বন্যপ্রাণীর স্বর্গরাজ্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে তিন শতাধিক প্রজাতির প্রাণীর বিচরণ

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমিখ্যাত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়কে (চবি) বলা হয় বন্যপ্রাণীর স্বর্গরাজ্য। চারদিকে পাহাড়ে ঘেরা ২১০০ একরের এই ক্যাম্পাসের অধিকাংশ জায়গা জুড়ে রয়েছে প্রাকৃতিকভাবে বেড়ে ওঠা গাছপালা ও ঝোপঝাড়। এসব ঝোপঝাড়ে রয়েছে বানর, বন্যশূকর, সজারু, বনরুই, মায়া হরিণ, বিভিন্ন প্রজাতির সাপ, পাখিসহ তিন শতাধিক প্রাণীর অবাধ বিচরণ। তবে অপরিকল্পিতভাবে এসব ঝোপঝাড় কেটে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবন নির্মান করা ও নির্বিচারে গাছ কাটায় এসব প্রাণীর অস্তিত্ব এখন অনেকটা হুমকির মুখে বলে জানিয়েছেন গবেষকরা।

এ ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা, প্রাণীবিদ ও পরিবেশবিদদের সমন্বয়ে কমিটি গঠন করে এ কমিটির প্রতিবেদনের উপর ভিত্তি করে ঝোপজঙ্গল ও গাছ কেটে ক্যাম্পাসের উন্নয়ন করলে পরিবেশ ও বন্যপ্রাণীদের রক্ষা করা সম্ভব হবে বলে প্রত্যাশা তাদের।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সর্বশেষ তথ্য মতে, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি) ক্যাম্পাসে বসবাস করছে ৩০৮ প্রজাতির বণ্যপ্রাণী। এর মধ্যে পাখি রয়েছে ২১৫ প্রজাতির। ব্যাঙ রয়েছে ১৭ প্রজাতির, সরীসৃপ রয়েছে ৫৬ প্রজাতির ও স্তন্যপায়ী প্রাণী রয়েছে ২০ প্রজাতির।

ক্যাম্পাসে বসবাসরত ২১৫ প্রজাতির পাখির মধ্যে ১০৮টি গায়ক ও ১০৭টি অগায়ক পাখি রয়েছে। পাখিগুলোর মধ্যে ১৬০টি প্রজাতির পাখির স্থায়ী নিবাস ক্যাম্পাসেই। ৫১টি অতিথি পাখি হিসেবে বিভিন্ন মৌসুমে ক্যাম্পাসে আসে, আবার চলে যায়। চারটি প্রজাতির পাখি রয়েছে যারা মাঝেমধ্যে আসে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও ২০ প্রজাতির বেশি প্রাণী চবি ক্যাম্পাসে রয়েছে।

বন মোরগ, মথুরা, সবুজ তাউরা, কাঠ শালিক, রেড হেডেড, ভীমরাজ, হাঁড়িচাচা, কানাকোয়া, কাবাসি, চন্দনা টিয়া, মদন টিয়া, কানাকুয়া, শিষধামা, হলদে বক, মালকোহা, পাকড়া মাছরাঙা, বসন্ত বাউরি, রুপাস নেকড, বেনেবউ এবং মৌটুসীসহ ২১৫ প্রজাতির পাখি রাজত্ব করে এই ক্যাম্পাসে। এছাড়া ক্যাম্পাসে বন্যশূকর, সজারু, বনরুই, মায়া হরিণ, বিভিন্ন প্রজাতির সাপসহ অন্যান্য প্রাণীর দেখা মেলে।

গবেষক ও শিক্ষার্থীরা বলছেন, অধিক গাছপালা ও তৎসংলগ্ন ঝোপঝাড় এসব বন্যপ্রাণীর জন্য অভয়াশ্রম। ক্যাম্পাসের উন্নয়ন করাটা যেমন জরুরি, তেমনি পরিবেশ ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ করাও জরুরি। উন্নয়নের নামে অপরিকল্পিতভাবে ঝোপঝাড় পরিষ্কার না করে জরুরি হলো পরিকল্পিতভাবে গুরুত্ব বিবেচনা করে ক্যাম্পাসের উন্নয়ন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী হুসাইন আল মামুন চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘জীববৈচিত্র্যের জন্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় অনন্য। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে বন্যপ্রাণীরা যেভাবে মুক্তভাবে চলাফেরা করে সেটা অন্য কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে তেমন একটা দেখা যায় না। ক্যাম্পাসে এই প্রাণীদের সংরক্ষণে প্রশাসনকে এ বিষয়ে এখনই সচেতন হওয়া উচিত। না হলে ধীরে ধীরে জীববৈচিত্র্য হুমকিতে পড়বে।’

যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী নূর নবী রবিন চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘ক্যাম্পাসে অবশ্যই উন্নয়নের প্রয়োজন আছে। তবে তা করতে হবে জীববৈচিত্র্য রক্ষা করে। আমাদের চারপাশ যদি ভালো না থাকে, তাহলে আমরাও ভালো থাকব না। এ বিষয়টি সবাইকে বুঝতে হবে। করোনার বন্ধে বন্যপ্রাণীরা যেভাবে ক্যাম্পাসে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে আমরা চাই সব সময়ই তারা এভাবে থাকুক।’

বন্যপ্রাণী গবেষক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের প্রফেসর মো. ফরিদ আহসান বলেন, ‘বন্যপ্রাণী বলতে আমরা বুঝি যারা জীবিকা নির্বাহের জন্য মানুষের ওপর নির্ভরশীল নয়। যারা প্রতিকূল পরিবেশে নিজেদের রক্ষা করতে জানে। তবে তারা শুধু বনজঙ্গলে বাস করবে এমনটিই নয়। আমাদের বসতবাড়ি ও পরিবেশের সাথেও তাদের বসবাস। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা এবং শিল্প উন্নয়নের পাশাপাশি বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল সংরক্ষণ করা অতীব জরুরি।’

ক্যাম্পাসের বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে করণীয় জানতে চাইলে প্রাণীবিদ্যা বিভাগের আরেক প্রফেসর ড. গাজী সৈয়দ আসমত চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘ক্যাম্পাসের বিভিন্ন জায়গায় যেভাবে অপরিকল্পিতভাবে ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে, এভাবে চলতে থাকলে এদের সংরক্ষণ করা কোনভাবেই সম্ভব হবে না। মেরিন সায়েন্স অনুষদের ভবণ নির্মান হচ্ছে, আরও বিভিন্ন জায়গায় ভবন উঠছে। এসবের কারনে প্রাণীদের আবাসস্থল নষ্ট হচ্ছে। এক্ষেত্রে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে ছাত্র-শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে একটা কমিটি গঠন করা যেতে পারে। এই কমিটির সুপারিশের আলোকে বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকান্ড পরিচালনা করা হয় তবে বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র্য রক্ষা পেতে পারে।’

এমএহক

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!