বছর গেলেও চকবাজারের অনিক হত্যার বিচার পায়নি পরিবার

খুনিদের হুমকিতে উল্টো জীবনশংকায় পুরোপরিবার

একবছর পার হলেও অনিক হত্যার বিচার পায়নি পরিবার। হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে মামলা করে উল্টো বিপাকে পড়েছে তারা। হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতরা একের পর এক জামিনে বেরিয়ে এসে অনিকের পরিবারকে দফায় দফায় হত্যার হুমকি দিচ্ছেন। খুনিদের হত্যার হুমকিতে নিয়ে নিজেদের জীবন নিয়ে শংকায় দিন কাটাচ্ছে পরিবারটি। অনিক হত্যার একবছর পূর্ণ হবার দিন সোমবার (১৭ জুন) সকালে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করেছেন নিহত অনিকের পরিবার ও এলাকাবাসী।

গত বছরের ১৭ জুন রাত আটটায় (ঈদের দ্বিতীয় দিন) চকবাজার থানার দামপাড়ার দুই নম্বর পল্টন রোডের মুখে খুন হন আবু জাফর অনিক (২৬)।

নিহত অনিকের বাসায় গিয়ে দেখা যায়, অনিকের মা আকতার বেগম ও বাবা নাছির উদ্দিন সন্তানের ছবি বুকে জড়িয়ে ধরে অঝোরে কাঁদছেন। কাঁদতে কাঁদতে অনিকের মা কথা বলার সক্ষমতা হারিয়েছেন।

অনিকের বাবা বললেন, ‘আওয়ামী রাজনীতির সাথে জড়িত থেকেও ছেলে হত্যার বিচার না পাওয়া ও দফায় দফায় হত্যার হুমকি পাওয়া হতাশার ও ক্ষোভের।’

নিহত অনিকের বাবা নাছির ও মা আকতার বেগম বলেন, ‘আমার ছেলের খুনিদের ফাঁসির জন্য কিছু লিখেন। আমরা অসহায়। বাবার সামনে সন্তানকে হত্যা করে খুনিরা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। আমরা সন্তান হারানোর বেদনা নিয়ে খুনিদের হুমকিতে শংকায় দিন কাটাচ্ছি। গত একবছর ধরে আদালতের দ্বারে দ্বারে ঘুরছি বিচারের আশায়। অভিযুক্তরা জামিনে বেরিয়ে এসে হুমকি দিচ্ছে বড় ছেলেকে মেরেছি। ছোট ছেলে রনিককেও শেষ করে ফেলবো।’

জানা যায়, ওই ঘটনার পর আসামি মহিউদ্দিন তুষার ও এখলাস বেনাপোল হয়ে ভারতে পালিয়ে যান। বেনাপোল সীমান্ত থেকে ২৬ জুন তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। পরবর্তীতে আসামিরা জামিনে বেরিয়ে যায়। তবে মিন্টু এখনও কারাগারে রয়েছেন। অভিযুক্তরা কারাগার থেকে বেরিয়ে ছোট ছেলে রণিককে মেরে ফেলার হুমকি দিচ্ছেন বলে অভিযোগ করেছেন অনিকের পরিবার।

নিহত অনিকের বাবা মো. নাসির ও মা আকতার বেগম কান্নাজড়িত কন্ঠে বলেন, ‘আমার ছেলে হত্যার বিচার চাই। ওরা কারাগার থেকে বেরিয়ে ইফতার পার্টি করছে। এখন আমার ছোট ছেলেকে মেরে ফেলার হুমকি দিচ্ছে। আমরা গরিব মানুষ, কোথায় যাব? ছেলের হত্যাকারীদের দ্রুত ফাঁসি চাই।’

১৫ নম্বর বাগমনিরাম ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মো গিয়াস উদ্দিন জানান, ‘আমরা চাই এই হত্যার সুষ্ঠু বিচার হোক। সঠিক তদন্তের মাধ্যমে অভিযুক্তদের গ্রেপ্তার করা হোক।’

এ মামলার আইনজীবী জোবাইদা সরওয়ার চৌধুরী জানান, ‘অভিযুক্তরা অল্প সময়ে জামিনে বেরিয়ে গেছে। মামলার ব্যাপারে প্রশাসনের গাফিলতি রয়েছে।’

মামলার তদন্ত অফিসার মো ইয়াসির আরাফাত জানান, ‘১৯ জুনে ১২জনের নামে মামলা হয়েছে তাদের দোষী করে চার্জশিট দিয়েছি।

এ বিষয়ে নিহতের বাবা মা জানান, ‘তারা চার্জশিটের ব্যাপারে কিছু জানেন না।’

উল্লেখ্য, গত বছরের ১৭ জুন রাত আটটায় (ঈদের দ্বিতীয় দিন) চকবাজার থানার দামপাড়ার দুই নম্বর পল্টন রোডের মুখে খুন হন আবু জাফর অনিক (২৬)। ঘটনার সূত্রপাত হয়েছিল সেদিন বিকেল বিকেল চারটায়। অনিকের ছোট ভাই আবু হেনা রনিক বন্ধুদের নিয়ে মোটরসাইকেলে নগরীর ব্যাটারি গলির মুখে যাওয়ার সময় ইমনের গায়ে বাতাস লাগে। এতে ইমন উত্তেজিত হয়ে রনিককে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করেন। পরে রনিকের সাথে বাকবিতণ্ডায় মহিউদ্দিন তুষার (৩০) ইমনসহ চার-পাঁচজন মিলে তাকে মারতে থাকেন। জড়ো হওয়া লোকজন ঈদের ছুটির পর বিষয়টি মীমাংসা করবে বলে দুই পক্ষকে শান্ত করেন।

