বদলে যাওয়া দুই ত্রিপুরা পল্লী ত্রাণ পেল ব্যতিক্রমী নিয়মে

করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে ত্রাণ গ্রহণের কথা শুনলেই আমাদের চোখের সামনে ভাসে ভীড়, ধাক্কাধাক্কি, কাড়াকাড়ি, আর দাতার দাঁত কেলানো ফটোসেশন। কিন্তু তথাকথিত সভ্য সমাজের তকমাহীন সেই সোনাই ত্রিপুরা পল্লী আর মনাই ত্রিপুরা পল্লীর অধিবাসী পরিবারগুলো ত্রাণ গ্রহণ করলেন ব্যতিক্রমী এক উপায়ে। পাহাড়ের পাদদেশে উন্মুক্ত ফসলের মাঠে ত্রাণদাতা নিরাপদ দূরত্বে ত্রাণের প্যাকেট সাজিয়ে রেখে দূরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। পরিবারের সদস্যরা এসে সুশৃঙ্খলভাবে যার প্যাকেট সে নিয়ে চলে গেলেন।

বুধবার (৩১ মার্চ) পড়ন্ত বিকেলে চট্টগ্রামের হাটহাজারীর সেই দুই ত্রিপুরা পল্লীতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার ব্যক্তিগত ত্রাণ বিতরণ ঠিক এভাই হলো।

প্রসঙ্গত, হাটহাজারী-নাজিরহাট মহাসড়কের অদূরের পাহাড়ে এই দুটি পল্লী ছিল যেন বাতির নিচে অন্ধকার। ২০১৮ সালে অজ্ঞাত রোগে সোনাই ত্রিপুরা পল্লীতে কয়েকজন শিশু মৃত্যুবরণ করে। তারপর আলোচনায় আসে এই পল্লী দুটি। শিশুদের মৃত্যুর কারণ নির্ণয় হয় হাম। অন্যান্য শিশুরা ছিল চরম পুষ্টিহীনতায়। ছিলনা শিক্ষা আর বিদ্যুতের আলো। খাবার পানি বলতে পাহাড়ী ঝিরি, স্যানিটেশনও ছিল গাছতলা কিংবা ঝোপঝাড়ের আড়াল।

এই দুই পল্লীর মানুষজন অন্যের ক্ষেতে বর্গা চাষ কিংবা দিনমজুরি করে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করতো। যে পাহাড়ে বসবাস, তার মালিকানাও তাদের নয়। পাহাড়ধসের শিকারও হয়েছে এই দুই পল্লীর মানুষজন। যাতায়াতে ব্যবহার করতো দুই কিলোমিটার পথ ধানি জমির আইল। এদের জীবন মান কেমন ছিল তা সহজেই আঁচ করা যায়।

সোনাই ত্রিপুরা পল্লীতে শিশুমৃত্যুর ঘটনায় টনক নড়ে স্থানীয় প্রশাসনের। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের প্রতি তৈরি হয় ক্ষোভও। হাটহাজারী উপজেলার ফরহাদাবাদ ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়াডেই মনাই ত্রিপুরা পল্লী। পাশেই সোনাই ত্রিপুরা পল্লী। প্রশাসনের তাৎক্ষণিক পদক্ষেপে মনাই ত্রিপুরার শিশুরা সুচিকিৎসা পেয়ে অপমৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে যায়।

ওই পাড়ার কোন রোগী হাসপাতালে যেতে হলে ধানি জমির আইলে দুই কিলোমিটার পথ আরেকজনের কাঁধে চড়ে তারপর রিক্সা কিংবা সিএনজি চলাচলের রাস্তা পাওয়া যেতো। পরিবারের নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে ঘরে ফেরার সময়ও একই অবস্থা ছিল। রিক্সা কিংবা ট্যাক্সি থেকে নেমে সেই দুই কিলোমিটার পথ বোঝা কাঁধে নিয়ে ঘরে ফিরতে হতো। শিশুমৃত্যুর ঘটনা জেলা প্রশাসক মো. ইলিয়াছ হোসেন, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রুহুল আমিনসহ প্রশাসনের কর্মকর্তাও বর্ষায় কাদা মাড়িয়ে ওই দুই পাড়ায় গিয়েছিলেন।

২০১৯ সালটা ছিল শুধুই বদলে যাওয়ার। আইলে পরিবর্তে এখন ওই দুই কিলোমিটার পথে মাটির সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে। ফলে এই দুই পল্লীর কপাল থেকে দুর্গম শব্দটা দূর হয়েছে।

এখন ত্রিপুরা পল্লীর শিশুরা আগের মতো অপুষ্টিতে ভুগছে না। থাকছে না শিক্ষাবঞ্চিত। চালু হয়েছে মন্দিরভিত্তিক স্কুল, হিন্দু ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্ট থেকে অনুমোদিত হয়ে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে শিক্ষকও।

জেলা প্রশাসক মো. ইলিয়াছ হোসেন চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, এই দুই পল্লীতে পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারী পরিবারগুলোকে সমতলে খাস জমিতে নির্মাণ করে দেওয়া হয়েছে সেমিপাকা ঘর। যে পাড়ার মানুষজন পাশের বাজারে গিয়ে ঘন্টায় ১০ টাকার বিনিময়ে মোবাইল চার্জ দিতো, সেখানে আজ সৌরবিদ্যুতের আলোয় ঝলমল দৃশ্য। দুই পাড়ায় ৮টি স্যানেটারি ল্যাট্রিন নির্মাণ করা হয়েছে। সুপেয় নিরাপদ পানির জন্য পাঁচটি টিউবওয়েল স্থাপন করা হয়েছে।

এছাড়াও ৬০ জন শিক্ষার্থীকে ‘জেলা প্রশাসক প্রাথমিক শিক্ষা বৃত্তি’ দেওয়া হচ্ছে। ৬০ শিক্ষার্থীকে স্কুলের ইউনিফর্ম দেওয়া হয়েছে। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক উপকরণও সরবরাহ করা হয় বলে জানান জেলা প্রশাসক।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. রুহুল আমিন জানান, হাম রোগে শিশু মৃত্যুর ঘটনায় মূলত এই দুই ত্রিপুরা পল্লী আলোচনায় আসে। সরকার তথা জেলা প্রশাসনের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে গেল দুই বছরে তাদের জীবন মানের ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। করোনাভাইরাস রোধে সরকারের সাধারণ ছুটির মধ্যে অনেকের মতো এই দুই পল্লীর কর্মক্ষমরাও কর্মহীন। তাই ব্যক্তিগত উদ্যোগে ১০৭ পরিবারের মাঝে ত্রাণ বিতরণে আসলাম। পাশের জমিতে নির্দিষ্ট স্থানে ত্রাণ রাখলাম। তারা খুব সুশৃঙ্খলভাবে এসে যার যার ত্রাণ সংগ্রহ করলেন। দেখে খুব ভালো লাগলো।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!