প্রেসক্রিপশনে অপ্রয়োজনীয় ওষুধের ছড়াছড়ি, কোম্পানির টার্গেট পূরণই মূল লক্ষ্য

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল

রোগীরাই শুধু নয়, চিকিৎসকরা মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভদের (ওষুধ কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধি) কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছেন। এর প্রধান কারণ হচ্ছে বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির কাছ থেকে উপহার নেওয়া। চিকিৎসকদের ম্যানেজ করতে প্রয়োজনীয় উপহার কোম্পানির পক্ষ থেকে সরবরাহ করা হয়। আর এ কারণেই চিকিৎসকরা তাদের পছন্দের কোম্পানির ওষুধ লিখতে প্রভাবিত হন। এসব উপহার সামগ্রীর মধ্যে রয়েছে ঘরের ফার্নিচার, এসি, ফ্রিজ, টেলিভিশন, ল্যাপটপসহ নানা দামি জিনিসপত্র। এ ছাড়াও নমুনার নামে রয়েছে একগাদা ফ্রি ওষুধ। এর ফলে চাপে পড়ে চিকিৎসকরা প্রেসক্রিপশনে প্রয়োজনের অতিরিক্ত ওষুধ লিখছেন।

ক্ষোভ প্রকাশ করে রোগী সাইদুল আনোয়ার বলেন, ‘এদের দৌরাত্ম্যের কারণে বাধ্য হচ্ছি অপ্রয়োজনীয় অবাঞ্ছিত অথবা নিম্নমানের ওষুধ কিনে খেতে। আসলে নতুন ডিজিটাল এই জনস্বার্থবিরোধী কর্মকাণ্ড থেকে আমাদের সকলের সচেতন হওয়া প্রয়োজন। ডাক্তাররাও লোভে পড়ে আমাদের ক্ষতির মুখে ফেলছেন।

জানা গেছে, বর্তমানে প্রায় দেড় হাজার মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভ শহরের বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ক্লিনিকগুলোতে কাজ করছেন। প্রতিটি কোম্পানি থেকে বিক্রয় প্রতিনিধিদের ওপর একটি চাপ থাকে নির্দিষ্ট ওষুধের বিক্রি বাড়ানোর। আর ওষুধের বিক্রি বাড়ানো ও লক্ষ্যমাত্রা পূরণের ওপর নির্ভর করে তাদের চাকরি, প্রমোশন এবং বেতন-কমিশন। এ কারণে ব্যবস্থাপত্রে (প্রেসক্রিপশন) প্রতিটি কোম্পানির প্রতিনিধিরা ওষুধ লেখাতে অনেক সময় বেপরোয়া হয়ে ওঠেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বিক্রয় প্রতিনিধি জানান, প্রতি সপ্তাহে তাদের একটা টার্গেট দেওয়া হয়। ওই টার্গেট অনুপাতে চিকিৎসকরা প্রেসক্রিপশন দিচ্ছেন কি না— তাও মনিটরিং করতে হয়। প্রতিষ্ঠানকে বিশ্বাস করানোর জন্য মোবাইলে প্রেসক্রিপশনের ছবি তুলে রাখতে হয় এবং রোগীর প্রেসক্রিপশন দেখতে হয়। আর এজন্য তাকে সকাল থেকে হাসপাতালে থাকতে হয়।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বহির্বিভাগের একজন অধ্যাপক জানান, পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের মেডিকেল কাউন্সিল অব ইন্ডিয়া আইন করেছে ওষুধ কোম্পানির কাছ থেকে উপহার নিলে বিভিন্ন মেয়াদে চিকিৎসা সনদ বাতিলের জন্য। তবে বাংলাদেশে এখনও পর্যন্ত এ সংক্রান্ত কোনো আইন তৈরি হয়নি।

তবে ওই অধ্যাপক বলেন, বাজারে নতুন ওষুধ এলে ওষুধের জেনেরিক নাম এবং ব্রান্ডের নাম জানতে চিকিৎসকরা মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভদের ওপর নির্ভর করেন। তবে তারা আজকাল এত বেপরোয়া হয়ে উঠছে যে তারা বিভিন্ন ওষুধের নাম সিল মেরে দিচ্ছে, যাতে করে তা লেখে। এক্ষেত্রে রোগীদের প্রকৃত চিকিৎসা গৌণ, ওষুধ লেখাই যেন মূখ্য। কখনো কখনো চিকিৎসক তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে অতিরিক্ত ওষুধ লিখতে বাধ্য হন। ফলে সাধারণ মানুষ প্রকৃত চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত।

তবে উপহার সামগ্রী নেওয়া প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উপপরিচালক ডাক্তার আখতারুল ইসলাম বলেন, ‘ওরা মিছা (মিথ্যা) কথা বলে। কোনো ডাক্তারের এমন কোনো অভাব নাই যে এসব নেবেন। দিলে বড়জোর একটা গ্লাস দেয়। দুইটা প্যাড (নোটবুক) দেয় বা অন্য কিছু। তাছাড়া এগুলো দেয় যারা বাইরে প্র্যাকটিস করে তাদের। এখানে (হাসপাতালে) তো প্র্যাকটিস করা হয় না। আর এখানে যে ওষুধ লিখে এগুলো জেনুইন। কারও দ্বারা প্রভাবিত হয়ে না।’

তবে বিষয়টি স্বীকার করে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বহির্বিভাগের একজন ডাক্তার চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘কথাটি একেবারে মিথ্যাও না। তবে সবাই তো সমান না। সব পেশায় যেমন ভালো খারাপ আছে এখানেও তাই। কেউ কেউ প্রভাবিত হয়ে বাড়তি ওষুধ লেখেন। তবে এটা সত্য ডাক্তারদের আহামরি অভাব নেই যে তারা এমন সাধারণ উপহার নেন। উপহারটা একটু ভিন্ন— দেশের বাইরে যাওয়ার মতন অনেক ক্ষেত্রে। আর বেশি কিছু না বলি। এক্ষেত্রে প্রকৃত চিকিৎসা ব্যাহত হচ্ছে। তদারকিটা খুব দরকার যা আমাদের এখানে হয় না।’

আগের পর্বে
চট্টগ্রাম মেডিকেলে রোগী এলেই হামলে পড়ে ওষুধ কোম্পানির লোক!

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!