একই দিন রাত সাড়ে আটটায় নিহত আবু জাফর (২৬) ও বাবা মো. নাসির, মো. কফিল, মো. জাহাঙ্গীর, মো. আফসার, দুই নম্বর পল্টন রোডের মুখে গল্প করছিল। ওই সময় মো মহিউদ্দিন তুষার পিস্তলসহ বারজনের একটি দল কিরিচ, রামদা, রড ও লাঠি নিয়ে তাদের উপর হামলা করে। অনিক ও তার বাবা মো. নাসের তাদের শান্ত করার চেষ্টা করেন। এ সময় অভিযুক্তরা অনিককে মারতে থাকে। বাবা মো. নাসের ছেলেকে বাঁচাতে মহিউদ্দিন তুষারকে জাপটে ধরে রাখেন। এ সময় মিন্টু অনিককে কোমরের পেছনে ছুরিকাঘাত করেন। অনিক বাবার কোলে ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে পড়েন। পরে তাকে চমেক হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

এরপর ১৮ জুন চকবাজার থানায় ১২ জনকে আসামি করে নিহতের বাবা মো নাসের থানায় মামলা করেন। মামলায় অভিযুক্তরা হলেন মো মহিউদ্দিন (৩০), মিন্টু (৩২), ইমরান শাওন (২৬), ইমন(১৬), শোভন (২৪), অপরাজিত (২২), অভি (২১), বাচা(২২), এখলাস(২২), দুর্জয় (২১), অজয় (২১)।

অনিক হত্যার বিচারের দাবিতে পরিবারের সংবাদ সম্মেলন
অনিক হত্যার বিচারের দাবিতে পরিবারের সংবাদ সম্মেলন

অনিক হত্যার বিচারের দাবিতে পরিবারের সংবাদ সম্মেলন
অনিক হত্যার একবছর পূর্ণ হবার দিন সোমবার (১৭ জুন) সকাল এগারোটায় চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করেছেন নিহত অনিকের পরিবার ও এলাকাবাসী।

লিখিত বক্তব্যে অনিকের বাবা মো. নাসির বলেন, মোটরসাইকেলের হর্ন বাজানোকে কেন্দ্র করে ঈদের পরদিন চট্টেশ্বরী মোড়ের পল্টন রোডে প্রকাশ্যে যুবলীগ নামধারী মহিউদ্দিন তুষারসহ ২০ জন সন্ত্রাসী আমার ছেলে আবু জাফর অনিককে প্রকাশ্যে হত্যা করে। ওইদিন ছিল বাবা দিবস। বাবা দিবসেই খুনিরা আমার ছেলেকে আমার সামনে ছুরিকাঘাত করে হত্যা করে। আমার ছেলে আমার বুকেই মারা যায়।

আমার ছেলে কোন রাজনীতি করতো না। ঘটনার দিন (১৭ জুন ২০১৮) বিকেল চারটায় আমার ছোট ছেলে আবু হেনা রণিক মোটরসাইকেল নিয়ে ব্যাটারি গলি এলাকায় যাচ্ছিল। এ সময় জোরে হর্ন দেওয়াকে কেন্দ্র করে মহিউদ্দিন তুষার (৩০) ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা আমার ছোট ছেলেকে অকথ্য গালি ও মারধর করে। আমি মীমাংসার জন্য আমার বড় ছেলে আবু জাফর অনিককে নিয়ে রাস্তায় আসি। কিছু বুঝে উঠার আগেই মহিউদ্দিন তুষার প্রায় ২০ জন সন্ত্রাসী নিয়ে প্রকাশ্যে গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে আসে। আমার সামনে আমার ছেলেকে ছুরিকাঘাত করে হত্যা করে।

তিনি আরও বলেন, আমি আওয়ামী লীগ পরিবারের সন্তান। আমার বাবা মরহুম আবদুল খালেক ১৯৭১ সালে দামপাড়া পুলিশ লাইনে পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেছিলেন। আমি চকবাজার থানা আওয়ামী লীগের কার্যকরী সদস্য। অথচ খুনীরা সরকারি দলের নাম ব্যবহার করে প্রকাশ্যে ঘুরছে। জাতির জনক ও প্রধানমন্ত্রীর ছবি দিয়ে ব্যানার করে ইফতার মাহফিল ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতার সাথে ছবি আপলোড করে ক্ষমতার দম্ভ করছে। এসব দেখে আমার আত্মহত্যা করতে ইচ্ছে করছে।

তিনি আক্ষেপ করে বলেন, সারাজীবন আমি ও আমার পরিবার আওয়ামী লীগ করেছি। সন্তান হত্যার বিচার না পেয়ে আজ আমি অসহায়!

আওয়ামী লীগ নেতা মৃত জহুর আহমদ চৌধুরীর ছেলে শরফুদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘এটি নির্মম হত্যাকাণ্ড। ঈদের পরদিন বাবার সামনে ছেলেকে প্রকাশে হত্যা করেছে তারা। এই হত্যামামলাটি বিশেষ ট্রাইব্যুনালে যাওয়া উচিত। খুনের তিনদিনের মাথায় তাদের গ্রেফতার করা হয়েছিল ঠিক তেমনি বিচারও দ্রুত করার দাবি জানাই।’

সভায় আরো উপস্থিত ছিলেন অনিকের বাবা মো. নাসির, মা আকতার বেগম, চাচি শারমিন আকতার, চাচা আবু সাহেদ সুমন, শরফুদ্দিন চৌধুরী ,আবুল বশর, সৈয়দ আহমদ, মো. হারুণ, অমিনুল ইসলাম প্রমুখ।

এসএস

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!