‘ফারুকনামা’—উপজেলা চেয়ারম্যানের ৫ বছরে বেড়েছে ১১ গুণ সম্পদ

পাঁচ বছরে অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছেন চট্টগ্রামের কর্ণফুলী উপজেলা চেয়ারম্যান ফারুক চৌধুরী। এই সময়ের মধ্যে তার সম্পদ বেড়েছে প্রায় ১১ গুণ। এবারও তিনি চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়েছেন। উপজেলা পরিষদ নির্বাচন উপলক্ষে তিনি মনোনয়নপত্র জমা দেন। মনোনয়নপত্রের সঙ্গে জমা দেওয়া হলফনামার আর গত পাঁচ বছর আগের হলফনামা দেখে পাওয়া গেছে সম্পদ ও দায়ের আকাশ-পাতাল ব্যবধান।

এবারের হলফনামার কোথাও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হিসেবে গত পাঁচ বছরে তিনি যে ২৪ লাখ টাকা সম্মানি ও ভাতা পেয়েছেন তা দেখানো হয়নি। ব্যাংক লোন পরিশোধ না করলেও কিনেছেন বহু জমি।

২০১৭ সালের উপজেলা নির্বাচনে ফারুক চৌধুরীর দেওয়া হলফনামায় উল্লেখ ছিল, তিনি একজন কম্পিউটার ব্যবসায়ী। ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নাম এ্যালগেয়ী কম্পিউটার, যেটি ঢাকার নিউ এলিপ্যান্ট রোডের আল্পনা প্লাজায়। সেখানে বাৎসরিক আয়ের উৎস ছিল, কৃষিখাত থেকে ৩০ হাজার টাকা ও ব্যবসা থেকে ৪ লাখ টাকা। কিন্তু তার পারিবারিক ব্যয় দেখানো হয় সাড়ে ৩ লাখ টাকা।

পাঁচ বছর আগের হলফনামায় অস্থাবর সম্পদ নিজ নামে ছিল ২ লাখ টাকা, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমা ছিল ৮ লাখ টাকা। একটি মোটর কার ছিল ১২ লাখ টাকা দামের। নিজ নামে স্বর্ণালঙ্কার ছিল ১০ ভরি ও স্ত্রীর নামে ৫ ভরি। সঙ্গে ছিল টিভি-ফ্রিজ-এসি। স্থাবর সম্পদে ছিল ৫০ শতক কৃষি জমি, যার মূল্য ২ লাখ ২০ হাজার, অকৃষি জমি ছিল ১০ শতক। যার মূল্য দেখানো হয়েছিল ৯ লাখ ১৪ হাজার টাকা। ৩০ লাখ টাকা মূল্যের একটি বাড়ি ও একটি এ্যাপার্টমেন্টও দেখানো হয়।

এছাড়া দায়-দেনা ছিল আল আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক লিমিটেডে (সিসি লোন) তিন কোটি ৮৯ লাখ ৩০ হাজার ৫৮৮ টাকা। ইউসিবিএল ব্যাংকে যৌথ সিসি লোন ছিল ৫ কোটি ৯৭ লাখ ১৪ হাজার ৭১৬ টাকা। খেলাপি ঋণের পরিমাণ না থাকলেও ঋণের পরিমাণ ছিল ৯ কোটি ৮৬ লাখ ৪৫ হাজার ৩০৪ টাকা।

২০১৬ সালের ৩০ জুনের পরিসম্পদ, দায় ও ব্যয় বিবরণীতে ফারুক চৌধুরীর ব্যবসার পুঁজি ছিল ২৮ লাখ ২২ হাজার টাকা, বিভিন্ন কোম্পানিতে শেয়ার বিনিয়োগ কলামে ক্রয়মূল্য তিন দাগে মোট ৭ লাখ টাকা। অকৃষি সম্পত্তির ব্যয়সহ ক্রয়মূল্য ছিল ২ লাখ ২০ হাজার টাকা, জমি-গৃহ সম্পত্তি বিবরণীতে চার দাগে ছিল মোট ২৩ লাখ ১৬ হাজার টাকা। যেখানে ১৫ ভরি স্বর্ণের দাম জানা নেই বলে উল্লেখ করেছেন। ব্যবসা বহির্ভূত নগদ ও ব্যাংকে গচ্ছিত ছিল তখন ৩ লাখ ৬০ হাজার ২০০ টাকা।

