ফাইল ঠেকিয়ে ঘুষ আদায়ে চট্টগ্রামের রাজস্ব কর্মকর্তা, ঘুষের টাকা গোণে ‘ফালতু’ (ভিডিও)

চট্টগ্রামের সদরঘাট থানার কাস্টমস এক্সাইজ ও ভ্যাট আগ্রাবাদ সার্কেলের ‘ফালতু’ বজলুর রহমান। ওই অফিসের বৈধ কোনো কর্মচারী না হওয়ার পরও দীর্ঘ ১৮ বছর ‘চাকরি’ করে আসছেন তিনি। মূসক নিবন্ধিত বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের লোকজনকে ভ্যাটের ফাইলের নানা সমস্যা ও অজুহাত দেখিয়ে নেওয়া হচ্ছে মোটা অংকের অর্থ। বজলুর রহমানের এসব অপকর্মে খোদ সহযোগিতা করে আসছেন ওই অফিসের রাজস্ব কর্মকর্তা (আরও) নাজমুল হোসাইন।

দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের সহযোগী হিসেবে কাজ করেন এসব কর্মী। কর্মকর্তারাও আবার তাদের অবৈধ কাজের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেন এদের। সাধারণভাবে এদের পরিচিতি ‘ফালতু’ হিসেবে।

অভিযোগ রয়েছে, ওই দফতরে রাজস্ব কর্মকর্তা (আরও), সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা (এআরও) ও সেখানবার পেশকার সমন্বয়ে একটি গ্রুপ সরকারি বন্ধের দিনে অভিযান পরিচালনা করেন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে। এসব অভিযানে মূসক নিবন্ধিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের লোকজনের ভ্যাটে ফাঁদে ফেলে কাগজপত্র ঠিক নেই বলে ডেকে নেওয়া হচ্ছে অফিসে। পরবর্তীতে ওইসব প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের কাছ থেকে অবৈধ অর্থ আদায় করার মাধ্যমে সমাধান করছে মূসক পরিশোধের।

সরকারি অফিসে কেক কেটে পালন করা হয়েছে ‘ফালতু’ বজলুর রহমানের জন্মদিনও।
সরকারি অফিসে কেক কেটে পালন করা হয়েছে ‘ফালতু’ বজলুর রহমানের জন্মদিনও।

সম্প্রতি ‘ফালতু’ বজলুর রহমান সরকারি অফিসে বসে একাধিক মূসক নিবন্ধিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্তাদের কাছ থেকে ঘুষ আদায় করার একটি ভিডিওচিত্র চট্টগ্রাম প্রতিদিনের হাতে এসেছে। একইসঙ্গে সরকারি অফিসে বসে কেক কেটে পালন করা হয়েছে ‘ফালতু’ বজলুর রহমানের জন্মদিন। তার এ জন্মদিনে উপস্থিত ছিলেন খোদ আগ্রাবাদ সার্কেলের রাজস্ব কর্মকর্তা নাজমুল হোসাইনসহ আরও অনেকেই। জন্মদিনের ওই ছবিও চট্টগ্রাম প্রতিদিনের কাছে এসেছে।

এর আগেও চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ সার্কেলের সার্কেলের ভ্যাট রাজস্ব কর্মকর্তা নাজমুল হোসাইনের বিরুদ্ধে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। চলতি বছরের মার্চের দিকে বনফুল আগ্রাবাদ শাখার এজেন্ট (আউটলেট) মালিক শাহ আলমের কাছ থেকে এক লাখ টাকা ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ উঠেছিল নাজমুল হোসাইনের বিরুদ্ধে। তার বিরুদ্ধে ঘুষ গ্রহণের অভিযোগের পরপরই তাকে বান্দরবানের লামায় বদলি করা। সম্প্রতি আবারও কাস্টমস এক্সাইজ ও ভ্যাট আগ্রাবাদ সার্কেলের রাজস্ব কর্মকর্তা হিসেবে যোগদান করেছেন নাজমুল।

মূসক নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানের একাধিক লোকজন জানায়, আগ্রাবাদ সার্কেলের রাজস্ব কর্মকর্তা সহ তাদের তিন-চারজনের একটি টিম বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান জরিপ, আমদানি-রপ্তানির তথ্য ও নিবন্ধিত মূসক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ডিসি (ডেপুটি কমিশনার) ও এসি (সহকারী কমিশনার) রিপোর্ট চেয়ে চিঠি দিয়ে অফিসে ডেকে নেওয়া হয়। ভূক্তভোগীরা দফতরে যোগাযোগ করলে তাদের সঙ্গে রফাদফা করেন বজলুর রহমান। এভাবে কর্মকর্তাদের যোগসাজসে প্রতিনিয়ত লাখ লাখ টাকা আদায় করছেন ‘ফালতু’ এই কর্মচারী। অর্থ লেনদেনের মাধ্যমে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মামলার ফাইল গায়েব করে দেওয়া হয়।

