বন্যেরা বনেই সুন্দর, লোকালয়ে যত বিপত্তি

হাতির উৎপাত

বন্য পশু-প্রাণী বনেই শোভা পায়। কিন্তু সে বন্য প্রাণী যখন লোকালয়ে চলে আসে তখন মানুষের মনে ভর করে আতঙ্ক। সম্প্রতি বন ছেড়ে লোকালয়ে ঢুকে পড়ছে বন্য হাতি। বেড়েছে বেপরোয়া উৎপাত। ফলে প্রায়ই বলি হচ্ছে মানুষের জান-মাল।

চট্টগ্রাম অঞ্চলে বেশ কয়েক বছর ধরে লোকালয়ে দেখা যাচ্ছে বন্য হাতির পাল। বন,পাহাড় ছেড়ে এসব হাতির পাল লোকালয়ে ঢুকে কৃষকের মাঠের ফসল, ঘর বাড়ির ক্ষতি করছে। শুধু তাই নয়, প্রাণ হারাচ্ছেন বিভিন্ন বয়সের মানুষ।

চট্টগ্রামের লোহাগাড়া, বোয়ালখালী, আনোয়ারা, বাঁশখালী, রাঙামাটির কাপ্তাই, বান্দরবানের লামাসহ কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফ, বিভিন্ন এলাকায় প্রায়ই পাহাড় থেকে হাতি লোকালয়ে নেমে আসছে। ঘরবাড়ি-ফসলের ক্ষেত ধ্বংস করছে, পাশাপাশি মানুষের ওপরও আক্রমণ করছে বেপরোয়া হাতির পাল।

বাংলাদেশ বন গবেষণা ইনস্টিটিউট সূত্রে জানা যায়, ২০১০ সাল থেকে ২০১৯ সালের অক্টোবর পর্যন্ত হাতির আক্রমণে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার ও তিন পার্বত্য জেলায় মারা গেছেন প্রায় ৪৫ জন। এর মধ্যে গত দুই বছরে মারা গেছেন ১৬ জন।

বোয়ালখালীতে হাতির আক্রমণে রোববার (২৪ নভেম্বর) তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। হাতির পায়ে পিষ্ট হয়ে চরণদ্বীপ ইউনিয়নের পূর্ব সৈয়দ নগর এলাকার জাকের হোসেন (৬৫), কধুরখীল ইউনিয়নের মধ্যম কধুরখীল শরীফ পাড়ার আবু তাহের মিস্ত্রী (৬৫) ও শ্রীপুর-হরণদ্বীপ ইউনিয়নের জ্যৈষ্ঠপুরা এলাকার আব্দুল মাবুদ (৬০) এই তিনজনের মৃত্যু হয়েছে।

বান্দরবানের লামায় বৃহস্পতিবার (২১ নভেম্বর) পাহাড়ে বাঁশের কঞ্চি কাটতে গিয়ে বন্যহাতির আক্রমণে নুরুল ইসলাম (৭০) নামের এক বৃদ্ধের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। এছাড়াও নষ্ট করেছে কৃষকদের মাঠ ভরা পাকা ধানের ক্ষেত ও অন্যান্য ফসল।

লোকালয়ে হাতির উৎপাত বাড়ার প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম দক্ষিণ বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মোজাম্মেল হক শাহ চৌধুরী চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, হাতির পাল খাদ্যের সন্ধানেই লোকালয়ে চলে আসছে। এখনতো পাকা ধানের মৌসুম তাই ধান খেতেই চলে আসছে। যতদিন পাকা ধান থাকবে ততদিন বন্যহাতির লোকালয়ে আসা যাওয়া থাকবেই। তাছাড়া মানুষ পাহাড় কেটে বসতঘর করছে। এতে করে বন্য প্রাণীদের আবাসস্থল সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে। হাতি দেখলে উৎসুক জনতার ভিড় বেড়ে যায়। তারা বুঝতে পারেনা হাতির আক্রমণে প্রাণ যেতে পারে। হাতিকে বিভিন্নভাবে ডিস্টার্ব করে। নানাভাবে শব্দ করে হাতি তাড়াতে। যার কারণে হাতি উত্তেজিত হয়ে মানুষের উপর আক্রমণ করে।

চট্টগ্রাম উত্তর বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. বখতিয়ার নূর সিদ্দিকী জানান, বিশেষ করে হাতির আবাসস্থল সংকুচিত হওয়ার কারণে ও খাদ্যের সন্ধানেই হাতি পাহাড় ছেড়ে লোকালয়ে চলে আসছে।

বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের চট্টগ্রাম বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আবু নাসের মোহাম্মদ ইয়াসিন নেওয়াজ জানান, বর্তমানে হাতির সংখ্যাও বেড়েছে। সে তুলনায় হাতির খাদ্যের পরিমাণ বাড়েনি। আবার দেখা যাচ্ছে, হাতির আবাসস্থল বন, পাহাড় এসব সাফ করে মানুষ তাদের বসতি গড়ে তুলছে। যার কারণে বন্য হাতি লোকালয়ে চলে আসছে। আরো একটা বিশেষ কারণ হলো, এখন পাকা ধানের মৌসুম। আর পাকা ধান হাতিদের খুব প্রিয় একটা খাবার। তাই পাকা ধান খেতে হাতির পাল চলে আসে লোকালয়ে। অবশ্য প্রতিবছর এই মৌসুমেই লোকালয়ে হাতি বেশি দেখা যায়।

