প্র্যাংক কলে ফেসবুক কাঁপাচ্ছে চট্টগ্রামের ছেলে উৎস

‘আসকে আমার মন ভালো নেই’

‘আসকে আমার মন ভালো নেই’— চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার এমন একটা মজার সংলাপ হঠাৎ ভাইরাল হয়ে গেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। সংলাপের মূল বিষয়বস্তু যদিও ‘মন ভালো নেই’, তবে মানুষ সেই সংলাপ বিনিময় করছে মূলত ‘মন ভালো’ করতেই। বন্ধুদের আড্ডায়, রাজনৈতিক সভায় বা ফেসবুকের ক্যাপশানে জায়গা পাচ্ছে মজা করে বলা সেই কথাটি। এমনকি অনুকরণের চূড়ান্ত রূপ দেখিয়ে দেশের একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় খাতায়ও এক ছাত্র লিখেছেন— ‘স্যার আমার মন ভালো নেই’।

চলছে ‘চিটাইংগে টিভি’র নতুন ওয়েব সিরিজের শুটিং
চলছে ‘চিটাইংগে টিভি’র নতুন ওয়েব সিরিজের শুটিং

যার সংলাপ নিয়ে এতো মাতামাতি, নেপথ্যের সেই ছেলেটি চট্টগ্রামেরই বাসিন্দা। যদিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তিনি আগে থেকেই জনপ্রিয়। রং মিস্ত্রি শইপ্যা, তৈ আই কিত্তাম, ডোন্ট কেয়ারের পর সর্বশেষ ‘মন ভালো নেই’-এর মত মজাদার সব কনটেন্ট উপহার দিয়ে তিনি অনেকবারই ভাইরাল হয়েছেন।

প্র্যাংক কলের হোসেন মিস্ত্রির সঙ্গে কাশেম।
প্র্যাংক কলের হোসেন মিস্ত্রির সঙ্গে কাশেম।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘কাশেম’ নামে বিপুলভাবে পরিচিত নেপথ্যের এই কনটেন্ট নির্মাতার নাম কাজী হান্নান আহমেদ উৎস। সাবেক সেনা কর্মকর্তা পিতার একমাত্র সন্তান তিনি। স্থায়ীভাবে থাকেন চট্টগ্রাম নগরীর দেওয়ানবাজার এলাকায়।

ছোটবেলা থেকেই দূরন্তপনা কাজ করতো, সেজন্য পড়ালেখাটাও বেশিদূর এগোয়নি। উচ্চমাধ্যমিকের পর উচ্চশিক্ষার জন্য বারেবারে প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটি, মহসিন কলেজ, চট্টগ্রাম কলেজে ভর্তি হলেও কোনখানেই মন বসেনি তার। সর্বশেষ ভর্তি হন উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু সেখানেও যখন সেভাবে মন বসছিল না, তখন সব বাদ দিয়ে তিনি মনোনিবেশ করলেন অনলাইনের জন্য মজাদার কনটেন্ট বানাতে। প্র্যাংক কল করে মানুষকে বোকা বানাতেও তিনি পটু।

সোমবার (২৭ জুন) চট্টগ্রাম প্রতিদিন অফিসে বসে ২৬ বছরের টগবগে এই তরুণ বলছিলেন তার কীর্তির কথা।

শুরুটা হয় দুষ্টুমির মাধ্যমে তৈরি করা ‘প্রমাণ আছে’ প্র্যাংক কলের মাধ্যমে। কাজী হান্নান আহমেদ উৎস বলেন, ‘প্রথমে কোনো ধরনের ভাইরাল হওয়া বা ইউটিউবার হওয়ার ইচ্ছে থেকে এটা করা হয়নি। আমি ছোটবেলা থেকেই মানুষের কণ্ঠ নকল করার চেষ্টা করতাম। এরই ধারাবাহিকতায় বছরদুয়েক আগে এলাকার এক পানরসিক লোকের কন্ঠ নকল করে বানাই আমার প্রথম কনটেন্ট ‘প্রমাণ আছে।’ এরপর রেকর্ডটি আমি মেসেঞ্জারে বন্ধুদের সাথে শেয়ার করি। তারপর সেই অডিওটি যে এত বেশি ভাইরাল হবে তা বুঝতে পারিনি আমি। মূলত এর পর থেকেই বন্ধুদের উৎসাহে এই প্র্যাংক কলের জগতে প্রবেশ করি।’

ইউটিউবার হওয়ার ইচ্ছে কেন হলো— এমন প্রশ্নের জবাবে উৎস বলেন, ‘বছরতিনেক আগেও এই বিষয়টি মাথায় আসেনি। আমার নিজের প্রথম চ্যানেলের নাম— আহমেদ উৎস। সেখানে বিভিন্ন ট্যুর, সিনারির ভিডিও দিতাম। এখন অবশ্য ভিডিওগুলো সরিয়ে নিছি।’

তিনি বলেন, ‘কিন্তু যখন দেখলাম আমার কনটেন্ট ‘প্রমাণ আছে’কে অনেকে নিজেদের পেইজ বা ইউটিউব চ্যানেলে দিয়ে নিজেদের বলে ক্রেডিট নিচ্ছে। তারপরও ভাবলাম হয়তো এটা এমনিতে ভাইরাল হয়েছে। তারপর আবারও একটি প্র্যাংক কল ভিত্তিক কনটেন্ট বানালাম ‘তৈ আই কিত্তাম’ নামে। দেখি ওটাও বেশ ভাইরাল হলো। কিন্তু এই কনটেন্টগুলো মানুষ যখন নিজেদের চ্যানেলে নিজেদের বলে চালিয়ে দিচ্ছে তখন ভাবলাম আমিও একটা চ্যানেল করি। সেই থেকে শুরু ‘চিটাইংগে টিভি’র— যা এখন পর্যন্ত চলছে এবং ভালোই চলছে।’

