ফিরিঙ্গিবাজারে বিপ্লবের পুঁজি এলাকার উন্নয়ন, সালাউদ্দিনের ঢাল দলের মনোনয়ন

দুই ছাত্রলীগ নেতার লড়াই

‘সে যদি দলীয় শৃঙ্খলা ভাঙ্গে তাহলে তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হোক। তবে অন্যভাবে যেন তাকে হয়রানি না করা হয়। সেও দলের কর্মী।’

গতবারের চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে নগরের ৩৩ নম্বর ফিরিঙ্গিবাজার ওয়ার্ড থেকে পর পর চার বারের নির্বাচিত কাউন্সিলর জহিরুল আলম দোভাষকে পরাজিত করে কাউন্সিলর নির্বাচন হন নগর ছাত্রলীগের স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য ও কমার্স কলেজের সাবেক ভিপি হাসান মুরাদ বিপ্লব। সেই ওয়ার্ডে এবার বিপ্লবকে বাদ দিয়ে কাউন্সিলর পদে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে স্টিয়ারিং কমিটির আরেক সদস্য ও নগর ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ সালাউদ্দিনকে। মনোনয়নঞ্চিত বিপ্লব ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করছেন এখান থেকে। করোনাকালে এলাকায় তিনি কাজ করেছেন নিবিড়ভাবে। নিজেও সপরিবারে আক্রান্ত হন করোনাভাইরাসে।

টানা পাঁচ দফা আওয়ামী লীগের হাতে থাকা এই ওয়ার্ডে এবারও মূল লড়াই হবে আওয়ামী লীগের মনোনীত ও বিদ্রোহী এই দুই প্রার্থীর মধ্যেই। নগর ছাত্রলীগকে ঐক্যবদ্ধ করতে ২০০১ সালে চট্টগ্রামে যে ১২ জন ছাত্রনেতাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল এবারের চসিক নির্বাচনে তাদের মধ্য থেকে দুজন মুখোমুখি হয়েছেন ফিরিঙ্গিবাজার ওয়ার্ডে।

নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে বিপ্লব জোর দিচ্ছেন তার গত নির্বাচনের সাফল্য, সামাজিক কার্যক্রমে সক্রিয় সম্পৃক্ততা ও নির্বাচিত হওয়ার পর ‘ব্যাপক উন্নয়ন কার্যক্রমের’ ওপর। অন্যদিকে সালাউদ্দিন তার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতে তুলে ধরছেন দলীয় সমর্থনের কথা। পাশাপাশি মাদক ও কিশোরগ্যাংমুক্ত এলাকা গড়ার কথাও জানাচ্ছেন। একই সঙ্গে তিনি দলীয় শৃঙ্খলা মেনে নেওয়ার আহ্বানও জানাচ্ছেন বিপ্লবকে।

তবে বিপ্লব বলছেন, কোন নিয়মকানুন না মেনে ‘একপেশেভাবে’ যে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে তার সাথে দলীয় শৃঙ্খলা নয় বরং প্রাধান্য পেয়েছে ব্যক্তিবিশেষের স্বার্থ। স্থানীয় নির্বাচনে বিশেষ করে ওয়ার্ড পর্যায়ে স্থানীয় ভোটারদের আশা আকাঙ্খাকে গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে তিনি বলছেন, ভোটারদের চাপেই নির্বাচন করতে হচ্ছে তাকে।

কাউন্সিলর মনোনয়ন নিয়ে ফিরিঙ্গবাজার ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ নেতাদের মধ্যেও রয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি স্বপন মজুমদার সক্রিয়ভাবে সালাউদ্দিনের সঙ্গে রয়েছেন। বিদ্রোহী প্রার্থীকে সরে দাড়ানোর কথা বলছেন তিনি। তবে মনোনয়ন দেওয়ার ক্ষেত্রে সুবিচার করা হয়নি জানিয়ে ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রফিকুল হোসেন বাচ্চু বলছেন, কাউন্সিলর নির্বাচন নিয়ে কোন আগ্রহ নেই তার। পাশাপাশি ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী বিপ্লবের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিলেও তাকে প্রশাসনিক হয়রানি না করাকে যৌক্তিক মনে করছেন তিনি।

