বন্দিশালা খালি চট্টগ্রাম মেডিকেলে, গুরুতর বন্দি রোগী গড়াগড়ি খায় বারান্দায়

৮ বন্দি রোগীর পাহারায় ১৪ কারারক্ষী

কারাবন্দি রোগীদের উন্নত চিকিৎসার জন্য চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রিজন সেল থাকলেও বাস্তবে সেখানে কোন বন্দি রোগীকে রাখা হয় না। হাসপাতালের পুরনো প্রশাসন ভবনের দোতলায় অবস্থিত প্রিজন সেলে যেতে চান না ডাক্তার-নার্সরা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মূলত এ কারণেই প্রিজন সেলটি অকার্যকর হয়ে রয়েছে। এমন অবস্থায় কারাবন্দি রোগীদের রাখা হচ্ছে হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ডে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। টাকার বিনিময়ে তাদের কেউ দিনের পর দিন ঝকঝকে ওয়ার্ডে কাটানোর সুযোগ পেলেও স্ট্রোক-প্যারালাইসিসের মত গুরুতর হাজতি রোগীদের আবার মাসের পর মাস পড়ে থাকতে হচ্ছে মেডিকেলের নোংরা বারান্দায়। অনেক ওয়ার্ডে আবার সাধারণ রোগীর হট্টগোলেই রাখা হচ্ছে হাজতি বন্দিদের। চট্টগ্রাম মেডিকেলের বিভিন্ন ওয়ার্ডে বর্তমানে মাত্র ৮ জন বন্দি থাকলেও তাদের পাহারার জন্য নিয়োজিত রাখা হয়েছে ১৪ জন কারারক্ষী।

খুনের মামলার আসামি ফসিউল আলমকে গত সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে চট্টগ্রাম মেডিকেলে চিকিৎসার জন্য পাঠানো হয়। তিনি সীতাকুণ্ডের যুবলীগ নেতা শওকত ইসলাম হত্যামামলার ৮ নম্বর আসামি। তাকে প্রথমে ২৭ নং সার্জারি ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়। সেখান থেকে রেফার্ড করার পর ১২ সেপ্টেম্বর তাকে ৩৮ নং গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজিস্ট বিভাগে আনা হয়।

গত রোববার (২ অক্টোবর) ৩৮ নং ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায়, ফসিউল আলম ঝকঝকে পরিস্কার একটি বেডে শুয়ে আছেন। পাশে বসে থাকা তার ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তার জন্য এখানে পরার কাপড়-চোপড় ও খাওয়া-দাওয়া বাসা থেকে আনা হচ্ছে। তিনি অপরিচ্ছন্নতা সহ্য করতে পারেন না। ফসিউল আলম নিজেও জানান, তার পেটে এখন ব্যথা নেই। অনেকটাই ভালো আছেন তিনি। জানা গেছে, ফসিউল আলমের সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে অপারেশন করার কয়েকবার তারিখ দেওয়া হলেও অপারেশন থিয়েটার থেকে তাকে ফেরত নিয়ে আসা হয়েছে অজ্ঞাত কারণে।

৩৮ নং গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজিস্ট বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. এরশাদ উদ্দিন আহমেদের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, ফসিউল আলমকে ইআরসিপি করানোর জন্য এ ওয়ার্ডে আনা হয়েছে। তবে তিন দফায় তাকে অপারেশন করাতে নিয়ে গিয়ে অপারেশন না করেই ফিরিয়ে আনা হয়েছে।

ডা. এরশাদ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আমরা আরও কয়েকবার অপারেশনের চেষ্টা করব ভাবছি। লাগুক না সময়। অপারেশন সাকসেসফুল তো হতে হবে নাকি?’