সবমিলিয়ে আয়কর বিবরণীতে মোট পরিসম্পদ ছিল ৭৪ লাখ ২৯ হাজার ২০০ টাকা। বছর শেষে নীট সম্পদ ছিল ৭৪ লাখ ২৭ হাজার ২০০ টাকা। ফলে সম্পদের পরিবৃদ্ধি ছিল ২ হাজার টাকা মাত্র। পারিবারিক ব্যয় দেখানো হয় সাড়ে তিন লাখ টাকা। ঘুরে ফিরে অর্জিত তহবিল আবারও ৪ লাখ।

কিন্তু ২০২২ সালের অক্টোবর মাসে দেওয়া হলফনামার তথ্যে দেখা গেছে, স্নাতকোত্তর ফারুক চৌধুরী ঢাকা নিউ এলিফ্যান্ট রোডের এ্যালগেয়ী কম্পিউটারের সত্ত্বাধিকারী। আয়ের উৎস হিসেবে কৃষিখাত থেকে তার বাৎসরিক আয় দেখানো হয়েছে ৩০ হাজার টাকা। অন্যান্য ব্যবসা থেকে আয় ৬ লাখ ৮০ হাজার ২০০ টাকা।

অস্থাবর সম্পত্তি হিসেবে নগদ রয়েছে তার ৩ লাখ টাকা। ব্যাংকে জমা রয়েছে ৮ লাখ টাকা। রয়েছে একটি মোটর কার যার মূল্য দেখানো হয়েছে ১২ লাখ টাকা। যা আগে ছিল ১০ লাখ টাকা। নিজ নামে স্বর্ণ রয়েছে ১০ ভরি, স্ত্রী মেহেরুন্নেছার নামে স্বর্ণ রয়েছে ৫ ভরি। টিভি ১টি, ফ্রিজ ১টি, এসি ১টি, ফ্যান ৮টি, সোফা ১ সেট, আলমারী ২টি, টেবিল ১টি, আলনা ১টি ও খাট ৩টি।

ফারুক চৌধুরীর স্থাবর সম্পদে রয়েছে ৫০ শতক কৃষি জমি। যার মূল্য দেখিয়েছেন ২ লাখ ২০ হাজার টাকা। অকৃষি জমি ১০ শতক, যার মূল্য ৯ লাখ ১৪ হাজার টাকা। যৌথ মালিকানায় যা পাঁচ ভাগের এক অংশ। রয়েছে একটি বাড়ি ও ১টি এপার্টমেন্ট। যার মূল্য দেখিয়েছেন ৩০ লাখ টাকা। এক্ষেত্রে আগের হলফনামার সঙ্গে কোনের পরিবর্তন হয়নি।

এছাড়া দায় ও দেনায় বর্ণনায় আল আরাফা ইসলামী ব্যাংক লিমিটেডে সিসি ঋণ রয়েছে ৩৩ লাখ ৫৪ হাজার টাকা। আর ইউসিবিএল ব্যাংকে যৌথ ঋণ রয়েছে ৭ কোটি ১৪ লাখ ৮৬ হাজার ৯০৭ টাকা। কিন্তু ২০১৬ সালের ৩০ জুন ফারুক চৌধুরীর ব্যবসার পুঁজি ২৮ লাখ ২২ হাজার টাকা থাকলেও ২০২২ সালে ট্যাক্সপেয়ার আইডেন্টিফিকেশন নম্বর মতে তা দাঁড়িয়েছে ৩ কোটি ৫০ লাখ ৭৪ হাজার ৪৪৩ টাকা। গত পাঁচ বছরে ব্যাংক লোন পরিশোধ না করলেও পুঁজি বেড়েছে ৩ কোটি ২২ লাখ ৫২ হাজার ৪৪৩ টাকা।