উৎস বলেন, ‘শুরুতে একটি পার্টটাইম জব করার চেষ্টা করেছিলাম। তারপর সেটা ছেড়ে নিজে ব্যবসা করার চিন্তা করতে করতেই মাঝখানে চলে আসলো ইউটিউবের ভূত। তারপর আর ব্যবসার দিকে যাওয়া হয়নি। এখানেই আপাতত ভালো আছি। ভবিষ্যতেও ইউটিউব নিয়ে থাকতে চাই।’

ইউটিউবার সালমান মুক্তাদিরকে নিজের আইডল মনে করেন উৎস। তবে মানুষের কাছ থেকে যে পরিমাণ অনুপ্রেরণা ও ভালবাসা পান এর থেকে বড় কোনো শক্তি দুনিয়ায় নাই— এমনটিই মনে করেন তিনি।

উৎস জানান, বর্তমানে তার ইউটিউব চ্যানেল ‘চিটাইংগে টিভি’র সাবস্ক্রাইবার প্রায় আড়াই লাখ। এক লাখ সাবস্ক্রিপশনের জন্য ইউটিউব কর্তৃপক্ষ থেকে পেয়েছিলেন সিলভার-প্লে বাটন। এই পর্যন্ত প্রায় ৪০টি কনটেন্ট আপলোড করা হয়েছে চ্যানেলটিতে। এর মধ্যে একাধিক রেকর্ড বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। কিছু কিছু কনটেন্ট ভারতেও দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছে। অন্যদিকে আর ফেসবুক পেইজে রয়েছে সোয়া চার লাখ লাইক।

যেসব প্র্যাংক কল করে মানুষকে বোকা বানান উৎস, তার নেপথ্যের মানুষ কারা— এমন প্রশ্নে উৎস জানান, এখন পর্যন্ত প্রকাশিত প্রায় সব প্র্যাংক কলই তাদের নিজেদের বানানো। আর এতে প্রথম থেকেই তার বিপরীতে কন্ঠ দিয়েছেন তার ‘কাজিন’ ফাহাদ বিন ওয়াহিদ সাকিব। এছাড়াও দু একজন বন্ধু কন্ঠ দিয়েছেন বিভিন্ন কলে।
আর যেসব প্র্যাংক কল ইউটিউব-ফেসবুকে আপলোড হয়েছে, সেগুলো প্রকাশের আগে সংশ্লিষ্টদের অনুমতি নেওয়া হয়েছে।

চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে উৎস বলেন, ‘নিছক বিনোদনের জন্যই এসব প্র্যাংক কল রেকর্ড করা হয়। কাউকে ছোট করার জন্য নয়।’

প্র্যাংক কলগুলোতে স্ল্যাং বা গালাগালিও থাকে— এমন কথা মনে করিয়ে দিলে দুঃখ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘আমরা চট্টগ্রামের মানুষজন একটু গালাগালি করি। তবে বর্তমানে আমরা এসব ছাড়াই কল রেকর্ড তৈরি করছি। কারণ প্রথমদিকে আমাদের দর্শক ছিল যুবকরা। কিন্তু এখন আমার বাবাসহ সমাজের সব শ্রেণির মানুষ আমার এই রেকর্ডগুলো শোনেন। সেজন্য সিনিয়রদের কথা চিন্তা করে আমি স্ল্যাং শব্দগুলো বাদ দিচ্ছি।’

তবে তার যে চরিত্র ‘কাশেম’, সেই লোকটি বাস্তবেই আছেন। সেই লোকটি পান খেতে খেতে মানুষের সাথে যেভাবে কথা বলেন, উৎস সেটা নকল করতে গিয়েই মূলত ক্যামেরার পিছনে নিজের ক্যারেকটারটা ঠিক করে ফেলেন।

এদিকে প্র্যাংক কলের কারবার ছাড়াও উৎস এখন কাজ করছেন একটি ওয়েব সিরিজেও। ‘ডরাইল্ল্যা ভূত’ নামে নাটকটির শুটিং শেষ হয়েছে কদিন আগেই। কোরবানির ঈদের সপ্তম দিন নিজেদের ইউটিউব চ্যানেলে প্রকাশ করা হবে নাটকটি। নাটকটির শুটিং হয়েছে চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি ছাড়াও রাজশাহীতে।

কম বাজেটের হলেও মানুষ এই নাটকে নতুনত্ব খুঁজে পাবে বলে আশাবাদী চট্টগ্রামের এই ইউটিউবার। পৃষ্ঠপোষক ও শুটিং সেটআপ পেলে চট্টগ্রাম থেকেই জাতীয় মানের নাটক উপহার দেওয়ার সক্ষমতা তার টিমের আছে বলে জানান তিনি।

উৎসের শখের মধ্যে আছে বাইক রাইডিং, ফটোগ্রাফি ও মিউজিক। এখন শুধু লাদাখ ও হিমালয়ের চূড়ায় ওঠার শখ পূরণ করতে চান তিনি। ব্যক্তিগতভাবে ফুটবলে ব্রাজিল দলের সমর্থক হলেও প্রিয় খেলোয়াড় হিসেবে মেসিকেই পছন্দ করেন উৎস।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!