বন্য হাতির আক্রমণে মানুষ মারা যাওয়ার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, হাতি দেখলেই মানুষ ঢল নামে, চিৎকার চেঁচামেচি ও ছবি তোলাতে ব্যস্ত হয়ে যায়। হাতির লোকালয়ে আসা যে স্বাভাবিক বিষয়, সেটা মানুষ বুঝতে চায় না। হাতি আসবে আবার চলেও যাবে। কিন্তু মানুষ বিভিন্নভাবে হাতিগুলোকে তাড়ানোর চেষ্টা করে। যার ফলে হাতি মানুষের উপর আক্রমণ করে। হাতি তাড়ানোর জন্য আমাদের নিজস্ব বিভিন্ন কৌশল আছে। কিন্তু অতি উৎসাহী লোকজনের জন্য সেটা আমরা করতে পারি না। মানুষ অসচেতনতার কারণেই প্রাণ হারান। মানুষকে আরো সচেতন হতে হবে। তা না হলে এরকম দুর্ঘটনা প্রায় ঘটতে থাকবে।

বোয়ালখালীতে তিনজনের মৃত্যুর বিষয়ে তিনি বলেন, আমরা আমাদের কৌশল প্রয়োগ করে হাতিগুলোকে তাড়ানোর ব্যবস্থা করেছিলাম। কিন্তু মাঠে পাকা ধান থাকায় হাতিগুলোকে দ্রুত তাড়ানো যাচ্ছিলনা। যারা মারা গেছেন, তারা একটু সচেতনতার সাথে চলাফেরা করলে এমন দুর্ঘটনা ঘটতোনা।

লোকালয়ে হাতির উৎপাত বাড়ার প্রসঙ্গে বাংলাদেশ বন গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক ড. মো. মাসুদুর রহমান চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, প্রধানত দুইটি কারণে বন্য হাতিরা লোকালয়ে চলে আসছে বলে আমরা ধারণা করছি। প্রথমত তাদের আবাসস্থল সংকুচিত হওয়ার কারণে এবং দ্বিতীয়ত পর্যাপ্ত খাবার না পাওয়ার কারণে হাতির পাল বিভিন্ন লোকালয়ে চলে আসছে। আমরা যতই বলি বন্য প্রাণীদের আবাসস্থলে কোনো প্রকার বিরক্তের প্রভাব ফেলিনা। কিন্তু দেখা যাচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলেই বন্য প্রাণীদের আবাসস্থলের জায়গাগুলো অনেকটা সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে। তবে এটাও সত্যি, একটা হাতির দিনে ২৫০ কেজি খাবারের দরকার হয়। কিন্তু আমাদের জানা মতে, সেসব জায়গায় প্রায় ২০০ হাতি আছে। এখন চিন্তা করেই দেখুন একটা হাতির ২৫০ কেজি খাবার দরকার হলে ২০০ হাতির কতো খাবার দরকার হবে। ফলে নতুন আবাসস্থলের খোঁজে এবং অনেকটা খাবারের সন্ধানেই হাতির পাল লোকালয়ে চলে আসছে। এটা নিয়ন্ত্রণ করতে হলে আমাদের অনেক বড় একটা প্রোগ্রাম হাতে নিতে হবে। বন্য প্রাণীদের আবাসস্থল ও খাবারের যোগান ঠিক রাখতে পারলেই উৎপাত থেকে রেহাই পাওয়া সম্ভব হতে পারে।

লোকালয়ে হাতি প্রবেশের পরিমাণ বেড়ে যাওয়া নিয়ে গবেষণা করেছেন বন্যপ্রাণী গবেষক চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্ট্রি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. এ এইচ এম রায়হান সরকার।

তিনি জানান, ২০১৭ সালে মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গাদের জন্য উখিয়া ও টেকনাফের পাহাড় কেটে হাতির আবাসস্থল ও চলাচলের পথ নষ্ট করা হয়েছে। হাতির আবাসস্থলের ওপর এমন আঘাত অতীতে আর কখনোই হয়নি। এছাড়া মিয়ানমার সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়ায় হাতিগুলোর সেখানে প্রবেশ বন্ধ হয়ে গেছে। সীমান্তে স্থলমাইন স্থাপনের কারণে সেই করিডোর ব্যবহার করছে না হাতির পাল। আবাসস্থল এবং মিয়ানমারে প্রবেশের সুযোগ হারিয়ে টেকনাফ থেকে হাতিগুলো এসেছে চুনতি অভয়ারণ্যে।

তিনি আরও বলেন, মিয়ানমারে যাওয়ার পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে সেই হাতিগুলো এখন চট্টগ্রামের বাঁশখালী, আনোয়ারা, সাতকানিয়া, লোহাগাড়া এমনকি পাহাড়ি পথে বোয়ালখালী পর্যন্ত চলে আসছে। বোয়ালখালীতে আমরা যেটা জেনেছি, পাহাড় ছেড়ে ১২ কিলোমিটার ভেতরে দূরে গ্রামের মধ্যে চলে এসেছে। দিন যতই যাবে, হাতিগুলো আরও বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়বে। কারণ তাদের তো বাঁচতে হবে।

এসএ

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!