অকৃষি জমি বেড়েছে ২ লাখ ৪১ হাজার ৭১০ টাকা এবং ২০২২ সালে কৃষি নাল জমি ক্রয় করেন ৭ দশমিক ১৪ শতক। যার রেজিস্ট্রি দলিল নম্বর ৯২৪২। ২০২১ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর একইদিনে জমি ক্রয় করেন যথাক্রমে ৯০০ শতাংশ, ৪০০ শতাংশ ও ৩৫০ শতাংশ। যার রেজিস্ট্রি দলিল নম্বর ৭৭৭০, ৭৭৭১ ও ৭৭৭২।

সর্বশেষ ২০২২ সালের ১৯ জুন জমি ক্রয় করেন ১০ শতক, যার রেজিস্ট্রি দলিল নম্বর ২৮৯৪। মোট মূল্য হিসাবে যা দাঁড়ায় প্রায় ৪৩ লাখ ৪০ হাজার ৪৪০ টাকা। তিনি গত ২০১৬ সালে ১৫ হাজার টাকা কর দিলেও ২০২২ সালের দেন ২৫ হাজার টাকা।

প্রশ্ন ওঠেছে, কম জমি থাকার পরও দুটি ব্যাংক থেকে ৯ কোটি ৮৬ লাখ ৪৫ হাজার ৩০৫ টাকা ঋণ কিভাবে নিলেন? এর বিপরীতে সমসম্পদ দেখিয়েন কি-না? আবার ঋণ পরিশোধ না করে একের পর পর জমি কিনলেন কিভাবে?

যদিও ফারুক চৌধুরীর দাবি, ‘তার যা আছে, হলফনামায় তাই উল্লেখ করেছেন। কোনো কিছু গোপন করা হয়নি।’

দুদকের আইনজীবী মাহমুদুল হক জানান, ‘নির্বাচনে প্রার্থীদের হলফনামায় অসত্য তথ্য ও তথ্য গোপন করার বিষয়ে নির্বাচন কমিশন যথেষ্ট মনোযোগী নয়। কমিশন যদি তথ্য খতিয়ে দেখে প্রার্থীকে অযোগ্য ঘোষণা করত, তাহলে ভবিষ্যতে হলফনামায় যেনতেন তথ্য দেওয়ার ক্ষেত্রে সবাই সতর্ক হতেন।’

মানবাধিকারকর্মী জিয়া হাবীব আহসান বলেন, ‘জনপ্রতিনিধিরা সৎ ও নিষ্ঠাবান হবেন—এটাই মানুষের চাওয়া। প্রার্থীদের হলফনামায় অসংগতি দেখে তারা হতাশ হন। কমিশনও প্রার্থীদের এসব তথ্য যাচাই করে দেখে না, যা দুর্ভাগ্যজনক।’

জানতে চাইলে কর্ণফুলী উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা ও সিনিয়র জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মো. জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ‘হলফনামায় তথ্য গোপন করা অপরাধ। কোনো প্রার্থী তার হলফনামায় তথ্য গোপন করলে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে পারবেন। অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাচন কমিশন ব্যবস্থা নেবে।’

এদিকে কর্ণফুলী উপজেলা নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে লড়ছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী ফারুক চৌধুরী (নৌকা) ও স্বতন্ত্র প্রার্থী মোহাম্মদ আলী (আনারস)। ভাইস চেয়ারম্যান পদে লড়ছেন আমির আহমদ (চশমা), মহিউদ্দিন মুরাদ (উড়োজাহাজ) এবং মো. আবদুল হালিম (তালা)।

এছাড়াও সংরক্ষিত মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী হয়েছেন মোমেনা আক্তার নয়ন (কলস), বানাজা বেগম (হাঁস), ফারহানা মমতাজ (ফুটবল) ও রানু আকতার (বৈদ্যুতিক পাখা)।

আগামী ২ নভেম্বর ইভিএম পদ্ধতিতে উপজেলা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এবার মোট ভোটার ১ লাখ ৭ হাজার ৭৯৯ জন। এরমধ্যে পুরুষ ভোটার ৫৩ হাজার ৫৯৯ জন ও মহিলা ভোটার ৫৪ হাজার ২০০ জন। মোট ৪৫টি কেন্দ্রের ২৫০টির উপরে বুথ কক্ষে ভোটাররা ভোট প্রদান করবেন।

ডিজে

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!