প্লাস্টিকের দাপট শহরজুড়ে, পাটে অনাগ্রহ ব্যবসায়ীদের

অপচনশীল পদার্থ প্লাস্টিক। প্রজন্মের পর প্রজন্ম বিলীন হলেও প্লাস্টিকের আয়ুষ্কাল শেষ হতে সময় লাগে চার শতাব্দীরও বেশি। প্রশাসন, ক্রেতা-বিক্রেতা প্রায় সবারই জানা এর ক্ষতিকর দিক। এরপরও বাজার সয়লাব প্লাস্টিকের বস্তা ব্যবহারে।

প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপত্তির স্থান থেকে বিভিন্ন উপায়ে ভিন্ন ভিন্ন আকারে পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ে। আর এটি পঁচতেও সময় লাগে ৪০০ বছর। পাটজাত দ্রব্যের ব্যবহার বাড়াতে এবং পরিবেশ রক্ষার স্বার্থে প্রায় চার বছর আগে চাল, ডাল, চিনিসহ বেশকিছু পণ্যে প্লাস্টিকের বস্তার ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছিল সরকার। এ জন্য ১৯টি পণ্যে প্লাস্টিকের ব্যবহার নিষিদ্ধ করে এবং পাটের বস্তা ব্যবহার বাধ্যতামূলক করে। পরিবেশের দিক বিবেচনা করে প্লাস্টিকের বস্তা ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। কিন্তু সেই নিষেধাজ্ঞাও অনেকটা উপেক্ষিত।

নিষেধাজ্ঞার আড়াই বছর পেরিয়ে গেলেও এখনও ধান, চাল, গম, ভুট্টা, সার ও চিনিসহ ১৯টি পণ্যের মোড়কীকরণ এবং পরিবহনে ব্যবহৃত হচ্ছে প্লাস্টিক বস্তা। প্লাস্টিক বস্তার বিরুদ্ধে প্রশাসনও মাঝে মাঝে অভিযান পরিচালনা করে। তবে পরে এক সময় অভিযানও স্তিমিত হয়ে পড়ে। ফলে পাটের বহুমুখী ব্যবহার এবং পাটের বস্তা ব্যবহারের সরকারি উদ্যোগ ভেস্তে যেতে বসেছে। ব্যবসায়ীরা নিজেদের খরচের পাল্লা কমানোর লক্ষ্যে প্লাস্টিকের বস্তা ব্যবহার করেই যাচ্ছে। আবার অনেক ব্যবসায়ী আমদানির দোহাই তুলে প্লাস্টিকের বস্তার ব্যবহার করে যাচ্ছে।

প্লাস্টিক যেহেতু পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর তাই পরিবেশ সংরক্ষণের বিষয়টিও প্রজ্ঞাপন জারির সময় বিবেচনায় আনা হয়। একইসাথে ম্রিয়মান পাটশিল্পকে বেগবান করারও উদ্দেশ্যও ছিল।

জানা গেছে, সরকার ২০১৭ সালে ১৭টি পণ্যে প্লাস্টিক বস্তা নিষিদ্ধ করে প্রজ্ঞাপন জারি করে। এরপর গত বছরের আগস্টে আরো দুটি পণ্য যুক্ত হয় ওই ১৭ পণ্যের সাথে। তবে সরকার প্রজ্ঞাপন জারি করেছে ঠিক, কিন্তু সেই নির্দেশনা মানতে নারাজ ব্যবসায়ীরা। প্লাস্টিক বস্তার বিরুদ্ধে প্রশাসনের নিয়মিত অভিযান না থাকায় ব্যবসায়ীরা আরো বেশি উৎসাহিত হচ্ছেন বলে অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের।

