ফেসবুকের মতামতে খুন-কলহের ঘটনা বাড়ছে দেশে

ফেসবুকে মতামতকেন্দ্রিক হাঙ্গামা থামছে না, ঘটছে হত্যার ঘটনাও। এ নিয়ে সাধারণের উৎকণ্ঠা বাড়ছে। অবাধ মতপ্রকাশের স্বাধীনতা দিন দিন সংকুচিত হচ্ছে। ফেসবুকে স্ট্যাটাসকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ-হত্যাসহ নানা অপরাধমূলক ঘটনার সংখ্যা বাড়ছে। এ নিয়ে বাদানুবাদ, প্রতিবাদ ও বিক্ষোভে উত্তেজনা ছড়াচ্ছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ জেলা-উপজেলা শহরে।

তবে এসব ঘটনার জন্য অনেকেই দুষছেন ছাত্ররাজনীতিকে। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া হত্যাকাণ্ডে ছাত্রলীগের সংশ্লিষ্টতায় সরকার বিব্রত হলেও সাধারণরা মনে করছেন ছাত্রলীগের সদস্যরা নিজেদের সকল আইনের ঊর্ধ্বে ভাবেন। এদিকে আওয়ামী লীগের অনেক নেতাও এখন প্রকাশ্যে স্বীকার করছেন—ছাত্রলীগের বেপরোয়া কাজকর্মে তারাও বিব্রত। এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফ বলেছেন, ‘বাংলাদেশের ছাত্রসমাজ ও তরুণ সমাজের মধ্যে অস্থিরতার মাত্রাটা অনেক বেশি। সেই অস্থিরতার বহিঃপ্রকাশই এরকম মাঝে মাঝে দেখা যায়। এখন এটাও ভাববার সময় এসেছে যে বাংলাদেশে এই ধরনের রাজনীতি কি আর সমর্থনযোগ্য কিনা?’

তিনি আরও বলেন, ‘ছাত্র রাজনীতিতে যদি উৎকর্ষতা না আসে, যে ছাত্ররা রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত তারা যদি শিক্ষাঙ্গনের পরিবেশ ভাল বজায় রাখতে না পারে, বা তারা যদি ছাত্রদের কল্যাণে কাজ করতে না পারে, তাদের সম্পর্কে মানুষের একটা নেতিবাচক ধারণা আসবে।

বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র হাসান তালুকদার বলেন, ‘মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা মানে দায়িত্বহীন মন্তব্য নয়। ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে না পারলেও সংঘাতে যাওয়া একেবারেই অনুচিত। তবে ছাত্র থাকতেই ক্ষমতার চর্চা করতে শুরু করলে এই সহনশীলতার মাত্রা শূন্যে গিয়ে ঠেকে। বাহুবল ও ক্ষমতা প্রদর্শনের দিকেই ঝুঁকছে ছাত্ররা।’

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া এক ছাত্রের অভিভাবক বলেন, সামান্য স্ট্যাটাসকে কেন্দ্র করে আবরারকে খুন করা হলো। এ ঘটনায় আমরা বিস্মিত। সহনশীলতার চর্চা শুরু করতে হয় পরিবার থেকেই। পরিবারে যারা সহিংসতা দেখে বড় হয় তারা সহিংসই হয়। ক্ষমতা দেখানোকে যোগ্যতা হিসেবে না নিয়ে বরং মানবিকতাকে পুরস্কৃত করা উচিত।

এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, বাংলাদেশে নাগরিকের স্বাধীন মত প্রকাশের অধিকার সাংবিধানিক অথচ এতেই যত বাধা-বিপত্তি। অতি প্রতিক্রিয়াশীলদের কারণে চিন্তার স্বাধীনতা, বাকস্বাধীনতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সংকুচিত হয়ে পড়েছে। বিগত কয়েক বছরে ফেসবুকে স্ট্যাটাসকে কেন্দ্র করে নানা অপরাধমূলক ঘটনা ঘটেছে। ফেসবুকে ব্যক্তিগত মত প্রকাশ করলেও প্রতিপক্ষের আক্রমণের শিকার হচ্ছে মানুষ। অনেক তাজা প্রাণ ঝরে যাচ্ছে।

সর্বশেষ ফেসবুকে স্ট্যাটাসকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের তড়িৎ কৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র আবরার ফাহাদকে রোববার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে ডেকে নিয়ে রাতে নৃশংসভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। দেশজুড়ে প্রতিবাদ হলেও এ ক্ষতি অপূরণীয়।

২০১৭ সালে চট্টগ্রাম সরকারি সিটি কলেজ ছাত্রলীগের সাবেক-বর্তমান নেতাদের ইঙ্গিত করে দেওয়া একটি ফেসবুক পোস্ট নিয়ে সংগঠনটির নেতা সুদীপ্ত বিশ্বাস রুবেলকে পিটিয়ে হত্যা করা হয় বলে বিশ্বাস তার রাজনৈতিক সহকর্মী ও সহপাঠীদের।

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন— বাকস্বাধীনতা থাকলেও তা প্রয়োগের ক্ষেত্রে সচেতন থাকতে হবে। ২০১৮-২০১৯ পর্যন্ত বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী পিটিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটেছে ৫৫৪টি। পিটিয়ে হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়া ৭৬ শতাংশ পুরুষ বাকি ২৪ শতাংশ নারী। মানুষের মানসিক অস্থিরতা, প্রতিশোধ প্রবণতা বৃদ্ধি পাওয়া ছাড়াও ভিন্নমতের প্রতি সহনশীলতা কমছে।