তবে এমন কালক্ষেপণে দ্বিমত প্রকাশ করে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের আবাসিক চিকিৎসক ডা. শামীম রেজা চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘হাজতী রোগীদের যদি অপারেশনের প্রয়োজন থাকে, তাহলে ওয়ার্ড থেকে স্পেশাল কেয়ার নিয়ে যত দ্রুত সম্ভব রোগীকে অপারেশন করে ফেলা উচিত। অপারেশনের নামে রোগী মেডিকেলে পড়ে থাকা—এটা কারাগারের নিয়মে নেই।’

কারাবন্দি রোগীদের সবার ভাগ্য আবার ফসিউলের মতো নয়। ঝকঝকে ওয়ার্ডে ফসিউল আলম দিনের পর দিন হাসপাতালে কাটানোর সুযোগ পেলেও স্ট্রোক-প্যারালাইসিসের মত গুরুতর হাজতি রোগীদের আবার মাসের পর মাস পড়ে থাকতে হচ্ছে মেডিকেলের নোংরা বারান্দায়। অনেক ওয়ার্ডে সাধারণ রোগীর হট্টগোলেই রাখা হচ্ছে হাজতি বন্দিদের।

অথচ চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে পাঠানো বন্দিদের এক জায়গায় রেখে চিকিৎসার জন্য চট্টগ্রাম মেডিকেলে স্থাপন করা হয়েছে প্রিজন সেল। বছরখানেক আগে হাসপাতালের পুরনো প্রশাসনিক ভবনের সামনে এই প্রিজন সেল তৈরি করা হলেও সেটি আর চালু করা যায়নি। কিন্তু সেটার তদারকিতে একজন হাবিলদার দায়িত্ব পালন করেন হাজতিশূন্য রুমে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চট্টগ্রাম মেডিকেলের ডাক্তার-নার্সরা প্রিজন সেলে গিয়ে চিকিৎসা দিতে রাজি হন না। মূলত এই কারণে প্রিজন সেল চালু করা যাচ্ছে না।

এ বিষয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডা. রাজিব কুমার পালিত চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘ওয়ার্ড থেকে প্রিজন সেলে গিয়ে হাজতি রোগীদের সেবা দেওয়া ডাক্তারদের পক্ষে দূরূহ। আমরা মেডিকেল থেকে প্রিজন সেলের জন্য ডাক্তার, নার্স বরাদ্দ দিয়েছিলাম। কিন্তু ডাক্তাররা তা মানেননি। আর তাই প্রিজন সেলটাও কার্যকর হয়নি।’

তবে ডা. রাজিব পালিত এও বলেন, ‘সেলে রাখলে রোগীরা যেমন ট্রিটমেন্ট পাবে, ওয়ার্ডে তার চেয়ে ভালো চিকিৎসা সেবা পাবে।’

জানা গেছে, চট্টগ্রাম মেডিকেলের বিভিন্ন ওয়ার্ডে বর্তমানে মোট ৮ জন বন্দি চিকিৎসাধীন রয়েছেন। তাদের পাহারার জন্য প্রতি শিফটে ১৪ জন করে কারারক্ষী নিয়োজিত থাকেন। প্রিজন সেলের মত সুরক্ষিত কারাগার খালি পড়ে থাকলেও কোনো কোনো ওয়ার্ডে হাজতি রোগীকে রাখা হয়েছে বারান্দায়। সাধারণ রোগীদের মাঝে বসেই কারারক্ষীরা পাহারা দেন হাজতি রোগীকে।

বর্তমানে চট্টগ্রাম মেডিকেলের নতুন বিল্ডিং ৩৮ নম্বরে একজন, ১৬ নম্বর ওয়ার্ডে ২ জন, ১৪ নম্বর ওয়ার্ডে ২ জন, ১৮ নম্বরে ওয়ার্ডে একজন, ১৩ নম্বরে ওয়ার্ডে একজন, ২৭ নম্বরে ওয়ার্ডে একজন হাজতি রোগী অবস্থান করছে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, ১৬ নম্বর মেডিসিন ওয়ার্ডের দক্ষিণ পাশের বারান্দায় রাখা হয়েছে দুই হাজতিকে। এদের মধ্যে একজন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি আব্দুস সোবহান। তার বাম পাশ প্যারালাইজড, পেটে আছে ব্যাথাও। অপর হাজতি সাতকানিয়ার আব্দুল আলীম এলার্জিতে আক্রান্ত। সারা শরীরে লাল রাশের মত চাকা চাকা বের হয়েছে।

১৮ নম্বর ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন হাজতি নূরুল আবছার চেক ডিজঅনারের মামলায় তিন মাসের কারাদণ্ড ভোগ করছেন। প্রথম দফায় তিনি স্ট্রোক করেন বাড়িতে থাকা অবস্থায়। পরে কারাগারে আসার পর তিনি দ্বিতীয়বার স্ট্রোক করেন। শনিবার (১ অক্টোবর) দুপুরে চট্টগ্রাম মেডিকেলে গিয়ে দেখা গেছে, হাতকড়া পরা অবস্থায় বেহুঁশ হয়ে বেডে শুয়ে আছেন নূরুল আবছার।