চাক্তাইয়ের চালপট্টির কয়েকজন আড়তদারের সাথে কথা বলে জানা গেছে, উত্তরাঞ্চলসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তের চালের মিল থেকে এখনো প্লাস্টিক বস্তায় চাল আসছে। মাঝে মাঝে প্রশাসন আড়তে প্লাস্টিক বস্তার বিরুদ্ধে অভিযান চালায়। কিন্তু আড়তদাররা তো চাল উৎপাদন করেন না। আমদানিকারক কিংবা মিল মালিকরা যেভাবে চাল সরবরাহ করেন সেভাবে কিনে বাজারে বিক্রি করা হচ্ছে। শুধু তাই নয় আমদানি চালগুলোও আসে প্লাস্টিক বস্তায়। ব্যবসায়ীদের অজুহাত, লাখ লাখ বস্তা পাটের বস্তায় গুদামজাত করতে হলে চালের খরচও বেড়ে যাবে। এছাড়া চালের বস্তা পরিবর্তন করাটা দুরূহ।

খাতুনগঞ্জের আটা-ময়দার ব্যবসায়ীরা জানান, পাটের তৈরি বস্তায় আটা-ময়দা পরিবহন করাটা একটু কঠিন। কারণ পাটের বস্তায় আঁশ ও ছিদ্র থাকে। দেখা যায়, আটা ও ময়দার সাথে এসব আঁশ মিশে যায়। এছাড়া অনেক সময় ধুলাবালি বস্তার ছিদ্র দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে। এতে আটা-ময়দার গুণগত মান নষ্ট হয়। তবে পাটের বস্তা আটা-ময়দার জন্য উপযোগী করে তৈরি হলে এটি ব্যবহারে আমাদের কোনো আপত্তি নেই।

চট্টগ্রাম চাউল ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ওমর আজম চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘সরকারিভাবে নিষেধাজ্ঞা আছে, তারপরও গত দেড় বছর আগের ইমপোর্টর মাল এখনও অনেক রয়ে গেছে। বিভিন্ন গোডাউনে মজুদ থাকা বস্তাও আছে। তাছাড়া আমাদের চাউলটা নর্থ বেঙ্গলের বিভিন্ন জায়গা থেকে আসে। ম্যাক্সিমাম ডিলাররা বস্তা ব্যবহার করছে। কিন্তু মাঝে সরকার প্লাস্টিকের বস্তা ব্যবহার শিথিল করেছে।’

তিনি আরও বলেন, পাটের বস্তা ব্যবহার করতে গেলে কিছু সমস্যা আছে। পিসি’র(প্লাস্টিকের ব্যাগ) দাম ১৭ থেকে ১৮ টাকা। পাশাপাশি চটের ব্যাগ ৪৫ থেকে ৫০ টাকা। আবার পাটের বস্তায় মালের ওজন কম ধরে। পিসির (প্লাস্টিকের ব্যাগ) ব্যাগে অ্যাকুরেট (সঠিক) ধরে।

চাক্তাই রাইচ মিল মালিক সমিতির সভাপতি শান্ত দাশগুপ্ত বলেন, ‘আমাদের কী করার আছে। ইমপোর্টের মাল তো আর পাটের বস্তায় আসে না। পাটের বস্তায় আনলে পোষাবেও না। নিষেধাজ্ঞা থাকলেও মাঝে সরকার তো শিথিল করেছে। চটের বস্তা ব্যবহার সরকার বাধ্যতামূলক করলেও পেঁয়াজ, রসুন, আদা, ডাল, ধনিয়াসহ কিছু ভোগ্যপণ্য প্লাস্টিক বস্তায় আমদানি করছে ব্যবসায়ীরা। এসব পণ্য চাইলেও হঠাৎ করে চটের বস্তায় ভরা সম্ভব নয়। কারণ প্রতিদিন চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে প্রতিদিন লাখ লাখ টন ভোগ্যপণ্য আমদানি হচ্ছে।’