এ বিষয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও চবি অপরাধ-পুলিশ সাইন্স বিভাগের চেয়ারম্যান প্রফেসর ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘অবাধে মতপ্রকাশের অধিকার সবার আছে। কিন্তু মতপ্রকাশ করার ক্ষেত্রে আমাদের সতর্ক থাকা উচিত। কারো চেতনায় আঘাত হচ্ছে কিনা সেটি দেখা উচিত। অন্যকে আঘাত করতে পারে এমন মতামত থেকে আমাদের অবশ্যই বিরত থাকা উচিত।’

তিনি আরও বলেন, ‘ফেসবুকে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার অপব্যবহার হচ্ছে। এ অপব্যবহার থেকেও আমাদের বিরত থাকতে হবে। কারও সম্মানহানি করা বা কারো ব্যক্তিগত চরিত্র নিয়ে মন্তব্য করা বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করা যাবে না। যেখানেই স্বাধীনতা আছে সেখানেই দায়িত্বের শুরু। আবার ফেসবুকে মতামতকে কেন্দ্র করে হত্যা, দাঙ্গা-হাঙ্গামা—এগুলো কখনো কাম্য নয়। কেউ আক্রান্ত বোধ করেলে সেজন্য আইন আছে। আইন হাতে তুলে না নিয়ে দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে।’

মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে অপব্যবহার করা বা কারো মতামতে বাধা দেওয়া—দুটোই সমান অপরাধ বলে মনে করেন প্রফেসর ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী।

ইস্ট ডেল্টা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর মু. সিকান্দার খান বলেন, ‘অতি উৎসাহী লোকজন সরকারি যেকোন উদ্যেগকে সমর্থন দেওয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকে। আবার এর সমালোচনাকারীদের ধরার জন্য আরেকটা পক্ষও উদগ্রীব হয়ে যায়। এটা মোটেও কাম্য নয়।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গসংগঠনগুলো যেমন ছাত্রলীগ, যুবলীগ, ছাত্রদল তারা নিজেদের ক্ষমতাকে জাহির করার জন্য যা ইচ্ছা তা করে বেড়াচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় এসব মারাত্মক অপরাধও করে বসে তারা। তারা এসব করে শুধু ‘বাহ-বাহ’ পাওয়ার জন্য।’

প্রফেসর সিকান্দার খান বলেন, ‘নিজেকে জাহির করার জন্য অপরাধ করে ফেলে ছাত্ররা। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়েও ফেসবুকে স্ট্যাটাসকে কেন্দ্র হত্যাকাণ্ড ও মারামারির ঘটনা ঘটছে। সরকার বা প্রশাসনের আশকারা পেয়েই এসব কিছু হচ্ছে। এটি একদিনে হচ্ছে না। ধীরে ধীরে অপরাধী হয়ে উঠছে ছাত্ররা। দূর্বল সরকার ব্যবস্থা ছাত্র-রাজনীতির উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। সরকারকে অঙ্গসংগঠনগুলো ছেড়ে দিয়ে বন্ধ করতে হবে ছাত্র-রাজনীতি। অনেক সময় দেখা যায়, গঠনমূলক সমালোচনা হয় সরকারবিরোধী। সরকারের বিরুদ্ধে কোন কথা মানেই সমালোচনা নয়। বরং ওই সমালোচনা গ্রহণ করলে সরকারের উপকার হবে; গণতন্ত্রের একটা পারফেক্ট ইমেজ আসবে।’

সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) ও টিআইবির চট্টগ্রাম মহানগরের সভাপতি অ্যাডভোকেট আকতার কবীর চৌধুরী বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি। আমাদেরও বাক-স্বাধীনতা আছে। সমাজের কল্যাণের জন্য আমদের স্বাধীনতা। কিন্তু বাক-স্বাধীনতা ক্রমেই রুদ্ধ হচ্ছে। তার একমাত্র কারণ সুশাসনের ঘাটতি। আইনের শাসন যদি বলবৎ থাকে তাহলে আমাদের বাক-স্বাধীনতা সংকুচিত হতো না। বাক-স্বাধীনতা নাগরিকের মৌলিক অধিকার। আজ সেই অধিকার থেকে মানুষ বঞ্চিত হচ্ছে। কারণ সেই স্বাধীনতা প্রতিনিয়ত বাধায় পড়ছে। তাই আমাদের সমাজে সুশাসন প্রতিষ্ঠা হওয়া জরুরি।’

চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের ক্রাইম ও অপারেশন বিভাগের অতিরিক্ত কমিশনার আমেনা বেগম বলেন, ‘ফেসবুক স্ট্যাটাসকে কেন্দ্র করে রাষ্ট্রবিরোধী তৎপরতা চালালে সেজন্য আইন আছে। ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থা আছে। আইনকে হাতে তুলে নেওয়ার সুযোগ কারও নেই। ফেসবুক স্ট্যাটাসকে কেন্দ্র করে কেউ অপরাধ করলে ছাড় পাবে না। সে যেই হোক।’

এসএস/সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!