প্রবাসী বড় ভাইয়ের পাঁচতলা বাড়ি দখলের অভিযোগ সাতকানিয়ার কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে

দলবল নিয়ে চালানো হয় হামলা, মামলা দিয়েও হয়রানি

চট্টগ্রামের সাতকানিয়া পৌরসভার ৭ নং ওয়ার্ডের আবদুল গফুরের পঞ্চম সন্তান মো. জহির উল্লাহ্। জীবিকার তাগিদে ১৯৯৫ সালে গিয়েছিলেন প্রবাসে। প্রবাসজীবনে হয়েছেন সফলও। প্রবাসের অর্জিত টাকা দিয়ে নিজেদের জমিতে করেন প্রায় সোয়া দুই কোটি টাকা ব্যয়ে একটি ভবনও। কিন্তু সেই ভবনটিই এখন প্রবাসী জহিরের দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। গায়ের জোরে নিজের আপন ছোট ভাই দখল করে নিয়েছেন সম্পূর্ণ ভবনটিই। নিজের জায়গা ও কষ্টার্জিত টাকায় করা ভবনে থাকতে পারছেন না জহির নিজেই।

জহির উল্লাহ্ জানান, একসময় ছোট ভাই আরাফাত উল্লাহকেও তিনি নিয়ে যান বিদেশে নিজের কাছে। তবে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে তেমন শিক্ষিত না হওয়ায় আরাফাত টিকতে পারেননি বিদেশে। আরাফাত দেশে ফেরত আসলেও তার ভরণপোষনের অর্ধেক দায়িত্ব নেন বড় ভাই জহির। কিন্তু পরবর্তীতে জামায়াতের সমর্থনে গত পৌরসভা নির্বাচনে জয়ী হয়েই ক্ষমতা দেখাতে থাকেন আরাফাত। সর্বশেষ এ বছরের ১৫ আগস্ট মধ্যরাতে নিজের কর্মীবাহিনি নিয়ে দখল করে নেন বড় ভাইয়ের পাঁচতলা ভবন। শুধু তাই নয়, মিথ্যা মামলা দিয়েও করছেন হয়রানি।

সাতকানিয়া পৌরসভার ৭ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মো. আরাফাত উল্লাহর বিরুদ্ধে এমন সব অভিযোগ এনেছেন তার বড় ভাই জহির উল্লাহ।

ভুক্তভোগী জহির উল্লাহ বলেন, ‘পারিবারিকভাবে আমাদের পাঁচ ভাইকে মোট ২২ গন্ডা জায়গা ভাগ করে দেন আমার মা-বাবা। আমি তারপরও সাড়ে চার গন্ডা জায়গা আলাদাভাবে কিনে একটি বিল্ডিং তৈরির চেষ্টা করি। যে জমির বিএস খতিয়ানও আমার নামে রয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘এরপর প্রবাসে থাকা অবস্থায় আমি আমার কেনা জায়গার ওপর ২০১৪ সালে ভবন নির্মাণ শুরু করি এবং ২০১৭ সালে পাঁচতলা ভবনটির প্রাথমিক কাজ শেষ করি। তবে কাজ চলাকালে যেহেতু আমি বিদেশে ছিলাম, সেজন্য ভবনটির দেখাশোনা ও নির্মাণকাজ তদারকির বিষয়গুলো দেখাশোনার জন্য ২০১৪ সালের নভেম্বরে আমার ছোট ভাই আরাফাতকে মাসিক ২০ হাজার টাকা বেতনে কেয়ারটেকার হিসেবে চাকরি দিই এবং তার মাধ্যমেই ভবন তৈরির আনুষঙ্গিক খরচ লেনদেন করি। কিন্তু এর মধ্যে ভবনটির বেশ কয়েকটি ফ্ল্যাট সম্পূর্ণ তৈরি হয়ে যাওয়াতে ফ্ল্যাটগুলো ভাড়া দেওয়ার প্রস্তাব দেয় আরাফাত। কিন্তু আমি দেশে আসার পর যখন ভাড়াটিয়ার হিসাব ও ভবন তৈরির ব্যয়ের হিসাব খুঁজি, তখন সে নানান তালবাহানা শুরু করে।’

জহির উল্লাহ বলেন, ‘এর মধ্যে সর্বশেষ অনুষ্ঠিত পৌরসভা নির্বাচনে কাউন্সিলর নির্বাচিত হয় আরাফাত। এরপর থেকেই বিভিন্ন কৌশলে ক্ষমতার দাপট দেখাতে শুরু করে সে।’