দীর্ঘ তিন দফায় ২১ বছর ধরে এই ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদে দায়িত্ব পালন করছেন রফিকুল হোসেন বাচ্চু। এর আগে নগর ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন তিনি। কাউন্সিলর মনোনয়ন প্রসঙ্গে বাচ্চু বলেন, ‘আগের পাঁচ নির্বাচনে আমার কমিটির সভাপতি নির্বাচন করেছেন। উনার সম্মানে ও দলীয় শৃঙ্খলার প্রশ্নে আমি সে সময় প্রার্থী হওয়ার আগ্রহও প্রকাশ করিনি। এবার তিনি নির্বাচনে নেই। বর্তমানে যিনি ভারপ্রাপ্ত সভাপতি তিনি নির্বাচন করবেন না বলায় প্রথমাবার আমি মনোনয়ন চেয়েছি। কিন্তু কিভাবে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে সেটা জানি না। আমি দলের দায়িত্বে আছি, দলের শৃঙ্খলা মানি। নৌকার প্রশ্নে আমি আমি সর্বোচ্চ উজাড় করে দেবো। তবে কাউন্সিলর নির্বাচন নিয়ে আমার আগ্রহ নাই। পরিবারেরও কেউ এটা চাচ্ছেনা। তাদের চাওয়াকেও আমার সম্মান করতে হবে।’

বিদ্রোহী প্রার্থী প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বিপ্লব গতবার নির্বাচিত হয়েছে। এবার মনোনয়ন পায়নি, বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছে। পরিণতি ভেবেই নিশ্চয়ই হয়েছে। আমার কথা হলো সে যদি দলীয় শৃঙ্খলা ভাঙ্গে তাহলে তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হোক। তবে অন্যভাবে যেন তাকে হয়রানি না করা হয়। সেও দলের কর্মী।’

নির্বাচনকে ঘিরে এখানে এর মধ্যে কোনো সংঘাত হয়েছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে বাচ্চু বলেন, ‘এখন পর্যন্ত সেরকম কিছু হয়নি। নির্বাচনে টুকটাক সমস্যাতো হয়। তবে বড় কিছু ঘটেনি।’

অন্যদিকে ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি স্বপন মজুমদার বলেন, ‘যেহেতু আমি ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের দায়িত্বে আছি আর আমাদের তো দলীয় কাউন্সিলর প্রার্থী আছে সালাউদ্দিন। আমার একটা দায়িত্ব আছে পার্টির সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা। আর বিদ্রোহী প্রার্থী যিনি আছে, উনি উনার দায়িত্ব নিয়ে দাঁড়াইছে, উনারটা উনি বুঝবে।’

দলের দুই প্রার্থী দাড়ানোয় বিএনপি সুবিধা তুলে নেবে কিনা— এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘কনটেস্ট হবে দলীয় আর বিদ্রোহী প্রার্থীর মধ্যে, মাঠে তো খালি এই দুজনই আছে। বিএনপির প্রার্থী থাকলেও তারা তো মাঠে নাই।’

নির্বাচনের নিজের অবস্থান সম্পর্কে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী মোহাম্মদ সালাউদ্দিন বলেন, ‘আমাকে দলের সভানেত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা মনোনয়ন দিয়েছেন। আমরা আগেও মেয়র প্রার্থীসহ এখানকার ভোটারদের ঘরে ঘরে গেছি। করোনাকালে মানুষের সাথে আমাদের যোগাযোগ ছিল। এখন আরও বেশি যাচ্ছি। কদিন আগে এখানে দলীয় মেয়র প্রার্থী রেজাউল ভাই, মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি মাহতাব উদ্দিন ভাই ও সাধারণ সম্পাদক নাছির ভাইসহ ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের একটা সভা হয়েছে। সেখানে আমাদের সাবেক কাউন্সিলর বর্তমানে মহানগর আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি ও সিডিএর চেয়ারম্যান জহিরুল আলম দোভাষ ভাই ছিলেন, ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। সবাই দলীয় প্রার্থীদের ব্যাপারে একাট্টা। পাশাপাশি বিদ্রোহী প্রার্থীদের ব্যাপারে কঠোর অবস্থানের কথাও জানিয়ে দেওয়া হয়েছে সেই বৈঠকে।’

