প্রাইভেট কারে যাত্রীবেশে বেপরোয়া ছিনতাইকারী

চালকরা নির্মম নৃশংসতার শিকার

শুরুতে দেখে মনে হবে নিরীহ কোনো যাত্রী। জরুরি প্রয়োজনে গাড়ির দরকার। কিন্তু গাড়িতে ওঠার পরই পাল্টে যায় ‘নিরীহ যাত্রী’দের চেহারা। চালককে হত্যা করে গাড়ি বাগিয়ে নেওয়াই তাদের লক্ষ্য—এরা যাত্রীর ছদ্মবেশে সংঘবদ্ধ ছিনতাইকারী, খুনেও যারা সিদ্ধহস্ত।

নগরীতে এই ধরনের কার ছিনতাইকারী চক্রের গত কয়েক বছর ধরে সক্রিয়। নৃশংস কায়দায় চালককে হত্যা করে প্রাইভেট কারটি নিয়ে পালিয়ে যায় এরা। সর্বশেষ শুক্রবার ১২ এপ্রিল রাতে খুন হয়েছেন কারচালক নুরুল গণি শিমুল। এ ঘটনায় গ্রেফতার হয়েছেন তিনজন।

জসিম উদ্দিন, নুর মোহাম্মদ ও আবদুল হাকিম – ওরা তিনজনই প্রাইভেট কার চালক। যাত্রীদের হাতে নিহত হয়েছিলেন সবাই। খুনীরা যাত্রীর ছদ্মবেশে ছিনতাইকারী। ধারাবাহিক খুনের ঘটনায় শুক্রবার (১২ এপ্রিল) রাতে যুক্ত হয়েছে আরেকটি নাম নুরুল গণি শিমুল।

নুরুল-গণি-শিমুলজানা গেছে, চার ব্যক্তি শিমুলের পরিচালিত প্রাইভেট কারটি দেড় হাজার টাকা ভাড়ায় ঠিক করে সীতাকুণ্ড থেকে নগরের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। প্রাইভেট কারটি হাতিলোড়া নামক স্থানে এসে পৌঁছালে পেছনের সিটে বসা যাত্রীবেশী ছিনতাইকারীরা রশি দিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে চালক শিমুলকে। পরে চার যাত্রীর মধ্যে একজন (ইমন) প্রাইভেট কারটি চালিয়ে বঙ্গোপসাগর সংলগ্ন বেড়িবাঁধের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়। পথ ভুলে তারা আকবরশাহ থানার ঈশান মহাজন সড়কে চলে আসে। ওই সড়কে তাদের গাড়ির আঘাতে সবিতা রানী বিশ্বাস নামে এক মহিলার বাসার গ্যাস পাইপলাইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই সূত্রে তাদের মধ্যে বাকবিতণ্ডা শুরু হয়। একপর্যায়ে স্থানীয়রা সবিতা রানীর পক্ষ নিয়ে ওই চার যাত্রীর ওপর চড়াও হয়। তখন মীর হোসেন নিশান ও রবিউল হোসেন ইমন নামে দুজনকে আটক করে পুলিশকে খবর দেয় স্থানীয়রা। পুলিশ গিয়ে সেই প্রাইভেট কার থেকে উদ্ধার করে চালকের লাশ।

প্রাইভেট কারে যাত্রীবেশে বেপরোয়া ছিনতাইকারী 1নিশান ও ইমনের স্বীকারোক্তিতে জানা যায়, ছকে আঁকা এক হত্যাকাণ্ডের কাহিনী। তাদের স্বীকারোক্তি অনুসারে রাতভর অভিযান চালিয়ে পুলিশ অন্য যাত্রী নওয়াজ শরীফকে নগরের চান্দগাঁও এলাকা থেকে গ্রেফতার করে। শনিবার ১৩ এপ্রিল প্রাইভেটকার চালক শিমুলের পিতা বাদি হয়ে আকবর শাহ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।

জসিমের লাশটি ছিল হাত-পা বাধা

২০১৩ সালের ৪ মে সকাল সাড়ে ৯টায় এলাকাবাসীর দেওয়া তথ্যে রাউজানের ব্রাহ্মণহাট এলাকা থেকে পুলিশ উদ্ধার করে প্রাইভেট কারচালক জসিম উদ্দিনের লাশ। জসিম সাতকানিয়ার কেঁওচিয়া ইউনিয়নের আমির হোসেনের ছেলে। জানা যায়, আগের দিন শুক্রবার সন্ধ্যায় কয়েকজন যুবক চন্দ্রঘোনা লিচুবাগান এলাকায় যাওয়ার কথা বলে শহর থেকে প্রাইভেট কারটি ভাড়া করে। রাতে গাড়ি ফেরত নিয়ে আসার কথা বললেও আর ফিরে আসেনি। এই ঘটনায় মামলা হয়েছিল। প্রতিবেদন তৈরির সময় এ বিষয়ে অধিকতর জানতে ওসির মুঠোফোনে ফোন করে সাড়া পাওয়া যায়নি।