ভুক্তভোগী আরও জানান, ‘পাইলিংসহ ভবনটি তৈরিতে আমার সর্বমোট সোয়া দুই কোটি টাকা খরচ হয় এবং এর সম্পূর্ণ টাকাও আমার। কিন্তু আরাফাতকে যখন আমি কেয়ারটেকার হিসেবে চাকরি দিই, তখন সে বেকার ছিল। কিন্তু আমি ভবন তৈরির হিসাব চাওয়ার পর সে দাবি করে সোয়া দুই কোটি টাকার মধ্যে তারও ভাগ রয়েছে। সে বিভিন্ন জায়গায় বলেছে সে নাকি ৬০ লাখ টাকা খরচ করেছে ভবন তৈরিতে। কিন্তু যে মানুষটা আমার বেতনে সংসার চালিয়েছে, সে কিভাবে ৬০ লাখ টাকা খরচ করতে পারে?’

এসব অভিযোগের বিষয়ে কথা বলা হয় সাতকানিয়া পৌরসভার ৭নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আরাফাত উল্লাহর সঙ্গে। মাসিক ২০ হাজার টাকায় চাকরি করার বিষয়টি স্বীকার করলেও বাকি অভিযোগগুলো অস্বীকার করেন তিনি। এ বিষয়ে আরাফাত বলেন, ‘জহির উল্লাহ যে জায়গাটিতে ভবন তৈরি করেছে সেখানে আমারও ভাগ আছে। ওই জমিটির পারিবারিকভাবে আমিও মালিক, তাই সে এককভাবে জায়গাটি ও ভবনটির মালিকানা দাবি করতে পারে না।

ভবন তৈরিতে খরচের বিষয়ে কাউন্সিলর আরাফাত বলেন, তিনি বিভিন্ন ব্যাংক ও জায়গা থেকে লোন নিয়েই ভবন তৈরিতে ব্যয় করেছেন। এখন বড় ভাই জহিরের ষড়যন্ত্রে তিনি ভাড়াও তুলতে পারছেন না। যার জন্য তিনি ঋণের টাকাও পরিশোধ করতে পারছেন না।

আর ভবনটির জায়গাতে নিজের অংশীদারিত্ব আছে— এর সপক্ষে কিছু দলিলও দেখান প্রতিবেদককে।

তবে সেই দলিলে যে জায়গাটুকুর কথা উল্লেখ আছে তা ১৯৯৯ সালে ক্রয়কৃত এবং জায়গাটি পাঁচ ভাইয়ের নামেই কেনা। আর জহির উল্লাহ যে জায়গাটিতে ভবন তৈরি করেছেন সেটি এই দাগের জমি নয় বলে দাবি করেছেন জহির। এছাড়াও ভবন তৈরির আগে করা সয়েল টেস্ট, অনুমতিপত্র, ডিজাইন ও ভবনটির বৈদ্যুতিক সংযোগের মিটারের মালিকানার অংশেও শুধুমাত্র উল্লেখ রয়েছে জহির উল্লাহর নাম। এছাড়াও যে ঠিকাদারের মাধ্যমে ভবনটি নির্মাণ করা হয়েছে সেই ঠিকাদারের সাথে চুক্তিপত্রেও মালিক হিসেবে শুধুমাত্র জহিরের নাম দেখা যায়। এক্ষেত্রে মালিকানার দাবিতে আর কোনো দলিল দেখাতে পারেনি অভিযুক্ত আরাফাত। এরপরও গায়ের জোরে ভবনটি দখল করে রেখেছেন আরাফাত। বিষয়টি নিয়ে একাধিকবার প্রশাসনের দ্বারস্থ হলেও কার্যত কোন সুরাহা পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ করেন জহির উল্লাহ।

জহির উল্লাহ বলেন, তার ছোট ভাই আরাফাত প্রথমদিকে শিবিরের রাজনীতি করলেও বর্তমানে কাউন্সিলর হওয়ার পর সে আওয়ামীলীগার হয়ে গেছে। সেই প্রভাব দেখিয়ে সে থানা পুলিশ ও প্রশাসন সব ম্যানেজ করে নিয়েছে। একাধিকবার সাতকানিয়ার পৌরসভার মেয়র ও থানার কাছে লিখিত অভিযোগ দিলেও কাজের কাজ কিছু হয়নি বলে জানান তিনি।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে কথা হয় সাতকানিয়া পৌরসভার মেয়র মোহাম্মদ জোবায়েরের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘সমস্যাটা জায়গাতে না, সমস্যাটা হচ্ছে ওদের ভিতরেই। আমি একাধিকবার এ বিষয়ে দুই পক্ষকে বসার আহ্বান করলেও কোন পক্ষই বসেননি। আমি এও বলেছি যে, যদি আমার সাথে বসতে কারও আপত্তি থাকে তবে আমি সাতকানিয়ার এসিল্যান্ড বা পুলিশের সার্কেল এসপির সাথে বসার ব্যবস্থা করে দিতে পারি যাতে সমস্যাটা সমাধান হয়। কিন্তু তারপরও তারা মীমাংসার জন্য না বসে একে অপরের বিরুদ্ধে কথা ছড়াচ্ছে।’

