বছর উচ্ছেদের সময় অভিযান টিমের উপর হামলাও হয়েছিল।’

কেএস

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!