বঙ্গবন্ধুর তিন দুর্লভ চিঠি

সম্প্রতি বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের তিনটি মূল্যবান পত্র সংগৃহীত হয়েছে। এর মধ্যে একটি পত্রের পুরোটা বঙ্গবন্ধুর হাতে লেখা। অপর পত্র দুটি বঙ্গবন্ধুর স্বাক্ষরিত। এখানে বলে রাখা প্রয়োজন আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনার গুরুত্বপূর্ণ উপাদান বা নিদর্শন সংগ্রহ করা জাদুঘরের অন্যতম প্রধান কাজ। বঙ্গবন্ধুর আলোচ্য তিনটি পত্রের মধ্যে দুটি পত্র ২০১৭ সালের ১৮ মে জাদুঘরে সংগৃহীত হয়। বঙ্গবন্ধুর স্বহস্তে লিখিত অপর পত্রটি ওই বছরের ২ মে সংগৃহীত হয়। জাদুঘরে সংগৃহীত বঙ্গবন্ধুর স্বহস্তে লেখা/স্বাক্ষরিত তিনটি পত্রের বর্ণনা নিচে দেওয়া হলো।

প্রথম পত্র
এই পত্রটি ১৯৭৩ সালের ৪ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধুর স্বহস্তে সিলেটের ভাষাসংগ্রামী কনাই মিয়া তালুকদারকে লিখিত। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মনোগ্রাম এবং ‘শেখ মুজিবুর রহমান’ নাম সংবলিত প্যাডে বঙ্গবন্ধুর স্বহস্তে পত্রটি লিখিত। এর একদিকে লেখা রয়েছে। পত্রের শেষে বঙ্গবন্ধুর পুরো নামযুক্ত স্বাক্ষর রয়েছে। যার পরিমাপ ২৯.২ু২১ সেন্টিমিটার। সিলেট নিবাসী যুদ্ধাহত রাজিউল ইসলাম তালুকদার রাজু ০২/০৫/২০১৭ তারিখ পত্রটি জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষণের জন্য জাদুঘরের মহাপরিচালক ফয়জুল লতিফ চৌধুরীর কাছে উপহারস্বরূপ প্রদান করেন।

পত্রের প্রতিলিপি:
(মনোগ্রাম) (শেখ মুজিবুর রহমান
তারিখ ৪/১২/৭৩

আল্লাহ সর্বশক্তিমান
আচ্ছালামু আলাইকুম, ভাষা সৈনিক জনাব কনাই মিয়া তালুকদার সাহেব, আপনার দরখাস্তের আলোকে আপনাকে জানানো যাচ্ছে যে, আপনার ছেলে রাজিউল ইসলাম তালুকদার রাজু মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে আহত অবস্থায় চিকিৎসার পরেও মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে যাওয়ায় তার চিকিৎসার জন্য আরও ৩০০০/- (তিন হাজার) টাকা আমার ত্রাণ তহবিল থেকে বরাদ্দ করিলাম।

দেওয়ান ফরিদ গাজী, পীর হাবিবুর রহমান ও নজীর চৌধুরী আমাকে আপনার ছেলে সম্বন্ধে বলেছেন সে মারাত্মক আহত অবস্থায় চিকিৎসাধীন আছে। পরবর্তীতে চিন্তা করিব। দেশ স্বাধীনের আগে আপনার সাথে আমার প্রথম দেখা ভারতে, দেশেও কয়েকবার দেখা হয়েছে। আপনি নিজেও ১৯৪৭ হইতে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে ও ৫২ এর ভাষা আন্দোলনে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে এলাকা ও শহরতলীতে সুনামের সহিত একজন সংগঠক হিসাবে ভূমিকা পালন করেছেন। আমি আপনাকে ভুলি নাই। আপনাকে ধন্যবাদ। ইতি

শেখ মুজিবুর রহমান (স্বাক্ষর)
৪/১২/৭৩

উপরে বর্ণিত পত্রের উপহারদাতার রাজিউল ইসলাম তালুকদার রাজুর কাছ থেকে জানা গেছে, ১৯৭১ সালে তিনি অষ্টম শ্রেণির ছাত্র ছিলেন। দেশ মাতৃকার টানে এপ্রিলের শেষ দিকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য ট্রেনিং নিতে তিনি ভারতের আসামে যান এবং লোহারবন ট্রেনিং ক্যাম্পে ২৮ দিনের ট্রেনিং নেন। এরপর মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণের জন্য ৪ নম্বর সেক্টরে যোগদান করেন। আগস্টের শেষের দিকে সিলেট সংলগ্ন বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তবর্তী বাঙ্গা অঞ্চলে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর সঙ্গে এক সম্মুখযুদ্ধে মর্টার সেলের আঘাতে তিনি মারাত্মকভাবে আহত হন। মাথার ডান ভাগ, ডান গাল এবং ডান পায়ে তিনি দারুণভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হন। মুক্তিযোদ্ধা রাজিউল ইসলামের বাবাকে বঙ্গবন্ধু এই পত্র লিখেছিলেন। পত্রে রাজিউল ইসলামের ‘চিকিৎসার জন্য আরও ৩০০০/- টাকা’ বরাদ্দের উল্লেখ রয়েছে। এ থেকে বোঝা যায়, এর আগেও রাজিউল ইসলামকে সরকারি সাহায্য দেওয়া হয়েছে। যে পত্রের মাধ্যমে এর আগে সরকারি সাহায্য দেওয়া হয়েছে, সেই পত্রটিও জাদুঘরে সংগৃহীত হয়েছে। যার বর্ণনা নিম্নরূপ:

