ফেসবুকে প্রেম পুলিশের, বিয়ে করতে বলায় কলেজছাত্রীকে থানায় নিয়ে বেদম মার

কলেজ ছাত্রীর সঙ্গে পুলিশ কনস্টেলের ফেসবুকের মাধ্যমে পরিচয়। তারপর দীর্ঘদিনের প্রেম ও মেলামেশা। কিন্তু বিয়ের প্রস্তাবই যেন কাল হয়েছে ওই ছাত্রীর। থানায় ওসি ও পুলিশ সদস্যরা শারীরিক নির্যাতন চালিয়েছেন বলে অভিযোগ তুলেছেন ওই ছাত্রী।

ঘটনাটি ঘটেছে কক্সবাজারের উখিয়া থানা এলাকায়। অমানবিক নির্যাতনের শিকার ওই কলেজ ছাত্রীকে বর্তমানে কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে বলেও জানা গেছে।

নির্যাতনের শিকার ওই ছাত্রীর বাড়ি মহেশখালী উপজেলায়। সে পর্যটন নগরী কক্সবাজার হার্ভাড কলেজের ছাত্রী। আর অভিযুক্ত কনস্টেবল সুমনের বাড়ি কুমিল্লা জেলার হোমনা ইউনিয়নে। তার বাবার নাম হাসান আলী। বর্তমানে ওই কনস্টেবল রাঙ্গামাঠি জেলা পুলিশে কর্মরত।

জানা গেছে, কনস্টেবল সুমন উখিয়া মরিচ্যা চেকপোস্টে দায়িত্বরত অবস্থায় ফেসবুকের মাধ্যমে ওই কলেজ ছাত্রীর সঙ্গে পরিচয় হয়। অল্প দিনে দুজনের মধ্যে গড়ে উঠে গভীর প্রেমের সম্পর্ক। এর মধ্যে কনস্টেবল সুমন ও ওই কলেজ ছাত্রীর মধ্যে শারীরিক সর্ম্পকও গড়ে ওঠে। এক পর্যায়ে ওই ছাত্রী বিয়ের প্রস্তাব দেয় সুমনকে। সেই প্রস্তাবের সূত্র ধরে গত মঙ্গলবার (৭ জুলাই) রাতে উখিয়া থানায় ওসিসহ কয়েকজন পুলিশ সদস্য হাতকড়া পরিয়ে চোখ বেঁধে এই ছাত্রীকে নির্মমভাবে শারীরিক নির্যাতন চালায় বলে অভিযোগ ওঠে।

তবে পুলিশের দাবি মেয়েটি চরিত্রহীন। ব্ল্যাকমেইল করার জন্য নানা টালবাহানা শুরু করেছে। তাকে কোনও ধরণের নির্যাতন করা হয়নি বলেও দাবি করেন উখিয়া থানার অফিসার ইনচার্জ মর্জিনা আক্তার।

এদিকে, শনিবার (১১ জুলাই) বিকেলে নির্যাতনের শিকার ওই কলেজ ছাত্রী সাংবাদিকদের বলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকের সূত্র ধরে পুলিশ কনস্টেবল সুমনের সাথে সর্ম্পক হয় প্রায় এক বছর আগে। এর মধ্যে আমাদের বেশ কয়েকবার সরাসরি দেখা হয়। শারীরিক সর্ম্পকও হয়েছে।

তিনি জানান, মরিচ্যা চেক পোস্টে দায়িত্বের সুবাদে খুনিয়াপালং ইউনিয়ন পরিষদের একটি কক্ষে সুমনসহ বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্য থাকতেন। ওই কক্ষে সুমনের সাথে দেখা করতে যেতেন তিনি। সেখানে তাদের শারীরিক সর্ম্পক হয়। এরপর থেকে কিছুদিন যোগাযোগ বন্ধ রাখেন সুমন। যোগাযোগ বন্ধ রাখার এক পর্যায়ে ৭ জুলাই (মঙ্গলবার) সকালে কথা হয় সুমনের সাথে। সুমনের কথা মতো উখিয়ার মরিচ্যায় যান সে। সেখানে তাদের বিয়ের ব্যাপারে অনেক কথা হয়। এরপর তাকে বিয়ের আশ্বাস দিয়ে বিকালের দিকে উখিয়া উপজেলার জালিয়াপালং ইউনিয়নের ইনানীতে নিয়ে যান সুমন। সেখানে তারা উঠেন সুমনের কয়েকজন বন্ধুর বাসায়।

তিনি আরও জানান, বন্ধুদের সামনেও তাদের বিয়ে নিয়ে কথা ওঠে। এক পর্যায়ে সুমন ও তার মধ্যে হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। সেখানে তারা সিদ্ধান্ত নেন মরিচ্যা গিয়ে কাজী ডেকে বিয়ে করবেন। ফের ইনানী থেকে মরিচ্যার উদ্দেশ্যে রওনা হন তারা। কিন্তু মরিচ্যায় গিয়ে বিয়ের নামে নানা টালবাহানা শুরু করে সুমন। ৭ জুলাই রাত ১০টার দিকে তাকে রাস্তায় ছেড়ে দিয়ে উধাও হয়ে যায় সুমন।