বিদ্রোহী প্রার্থীর বিষয়ে কোন অভিযোগ আছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘না। কোন অভিযোগ নেই। আমরা দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতি করছি। দল যখন যে সিদ্ধান্ত দিয়ে কর্মী হিসেবে আমরা সে সিদ্ধান্তের পক্ষেই ছিলাম। গত বার এই আসনে জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু সাহেবকে প্রার্থী দিয়েছিল দল, মেয়র নির্বাচনে নাছির ভাইকে নির্বাচিত করতে আমরা কাজ করেছি। কখনোই দলের সিদ্ধান্ত ডিফার করিনি। এখন যেহেতু উনি কাউন্সিলর মনোনয়ন পাননি। সেহেতু বিদ্রোহী হয়ে নির্বাচন করা দলের সাথে বেইমানি করার শামিল। যেহেতু মনোনয়নটা এখান থেকে নয় গণভবন থেকে দেওয়া হয়েছে।’

একই প্রশ্নের জবাবে হাসান মুরাদ বিপ্লব বলেন, ‘উনি এলাকায় সেভাবে সময় দেননি। এলাকার সামাজিক কার্যক্রমে, মানুষের বিপদে আপদে আমি যেভাবে ছিলাম সেভাবে তো উনি ছিলেন না।’

এক্ষেত্রে সালাউদ্দিনের জবাব, ‘আমি দীর্ঘদিন নগর ছাত্রলীগের নেতৃত্ব দিয়েছি। ওয়ার্ড থেকেইতো উঠে এসেছি। পুরো নগরের দায়িত্ব সামলেছি নিজের এলাকায় সময় একেবারেই দিইনি এটাতো ঠিক না।একজন সালাউদ্দিনতো একদিনে সৃষ্টি হয়নি। উনি গতবার কাউন্সিলর ছিলেন স্বাভাবিকভাবে উনার দায়িত্ব ছিল সেক্ষেত্রে উনি হয়তো একটু বেশি সময় দিয়েছেন। কিন্তু আমরা তো সহযোদ্ধা— তিনিও দলের কর্মী, আমিও দলের কর্মী। যেহেতু তিনি দলের কর্মী সেহেতু তিনি বিদ্রোহী নির্বাচন না করে দলের সিদ্ধান্ত মেনে নেবেন। এটাই তো হওয়া উচিত।’

তবে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর উপায় নেই জানিয়ে হাসান মুরাদ বিপ্লব বলেন, ‘করোনাকালে দলের সব কর্মসূচিতে আমরা ছিলাম। এর আগেও যখন নমিনেশন সাবমিট করেছি, এরপর এত সময় গেল দল তো তখন আমাদের কোন দিকনির্দেশনা দেয়নি। করোনার সময়ে আমরা জীবনের ঝুঁকি নিয়েছি, মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছি। এসব করতে গিয়ে আমি করোনায় আক্রান্ত হয়েছি। আমি তো মারাও যেতে পারতাম। আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি, মানসিকভাবেও অপদস্থ হয়েছি। পিছপা হওয়ার কোনো সুযোগ তো আমাদের নাই।’

নির্বাচনে জয়ের ব্যাপারে শতভাগ আশাবাদ ব্যক্ত করে বিপ্লব বলেন, ‘আমি নির্বাচিত হওয়ার পরে এখানে ব্যাপক উন্নয়ন করেছি। এলাকায় আগে রাস্তার ওপর ডাস্টবিন ছিল, সেগুলো সরিয়েছি। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতায় জোর দিয়েছি। আগের ওয়ার্ড কার্যালয় ছিল জীর্ণশীর্ণ, সেখানে উন্নয়ন করেছি, সেবা পাওয়া সহজ করেছি। এলাকার মানুষের দুর্দিনে পাশে দাড়িয়েছি সাধ্যমতো। গতবার আমি ৪৭৮ ভোটে জিতেছি। এবার কমপক্ষে ২ হাজারের বেশি ভোটে জিতবো।’

অন্যদিকে সালাউদ্দিন বলেন, ‘ফিরিঙ্গিবাজার আওয়ামী লীগের ঘাঁটি। এখানে জয়ের ব্যাপারে আমি শতভাগ আশাবাদী। আর যে উন্নয়নের কথা বলা হচ্ছে সেটি সারা দেশেই হচ্ছে। এটি আওয়ামী লীগের অঙ্গীকার কারও ব্যক্তিগত অর্জন নয়। তবে অতীতে আমাদের ওয়ার্ডে উন্নয়নের নামে অনেক দুর্নীতি হয়েছে। ভোটে মানুষ এর জবাব দেবে।’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!