ডান চোখটি উপড়ানো ছিল নুর মোহাম্মদের

২০১৪ সালের ১০ মার্চ পটিয়া থানা পুলিশ উদ্ধার করে হাত-পা বাঁধা একটি অজ্ঞাত লাশ। লাশের ডান চোখটি উপড়ানো ছিল। এর আগের রাতে ৯ মার্চ কক্সবাজারে (চট্টমেট্টো-গ-১২-৮৫৭৯) নম্বরের একটি প্রাইভেট কার বিক্রি করতে গিয়ে র্যাবের হাতে সন্দেহভাজন হিসেবে আটক হয় মোহাম্মদ ফারুক ও ফিরোজ।
ফারুক ও ফিরোজের জিজ্ঞাসাবাদে উঠে আসে গা শিউরে ওঠা কাহিনী। গাড়ি চালানো শেখার কথা বলে হালিশহর এলাকার প্রাইভেটকার চালক নুর মোহাম্মদের সাথে সখ্য গড়ে তোলেন ফারুক। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী কক্সবাজার বেড়াতে যাওয়ার কথা বলে ৯ মার্চ ভাড়া করা হয় ওই গাড়ি। কিন্তু হালিশহর থেকে বেরিয়ে পোর্ট কানেকটিং রোডে আসার পর চালক নুর মোহাম্মদের গলায় রশি পেঁচিয়ে তাকে হত্যা করে লাশটি ফেলে দেওয়া হয় পটিয়া এলাকায়। তার আগে নুর মোহাম্মদের ডান চোখ তুলে ফেলা হয়েছিল। ১১ মার্চ ২০১৪ পত্রিকায় ছবি দেখে নুর মোহাম্মদের স্বজনরা চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে গিয়ে লাশটি শনাক্ত করেন।
মামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়, ৮ মার্চ নগরের বন্দরটিলা এলাকায় ফারুক, মনির, কামাল ও ফিরোজ বসে নুর মোহাম্মদের গাড়িটি ছিনতাইয়ের পরিকল্পনা করেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী কক্সবাজার একটি অনুষ্ঠানে যাওয়ার কথা বলে ফারুকের মাধ্যমে নুর মোহাম্মদের প্রাইভেট কারটি ভাড়া করা হয়।
আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে উঠে আসে, ৯ মার্চ একই এলাকার ওই চার অভিযুক্ত বিকেল চারটায় গাড়ি নিয়ে কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে চট্টগ্রাম পোর্ট কানেকটিং এলাকার নির্জন স্থানে নিয়ে যান। এরপর গাড়ির পেছনের আসনে বসা ফারুক, মনির ও কামাল নুর মোহাম্মদের গলা চেপে ধরে পেছনের আসনে নিয়ে এসে রশি পেঁচিয়ে হত্যা করে। এরপর আসনের নিচে লাশ রেখে তার ওপরে রাখা হয় সাজানো অনুষ্ঠানের প্রদানের জন্য নেয়া গিফট বক্স। চালকের পাশে বসা ফিরোজ গাড়ি চালিয়ে কক্সবাজার পৌঁছে। কক্সবাজার যাবার পথে রাত আটটার দিকে পটিয়া এলাকার নির্জন স্থানে নুর মোহাম্মদের লাশটি ফেলে গাড়িটি নিয়ে কক্সবাজার চলে যান এই চার অভিযুক্ত।

সিটের নিচে চেপে ধরে খুন

৫৫ বছর বয়সের আবদুল হাকিম চালাতেন টিআরএক্স মডেলের একটি গাড়ি। ২৯ নভেম্বর ২০১৭ লালদিঘি পাড় থেকে ১১ হাজার টাকা দিয়ে আবদুল হাকিমের গাড়িটি কক্সবাজার যেতে ভাড়া করে ছিনতাইকারী দলের সাত সদস্য।
কক্সবাজার সুগন্ধা পয়েন্টে গিয়ে (রাত সাড়ে ৯ টা) তারা আবদুল হাকিমকে হত্যার পরিকল্পনা করে। সে অনুযায়ী রাত সাড়ে ১১টায় কক্সবাজার থেকে তারা রওনা দেন। পথে পটিয়া উপজেলার খরনা মুজাফ্ফরাবাদ এলাকায় এসে যাত্রীবেশী ছিনতাইকারী তানিম ও তার আরেক সহযোগী ড্রাইভারকে গলায় ছুরি ধরে সিট থেকে পেছনের সিটে নিয়ে আসে। ড্রাইভারকে সিটের নিচে চেপে ধরে ছুরি দিয়ে জবাই করে হত্যা করা হয়। এ সময় ছিনতাইকারী চক্রের অপর চার সদস্য নিহত চালককে হাত-পা, মুখসহ বিভিন্ন স্থানে চেপে ধরে রাখে। খুনের সময় ছিনতাইকারী চক্রের অন্য এক সদস্য গাড়ি চালাচ্ছিল।
গাড়িটি পটিয়া পৌর সদরের পোস্ট অফিস এলাকায় বালুর মধ্যে আটকে যায়। ছিনতাইকারী গাড়ি চালনায় অনভিজ্ঞ হওয়ায় অনেক চেষ্টা করেও গাড়িটি চালু করতে পারেনি। হাল ছেড়ে দিয়ে এরা গাড়িটি রেখে বাসযোগে নতুন ব্রিজ নেমে যার যার গন্তব্যে চলে যায়। যাওয়ার সময় চালক নিহত আবদুল হাকিমের হাতে থাকা মোবাইল ফোনটিও নিয়ে যায় তাদের একজন ।
পরে লাশ শনাক্তকরণ শেষে নিহতের ছেলে পারভেজ বাদি হয়ে পটিয়া থানায় একটি হত্যামামলা দায়ের করেন। খুনের কিনারা খুঁজে পেতে প্রযুক্তির সাহায্য নেয় পটিয়া থানা পুলিশ। একপর্যায়ে গত বছরের ৬ ফেব্রুয়ারি ভোর রাতে গ্রেফতার করা হয় দুই অভিযুক্ত মাঈনুর রশিদ তানিম ও সাব্বির হোসেনকে। তানিম গ্রেফতার হয় নগরের বহদ্দারহাট থেকে এবং সাব্বির গ্রেফতার হয় পাবনার সাথিয়া থেকে।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!