জানা গেছে, চট্টগ্রাম মেডিকেলে চিকিৎসাধীন ৮ জন বন্দির জন্য চার শিফটে ২ জন করে কারারক্ষী প্রতি হাজতির জন্য দায়িত্ব পালন করেন। দুজন ৮ ঘন্টা করে ওয়ার্ডের ভিতরে হাজতিকে পাহারা দেন। সবমিলিয়ে ৮ জন বন্দির জন্য ৮ ঘন্টার শিফটিং ডিউটিতে ১৪ জন কারারক্ষী নিয়োজিত থাকলে খোদ চট্টগ্রাম কারাগারেই রয়েছে কারারক্ষী সংকট। এই সংকটে কারাগারের স্বাভাবিক কাজকর্মও ব্যাহত হয় বলে জানা গেছে। চট্টগ্রাম কারাগারে ৩৫০ জন কারারক্ষীর মধ্যে আছেন ৩০৬ জন। পদ শূন্য রয়েছে ৪৪ জনের। প্রধান কারারক্ষীর ১৫ জনের মধ্যে ৩টি পদ শূন্য রয়েছে। সহকারী প্রধান কারারক্ষীর ৩০ জনের মধ্যে পদ শূন্য রয়েছে ৬টি।

চট্টগ্রাম মেডিকেলে কর্তব্যরত কারারক্ষীরা জানান, একজন হাজতির জন্য দীর্ঘ সময় এভাবে বসে থাকাটা ‘পেইনফুল’। প্রিজন সেলটা কার্যকর হলে এতো কারারক্ষীর দরকার হত না। আর কয়েদিরা নিরাপদ ও সুরক্ষিত থাকত। এভাবে খোলামেলা পরিবেশে সাধারণ রোগীর সাথে বন্দির বসবাস অনেকটা নিরাপত্তার হুমকি হয়ে যায়। সাধারণ রোগীরা আমাদের দেখে। হাতকড়া পরা হাজতি রোগীকে দেখে ভীতও হয়ে পড়ে অনেকে।

শনিবার (১ অক্টোবর) দুপুর দেড়টার দিকে প্রিজন সেলে গিয়ে দেখা গেছে, ওই সেলের ইনচার্জ সিরাজ হাবিলদার ফাঁকা রুমে বসে ঝিমুচ্ছেন। কাররক্ষীরা মাঝে মাঝে ডিউটি থেকে এসে এখানে বিশ্রাম নিয়ে থাকেন। দুপুর দেড়টার দিকে এ সেলের ভিতরে গিয়ে রুমের সব ফ্যান চলতে দেখা গেছে। সেলটিতে পুরুষ ওয়ার্ড, মহিলা ওয়ার্ড, ডাক্তারদের রুম তালাবদ্ধ দেখা গেছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, চট্টগ্রাম কারাগারের উর্ধতন কর্মকর্তাদের ‘ম্যানেজ’ করার পরই মূলত হাজতি রোগীদের চট্টগ্রাম মেডিকেলে আসার আবেদন মঞ্জুর হয়। এরপর মেডিকেলে এসে প্রিজন সেলের ইনচার্জ সিরাজ হাবিলদারকে নিদিষ্ট অংকের অর্থ পরিশোধ করে মেডিকেলে দীর্ঘদিন থাকা যায়। রোগী হাজতিদের বিভিন্ন ওয়ার্ডে গিয়ে নজরদারির দায়িত্ব থাকলেও হাবিলদার সিরাজ তার সাথে যেসব হাজতির ‘কন্ট্রাক্ট’ আছে শুধু তাদের কাছেই যান। যেমনটি ঘটেছে ৩৮ নম্বর গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজিস্ট ওয়ার্ডের বন্দি রোগী ফসিউল আলমের ক্ষেত্রে। ফসিউল আলমের অপারেশন অত্যাবশ্যক ও জরুরি হয়ে পড়লেও একমাস ধরে তার অপারেশন পেছাচ্ছে একের পর এক। কয়েকবার তাকে অপারেশন থিয়েটার থেকে ফেরত আনা হয়েছে অজ্ঞাত কারণে।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!