দ্বিতীয় পত্র
পত্রটি রাজিউল ইসলাম তালুকদার রাজু ১৮ মে ২০১৭ তারিখ জাদুঘরে আন্তর্জাতিক জাদুঘর দিবসের এক অনুষ্ঠানে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তর করেন, যা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মনোগ্রাম এবং ‘শেখ মুজিবুর রহমান’ নাম সংবলিত প্যাডে পত্রটি প্রিন্ট করা। পত্রের শেষে বঙ্গবন্ধুর স্বাক্ষর রয়েছে। যার পরিমাপ ২৪.৫ু২০.৮ সেন্টিমিটার। পত্রটি দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত, পাতার অনেক অংশই নেই। পত্রটির অংশ বিশেষ আগুনে পুড়ে গিয়ে থাকতে পারে। প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ ও কল্যাণ তহবিল থেকে ১০০০ টাকার অনুদান সংবলিত বঙ্গবন্ধুর স্বাক্ষরিত এই পত্রটি যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা রাজিউল ইসলাম রাজুকে প্রেরিত।

পত্রের প্রতিলিপি :
(মনোগ্রাম) (শেখ মুজিবুর রহমান)
নং প এ/ক/৬-৪-৭২/সিডি/৪৫ তাং ৩/১

প্রিয় ভাই/বোন,
আপনি দেশ প্রেমের সুমহান আদর্শ ও প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশ মাতৃকার মুক্তি সংগ্রামে সক্রিয়ভাবে অংশ গ্রহণ করে পাক হানাদার দসু্যু বাহিনীর হাতে গুরুতর ভাবে আহত হয়েছেন।

এই দুঃসাহসিক ঝুঁকি নেয়ার জন্য আপনাকে জানাচ্ছি আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা। আপনার মতো নিঃস্বার্থ দেশ-প্রেমিক বীর সন্তানরাই উত্তরকালে আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের নিশ্চয়তায় এক অত্যুজ্জ্বল আদর্শ হিসেবে প্রেরণা যোগাবে।

‘প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ ও কল্যাণ তহবিল’ থেকে আপনার ও আপনার পরিবারের উপকারার্থে আপনার সংশ্লিষ্ট মহাকুমা প্রশাসকের নিকট ১০০০/- টাকার চেক প্রেরিত হ’ল। চেক নম্বর সি,এ ০২৪২০৭।
আমার প্রাণভরা ভালবাসা ও সংগ্রামী অভিনন্দন নিন।

রাজিউল ইসলাম তালুকদার রাজু
গ্রাম- ভাঙ্গি
পো.- আলোমুখ বাজার, শেখ মুজিব(স্বাক্ষর)
থানা-কোতোয়ালী
সিলেট
পত্রে পূর্ণাঙ্গ তারিখ লেখা নেই। তারিখ লেখা আছে ৩/১ অর্থাৎ সালের উল্লেখ নেই। উপরে বর্ণিত প্রথম পত্রটি বঙ্গবন্ধু কর্তৃক ৪/১২/৭৩ তারিখে লিখিত। ওই পত্রে এর আগেও রাজিউল ইসলামকে সরকারি সাহায্য প্রদানের ইঙ্গিত রয়েছে। কাজেই দ্বিতীয় পত্রটি ১৯৭৩ সালের ডিসেম্বরের আগে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক স্বাক্ষরিত এতে কোনো সন্দেহ নেই। দ্বিতীয় পত্রটি ১৯৭২ সালের ৩ জানুয়ারিতে স্বাক্ষরিত হতে পারে না কারণ বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরেছেন ১০ জানুয়ারি। ফলে এই পত্রটি ১৯৭৩ সালের ৩ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু কর্তৃক স্বাক্ষরিত এতে কোনো সন্দেহ নেই।