নাম প্রকাশের অনিচ্ছুক বেশ কয়েকজন কর আইনজীবী জানিয়েছেন, কাস্টমস্ এক্সাইজ ও ভ্যাট আগ্রাবাদ সার্কেলের রাজস্ব কর্মকর্তা (আরও) নাজমুল হোসাইন। মূসক চালানের অজুহাত, অনলাইন ভ্যাট রির্টান অফিসে জমা না দেওয়া, ভ্যাট চালানের কপি অনুপস্থিত ও কাগজপত্র অসম্পূর্ণ দেখিয়ে আটকে দেওয়া হচ্ছে বড়বড় প্রতিষ্ঠানের ফাইল। পরে সেখানকার বহিরাগত কর্মচারি (ফালতু) বজলুর রহমানকে দিয়ে আদায় করছে ঘুষ। চাহিদামতো টাকা পাওয়ার পর সমাধান মিলছে আটকে থাকা ওইসব ফাইলের।

সূত্র বলছে, কক্সবাজার টেকনাফ উপজেলার স্থল শুল্ক স্টেশনের কর্মচারী নুরুল ইসলামের (বর্তমানে দুর্নীতি দমন কমিশনের দায়ের করা মামলায় কারাগারে আছেন) হাত ধরে ২০০৩ সালে চট্টগ্রাম কাস্টমস এক্সইজ ও ভ্যাট বিভাগে ‘ফালতু’ হিসেবে যোগদান করেন। দীর্ঘ সময় সরকারি এসব দফতরে অবৈধ লেনদেনর সহযোগিতা করে বানিয়েছেন অঢেল সম্পদও।

অনুসন্ধানে জানা যায়, বজলুর রহমানের ফালতু হিসেবে ২০০৩ সালের যোগদানের পর থেকে সিএমপির ইপিজেড কলসিরদীঘি, হালিশহর বড়পোল ও পটিয়ার শান্তিরহাট এলাকায় বিভিন্ন নামে-বেনামে ওয়ালটনের সাতটি শোরুম রয়েছে তার। ভাড়ায় চলছে দুটি নোহা গাড়ি। নিজ জেলা ভোলা ও চট্টগ্রামে ১০টি সিএনজি অটোরিকশা, শতাধিক রিকশা এবং অন্তত ২০টি ইজিবাইকের মালিক তিনি। ভোলা জেলার সদর থানার ধনিয়া গ্রামে ও ঢাকার মিরপুরে গড়ে তুলেছেন বহুতল ভবন। রয়েছে তার-স্ত্রীর নামে এফডিআর। ভোলা জেলার ভোলা সদর থানার ধনিয়া ইউনিয়ন আলগী গ্রামের বাসিন্দা এই বজলুর রহমান।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে বজলুর রহমানকে ফোন করা হলে তিনি কল রিসিভ করে কেটে দেন বারবার।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে কাস্টমস এক্সাইজ ও ভ্যাট আগ্রাবাদ সার্কেলের রাজস্ব কর্মকর্তা নাজমুল হোসাইন বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ সঠিক না। বজলুর রহমানের বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়ার পরই তাৎক্ষণিক তাকে এখান থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে।’

কাস্টমস এক্সাইজ ও ভ্যাট আগ্রাবাদ সার্কেলের বিভাগীয় কর্মকর্তা ফাতেমা খায়রুন নূর বলেন, ‘বজলুর রহমানের বিরুদ্ধে অভিযোগ পেয়ে তাৎক্ষণিক অফিস থেকে বের করে দিয়েছে। আমি এখানে আসছি মাত্র তিন মাস। দীর্ঘ সময় বজলুর রহমান কিভাবে চাকরি করছেন সেটা আমার জানা নেই।’

জানতে চাইলে কাস্টমস এক্সাইজ ও ভ্যাট চট্টগ্রামের ভ্যাট কমিশনার মো. আকবর হোসেন বলেন, ‘বজলুর রহমানের নামে কাউকে চিনি না। এ নামে কোনো নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মচারীও নেই ওই দফতরে।’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!