চাক্তাই খাতুনগঞ্জ আড়তদার সাধারণ ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সাবেক সভাপতি সোলায়মান বাদশা চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমাদের দেশে যে পরিমাণ রেক্সিনের (প্লাস্টিক) বস্তা প্রয়োজন আছে সে অনুপাতে জুটের বস্তা না থাকে তাহলে গভর্মেন্ট (সরকার) বন্ধ করলেও সেটা কার্যকর হবে না। আমাদের জুটমিল যেগুলো আছে বেশিরভাগ বন্ধ। তারা অতটুকু সাপ্লাই (সরবরাহ) দিতে পারে না। বাইরে থেকে যেগুলো আসে তা রেক্সিনে করে আসে। ওই বস্তাগুলো কী করবো? বন্দরে খালাস করতে গেলে যেভাবে আসে সেভাবেই করতে হবে। আর আমি যদি করতেও যাই চটের বস্তা নিয়ে গেলে বন্দরে যানজট হবে আর সেখানে এসব করার সুযোগ নেই।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের কী পরিমাণ চটের বস্তা প্রয়োজন তার পরিসংখ্যান বের করে প্রয়োজন হলে বন্ধ করতে পারে। মজুদ আছে কিনা সেটা না দেখে র‍্যাক্সিন বন্ধ করলে তো সেটা যুক্তিহীন।’

এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ ইলিয়াস হোসেন চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘ইমপোর্টের জিনিসগুলোর ক্ষেত্রে আমরা কিছু করতে পারছি না। লোকালভাবে ব্যবহার হলে সেসবের ব্যবস্থা নেওয়া যায়। তবে কিছু জিনিসের ক্ষেত্রে ছাড় দিতে হয়। ধরেন, চিনি তো চটের বস্তায় নেওয়া যাবে না। এতে নানান জটিলতা দেখা দেবে। ওজনেও সমস্যা হবে। চাল-ডালের ক্ষেত্রে আমরা বিভিন্ন সময়ে অভিযানে যাই। মোবাইল কোর্টও করা হয়। তাছাড়া অফিসার সংকটের কারণে সবসময় যাওয়াও হয় না।’

পরিবেশ অধিদপ্তর মহানগরের পরিচালক আজাদুর রহমান মল্লিক চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘পরিবেশের ক্ষতিসাধন বলেই সরকার নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। এটা তো পচনশীল না। এটা যেখানে থাকবে সেখানেই সমস্যা করবে। নিষেধাজ্ঞা দেয়ার পর মনিটরিং, তত্ত্বাবধানের বিষয়টি পাট অধিদপ্তরের ছিল। ওরা যা পারছে তা করছে। ইতিমধ্যে মোবাইল কোর্ট আমরা যতটুকু পারি শুরু করেছি। আমাদের ম্যাজিস্ট্রেট সংকটের কারণে কিছুদিন অভিযানে ব্যাঘাত ঘটেছে।’

তিনি বলেন, ‘ওরা (পাট অধিদপ্তর) কী করছে না করছে তা তো জানি না। তারা আমাদের সাথে সমন্বয় করে করছে না। তাছাড়া হেল্পও (সাহায্য) চায় না।’

প্রসঙ্গত, পাটের বহুমুখী ব্যবহার, সম্প্রসারণ এবং পরিবেশ সংরক্ষণের উদ্দেশে গত ২০১৮ সালের ১২ আগস্ট পোল্ট্রি ও ফিশ ফিডের মোড়কে পাটের বস্তার ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়। এর আগে গত ২০১৫ সালের ১৭ ডিসেম্বর ধান, চাল, গম, ভুট্টা, সার, চিনি সংরক্ষণ ও পরিবহনে বাধ্যতামূলকভাবে পাটের বস্তা ব্যবহারের নির্দেশ দেয় বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়। এরপর ২০১৭ সালের ২৪ জানুয়ারি পেঁয়াজ, আদা, রসুন, ডাল, আলু, আটা, ময়দা, মরিচ, হলুদ, ধনিয়া ও তুষ-খুদ-কুঁড়ার মোড়ক হিসেবে পাটের বস্তার ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়।

এদিকে পণ্যে পাটজাত মোড়কের বাধ্যতামূলক ব্যবহার আইন, ২০১০-এর ধারা-১৪ অনুযায়ী পাটের মোড়ক ব্যবহার না করলে অনূর্ধ্ব এক বছর কারাদন্ড অনধিক ৫০ হাজার টাকা অর্থদন্ড বা উভয় দন্ডে দন্ডিত করা হবে। এ অপরাধ পুনঃসংগঠিত হলে সর্বোচ্চ দণ্ডের দ্বিগুণ দণ্ডে দণ্ডিত করা হবে।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!