তৃতীয় পত্র
দিনাজপুর জেলার পার্বতীপুর উপজেলার হোসেনপুর গ্রামের মুহা. রেজাউল করিম চৌধুরী এই পত্রটি ১৮ মে ২০১৭ তারিখ জাতীয় জাদুঘরে উপহারস্বরূপ আনুষ্ঠানিকভাবে প্রদান করেন। যে অনুষ্ঠানের কথা উপরে বলা হয়েছে। পত্রটি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মনোগ্রাম ও ‘শেখ মুজিবুর রহমান’ লেখা প্যাডে প্রিন্ট করা। পত্রটির পরিমাপ ২১.৫ু১৭ সেন্টিমিটার। প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ ও কল্যাণ তহবিল থেকে ২০০০ টাকা সাহায্য সংবলিত বঙ্গবন্ধু স্বাক্ষরিত এই পত্রটি মোছা. লুৎফননেছা, স্বামী মৃত মো. আজিজুর রহমান চৌধুরী, গ্রাম পূর্ব হোসেনপুর, ডাকঘর আফতাবাবাদ, জেলা দিনাজপুরকে প্রেরিত। এই পত্রের উপহারদাতা দিনাজপুর জেলাধীন পার্বতীপুর থানার পূর্ব হোসেনপুর গ্রামের মোহা. রেজাউল করিম চৌধুরীর কাছ থেকে জানা যায় যে, শহীদ মো. আজিজুর রহমান চৌধুরী তাঁর পিতা। মো. আজিজুর রহমান চৌধুরী ১৯৭১ সালে হরিরামপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গেও সম্পৃক্ত ছিলেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তিনি নানাভাব মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করতেন। ১৯৭১ সালের ২ ডিসেম্বর নিজ বাসভবনে রাজাকারদের সহায়তায় পাক হানাদার বাহিনীর গুলিতে মো. আজিজুর রহমান চৌধুরী ও তাঁর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা মতিউর রহমান চৌধুরী শহীদ হন। মুক্তিযুদ্ধে নিহত মো. আজিজুর রহমান চৌধুরীর পরিবারের সাহায্যের জন্য এই পত্র দেওয়া হয়েছে। (চিত্র ১.৩)।

পত্রের প্রতিলিপি:
(মনোগ্রাম) (শেখ মুজিবুর রহমান)
তাং ৬/১২
নং প্র/এ/ক-/৬-৪-৭২/সিডি/২০০৯

প্রিয় ভাই/বোন,
আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে আপনার সুযোগ্য পুত্র/পিতা/স্বামী/মা/স্ত্রী আত্মোৎসর্গ করেছেন। আপনাকে আমি গভীর দুঃখের সাথে জানাচ্ছি আমার আন্তরিক সমবেদনা। আপনার শোক-সন্তপ্ত পরিবারের প্রতিও রইল আমার প্রণঢালা সহানুভূতি।

এমন নিঃস্বার্থ মহান দেশ-প্রেমিকের পিতা/পুত্র/স্বামী/মা/স্ত্রী হওয়ার গৌরব লাভ করে সত্যি আপনি ধন্য হয়েছেন।

‘প্রাধানমন্ত্রীর ত্রাণ ও কল্যাণ তহবিল’ থেকে আপনার পরিবারের সাহায্যার্থে আপনার সংশ্লিষ্ট মহাকুমা প্রশাসকের নিকট ২,০০০/- টাকার চেক প্রেরিত হ’ল। চেক নম্বর সি,এ ০১৭১২৮।

আমার প্রাণঢালা ভালবাসা ও শুভেচ্ছা নিন।

মোছা : লুৎফননেছা শেখ মুজিব(স্বাক্ষর)
স্বামী- মৃত মো : আজিজুর রহমান চৌ:
সাং-পূর্ব হোসেনপুর
পো:- আফতাবাবাদ
দিনাজপুর।
এই পত্রে পূর্ণাঙ্গ তারিখ নেই। এখানে তারিখ লেখা আছে ৬/১২ অর্থাৎ ডিসেম্বরের ৬, এখানে সাল উল্লেখ নেই। দ্বিতীয় পত্রটি ১৯৭৩ সালের জানুয়ারিতে স্বাক্ষরিত, যার ইস্যু নম্বর ৪৫। তৃতীয় পত্রটির ইস্যু নম্বর ২০০৯। এ থেকে অনুমান করা যায় দ্বিতীয় পত্রটি তৃতীয় পত্র থেকে বেশ পরে স্বাক্ষরিত। ফলে স্বাভাবিকভাবে অনুমান করা যায় এই পত্রটি ১৯৭৩ সালের ৬ ডিসেম্বরে স্বাক্ষরিত।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের লেখা/স্বাক্ষরিত এবং উপরে বর্ণিত পত্র তিনটি মূল্যবান ঐতিহাসিক দলিল। এগুলো বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের সংগ্রহকে সমৃদ্ধ করেছে। যুগ যুগ ধরে পত্রগুলো জাতীয় জাদুঘরে যথোপযুক্তভাবে সংরক্ষিত থাকবে এবং জাতীয় জাদুঘরে আগত দর্শকরা এই মূল্যবান ডকুমেন্ট দেখার সুযোগ পাবেন। আর মহান স্বাধীনতার ইতিহাস নিয়ে যাঁরা চর্চা বা গবেষণা করেন, তাঁরা এখান থেকে ইতিহাসের নতুন তথ্য পাবেন বলে আশা করা যায়।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!