‘ফ্রি চিকিৎসা’র নামে ইবনে সিনার রোগী হয়রানি

‘ফ্রি দেখামু বইলা কি আমাদের সময়ের দাম নাই? সকাল থাইকা বইসা আছি। ডাক্তার দেখার নামগন্ধও নাই। মানুষের ধান্ধাবাজিরও সীমা থাকে। ফ্রি দেখায় ধান্ধাবাজি কইরা এরা (ইবনে সিনা কর্তৃপক্ষ) নিজেদের বাজার বাড়ায়, যাতে দলে দলে রোগী আসে আর ইনকাম করতে পারে। আর আপনারাও তাদের পিছনে পিছনে লাফান। যাচাই কইরা দেখেন না’— এভাবেই ক্ষোভ প্রকাশ করে কথাগুলো বলছিলেন গার্মেন্টসকর্মী পার্থ বিশ্বাস।

অফিস থেকে দুই ঘন্টার ছুটি নিয়ে গর্ভবতী স্ত্রী সারথি দেবীকে নিয়ে এসেছিলেন চট্টগ্রাম নগরের পাঁচলাইশ এলাকায় ইবনে সিনা ডায়াগনস্টিক সেন্টারের ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্পে। কিন্তু দুই ঘন্টার ছুটি এসে দাঁড়ায় পাঁচ ঘন্টায়, তাও দেখা পায়নি ডাক্তারের। অসুস্থ স্ত্রীকে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার দেখাতে না পেরে শেষমেশ ফিরে যান বাসায়। টানাটানির সংসারে ভিজিট দিয়ে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার দেখানোর সুযোগ মেলে না পার্থ বিশ্বাসের। তাই ফ্রিতে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার দেখাবেন বলে ফোন করে আগের দিন সিরিয়ালও নিয়েছেন। সিরিয়াল নাম্বার ছিল ৭৮। রোগী দেখার সময় দেওয়া হয় সকাল ১০টায়। সকাল ৯টার আগে গিয়ে ১.৩০ মিনিট পর্যন্ত অপেক্ষা করার পর তথ্যকেন্দ্র থেকে জানানো হয় রোগী দেখা শেষ।

গরিব ও নিম্ন আয়ের মানুষেরা কেউ অফিস থেকে ছুটি নিয়ে কেউবা অন্য সকল কাজ ফেলে ‘ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্পের’ প্রচারণা দেখে এসেছেন ফ্রিতে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার দেখাবেন বলে। কয়েকজন রোগী ফ্রিতে ডাক্তারের দেখা পেলেও অপেক্ষমান রোগীর সারি ছিল দীর্ঘ। রোদে-গরমে ভীড়ের ভেতরে অপেক্ষা করেও শেষ পর্যন্ত সাক্ষাৎ করতে পারেননি বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের সাথে। ইবনে সিনার এমন ‘ফ্রি চিকিৎসা’র খেসারত দিয়ে হয়রানির শিকার হয়েছেন অনেক রোগী।

জানা যায়, ২৯ জানুয়ারি সকাল ৯টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত নয় জন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা দেন ইবনে সিনা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে। ডায়াগনস্টিক সেন্টারের তথ্যমতে সকাল ৯ টা থেকে রাত ৮ টা পর্যন্ত টানা প্রায় ৭০০ রোগীকে বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা দেওয়া হয়। যদিও লিফলেটে দুপুর ১টা পর্যন্ত রোগী দেখার সময় নির্ধারিত ছিল। বিশেষজ্ঞ ডাক্তার দেখানোর পরে ডাক্তারের পরামর্শে কেউ পরীক্ষা নিরীক্ষা করালে সেক্ষেত্রে ৩৫% ছাড় দেওয়া হয়।

কিন্তু খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, ৪২ জন রোগী দেখার পরেই তথ্যকেন্দ্র থেকে জানানো হয় রোগী দেখা শেষ। পরবর্তীতে চিকিৎসাসেবা নিতে আসা রোগীরা ঝামেলা করলে পুনরায় ডাক্তার দেখানোর সময় দেওয়া হয় বিকেল ৪টার পরে। এদিকে বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে আক্রান্ত রোগীরা ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার দেখাতে না পেরে রাগে ক্ষোভে ফেটে পড়েন। কেউ কেউ আবার ডাক্তার না দেখিয়েই বাড়ি ফিরে যান।

কুতুবউদ্দিন রাজু নামের এক রোগী চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমি অর্থোপেডিক বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডাক্তার হোসেন আহমেদের সিরিয়াল নিছি। সিরিয়াল ছিল ৯৪। আমাকে বলা হয়েছে ১২টা ৪৫ মিনিটে আসার জন্য। আমি সাড়ে ১২ টায় গেছি। যাওয়ার পর জানালো মাত্র ৩৫ জন রোগী দেখা হয়েছে। আমার সিরিয়াল আসতে অনেক দেরি দেখে পরে বললো ৩ টার দিকে যেতে। আমি কাজ শেষ করে আড়াইটা বাজে গেলে আমাকে বলে রোগী দেখা শেষ। তখন আমার সাথে কিছুক্ষণ কথা কাটাকাটি হয়। পরবর্তীতে কাউন্টারে গেলে তারা বলে বিকেল ৪টার দিকে যেতে। কতজন রোগী দেখছেন বলতেই বলে ৪২ জন। তাইলে আপনিই বলেন, বিকেল ৩ টা পর্যন্ত যেখানে ৪২ জন রোগী দেখছে সেখানে ৪টার পরে ৯৪ নাম্বার সিরিয়াল আসতে কয়টা বাজবে? ফ্রি বলে কি এমন হয়রানি করবে?’

তিনি আরও বলেন, ‘দুপুরে যাওয়ার পরে বলে ডাক্তার চলে গেছে। ঝামেলা করায় বলছে বিকেলে আসেন। এগুলো কি মগের মুল্লুক পাইছে আমাদের সাথে। ফ্রি দেখানোর নাম করে রোগীদের হয়রানি করার কোনো মানে আছে। কেউ কেউ সেই সকাল থেকে বসে ছিল কিন্তু ডাক্তার দেখাইতে পারে নাই। ফ্রি দেখানোর নামে হয়রানি কেন?’

সালমা সুলতানা বেগম নামের এক রোগী বলেন, ‘৮৪ নাম্বার সিরিয়াল নিয়ে রেজিস্ট্রেশন করছি। সময় দিছে ১১টার পরে। আমি বাচ্চাকে নিয়ে সময়ের আরও আগেই গেছি কিন্তু তাও দেখাইতে পারি নাই। পরে বলছে ডাক্তার দেখানো শেষ। বুঝলাম না কিছুই।’

তবে এ প্রসঙ্গে ইবনে সিনা ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড কনসালটেশন সেন্টারের জনসংযোগ কর্মকর্তা মামুন সিদ্দিকী চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘নয় জন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার প্রায় ১২ ঘন্টা ৭০০ রোগীকে বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা দেন। রোগী দেখা শেষ না পর্যন্ত ডাক্তাররা চিকিৎসাসেবা দিয়েছেন।’

রোগী হয়রানির অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘নাহ নাহ। এটা একদম আমাদের সংবিধানের মত।’

এসআর/সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!