ওই ছাত্রী আরও অভিযোগ বলেন, যখন সুমন রাস্তায় ছেড়ে দিয়ে উধাও হয়ে যান, তখন ওইদিন রাত ১১টার দিকে আমি কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ইকবাল হোসাইনের সাথে ফোনে যোগাযোগ করে বিষয়টি অবগত করি। তিনি উখিয়া থানায় যোগাযোগ করে সেখানে যেতে বলেন। অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের কথায় আমি রাত সাড়ে ১১টার দিকে উখিয়া থানায় হাজির হয়ে ওসি মর্জিনা আক্তারকে সব বিষয় খুলে বলি। বলার পর থেকে আমার উপর নির্যাতন শুরু করেন ওসি।

ওই কলেজ ছাত্রী আরও বলেন, প্রথম দফায় আমাকে ব্যাপক মারধর করেন ওসি নিজেই। এরপর দ্বিতীয় দফায় কয়েকজন পুলিশ সদস্য (পুরুষ) আমাকে মারধর করে। পুলিশের ব্যাপক মারধরে আমার শরীরের বিভিন্ন জায়গা থেকে রক্তক্ষরণ হয়। পুরো শরীরে পুলিশি নির্যাতনের চিহ্ন রয়েছে। হিজাব দিয়ে চোখ বেঁধে এবং হাত কড়া পরিয়ে মারধর করা হয়। পুরুষ পুলিশ সদস্যরা তলপেটে লাথি মেরেছে বেশি। যার কারণে পরনের জামাও রক্তাক্ত হয়ে যায়। শারীরিক নির্যাতনের সময় অনেক মন্দ গালাগাল করা হয়। এসময় কনস্টেবল সুমনের সাথে যোগাযোগ না রাখার জন্য বলা হয়। যোগাযোগ রাখলে ইয়াবা দিয়ে কোর্টে চালান করে দিবে বলে হুমকি দেওয়া হয় বলে অভিযোগ করেন ওই কলেজ ছাত্রী।

তিনি আরও বলেন, পরের দিন বুধবার (৮ জুলাই) আমার বাবার সাথে যোগাযোগ করেন ওসি। বাবা উখিয়া থানায় এসে আমাকে নিয়ে যান। কিন্তু আমার মোবাইল ফোনটি রেখে দেন ওসি। বাসায় এসে বুহস্পতিবার (৯ জুলাই) চকরিয়ার একটি হাসপাতালে গেলে আমার শরীরে আঘাতের চিহ্ন দেখে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা আমাকে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে রেফার করেন।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে কনস্টেবল সুমনের ব্যবহৃত মোবাইলে একাধিক বার কল করা হলেও রিসিভ করেনি। ফলে এ বিষয়ে তার কোনও বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

এদিকে, রোববার (১২ জুলাই) সকালে এ বিষয়ে জানতে চাইলে উখিয়া থানার অফিসার ইনচার্জ মর্জিনা আক্তার মারধরের বিষয়টি অস্বীকার করেন। উল্টো ওই ছাত্রীকে চরিত্রহীন দাবি করে নানা মন্তব্য করেন।

ওসি বলেন, ওই নারী রাত ১১টার দিকে অভিযোগ নিয়ে থানায় এসেছিল। পরে তার অভিযোগের প্রেক্ষিতে কনস্টেবলের বিষয়ে দাপ্তরিকভাবে উপর মহলে জানানো হয়। কিন্তু মেয়েটি অত্যন্ত খারাপ চরিত্রের। তার মোবাইলেও অনেক খারাপ খারাপ ছবি পাওয়া গেছে। এজন্য মোবাইলটি জব্দ করা হয়। পরের দিন সকালে তার বাবাকে ডেকে মেয়েকে বুঝিয়ে দিয়েছি।

এ বিষয়ে কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ইকবাল হোসাইন বলেন, ওই মেয়ে এবং কনস্টেবলের বিষয়টি আমি কিছুটা অবগত আছি। তাদের সম্পর্ক মাত্র কয়েকদিনের। সম্পর্কের সুবাদে মেয়েটি ব্ল্যাকমেইলের চেষ্টা করছিল। তথ্য নিয়ে জেনেছি, মেয়েটি এমন বেশ কয়েকটি ঘটনাও করেছিল অনেকের সাথে। তবে ছেলের দোষ নেই তা বলা যাবে না। তবে থানায় মারধর বা নির্যাতনের বিষয়টি সত্য নয়।

তিনি বলেন, এ বিষয়ে উখিয়া ওসির সাথেও কথা হয়েছে। কিন্তু থানায় কোনও মারধর করা হয়নি। মেয়ের বাবাকে বুঝিয়ে মেয়েকে হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। সেখানে মারধর করার বিষয়টি দেখছি না। হয়তো মেয়েকে বাসায় নিয়ে গিয়ে পরিবার সদস্যরা মারধর করেছে কিনা প্রশ্ন থেকে যায়। তারপরও বিষয়টি আরও খোঁজ নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু এরই মধ্যে সুমন নামের ওই কনস্টেবলকে রাঙ্গামাটি পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি।

এসএ

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!