কাউন্সিলর আরাফাতের শিবির সংশ্লিষ্টতা নিয়ে মেয়র জোবায়ের বলেন, ‘ওদের যে এলাকাটা, ওখানে যে শিশুটা জন্মগ্রহণ করে সেও শিবির করে। ওই এলাকাতে আওয়ামী লীগ নাই বললেই চলে। তবে আরাফাত প্রথমে শিবির করত। কিন্তু নির্বাচনে জেতার পর সে আওয়ামী লীগ হয়ে যায়। এমনকি গত সপ্তাহে হওয়া সাতকানিয়া উপজেলার সম্মেলনে যে মিছিলটা যোগ দেয় তাতেও সর্বপ্রথম সারিতে আরাফাত ছিলো। সেজন্য স্থানীয় জামায়াতের নেতারাও দুঃখ করে বলেন— ‘কাউন্সিলর বানালাম আমরা, আর এখন হয়ে গেল আওয়ামী লীগ’। তবে সে শিবির করলেও ভালো ছেলে।’

আরাফাত অবশ্য এমন অভিযোগ মিথ্যা দাবি করে বলেন, তিনি কখনোই শিবিরের রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন না। তিনি এমপি আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামউদ্দিন নদভীর রাজনীতি করেন বলে জানান এবং এমপির আর্শিবাদেই কাউন্সিলর হয়েছেন বলে দাবি করেন আরাফাত।

এদিকে ভবনের মালিকানার বিষয়ে সাতকানিয়া থানায় পাল্টাপাল্টি অভিযোগ দায়ের করেছেন আপন দুই ভাই-ই। এ বিষয়ে সাতকানিয়া থানা পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়, বিষয়টি পারিবারিক। এক ভাই অন্য ভাইকে দোষারোপ করছেন। এ বিষয়কে কেন্দ্র করে যাতে আইনশৃঙ্খলার কোন অবনতি না হয় আমরা সেদিকে খেয়াল রাখছি এবং অভিযোগের বিষয়টি তদন্ত করছি।

অভিযোগে জানা গেছে, গত ১৫ আগস্ট রাতে দলবল নিয়ে হামলা চালিয়ে জহির উল্লাহর নবনির্মিত ভবনটি দখল করে নেন আরাফাত। ভাংচুর চালানো হয় ভবনটির পাঁচতলায় থাকা জহির উল্লার ফ্ল্যাটেও। ঘটনার দিনই জহিরের দামি আসবাবপত্র, নগদ টাকা ও স্বর্নালংকার চুরির অভিযোগ এনে সাতকানিয়া থানায় অভিযোগ দেন জহির। এছাড়াও নিরাপত্তা চেয়ে চট্টগ্রাম জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে একটি সাধারণ ডায়েরি এবং নিজের ভবনটি অবৈধ দখল ও ভাংচুরের কারণে আরও একটি মামলা করা হয় আমলী আদালতে। মামলাটি পুলিশ ব্যুরো ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।

ওই মামলার বিষয়ে জহির বলেন, ‘২০১৯ সালের ২০জানুয়ারি আমাদের মা আম্বিয়া বেগম জীবিত থাকা অবস্থায় একটি দলিল তৈরি করেন। যাতে স্পষ্ট করেই লেখা আছে আমাদের পাঁচভাই কে কোন্ অংশে থাকবেন। আমি আমার অংশে থাকার পরও লোভে পড়ে আরাফাত আমার ক্ষতি করছেন। আমি আমার হারানো সম্পত্তি ফিরে পাওয়ার আশায় এই মামলাগুলো করেছি। কিন্তু আরাফাতের কোন ক্ষতি না করার পরও সে আমাদের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা করেছে এবং তার স্ত্রীকে দিয়ে আমাকে মিথ্যা নারী নির্যাতনের হুমকি দেওয়ায় আমি আমার বিল্ডিংয়েও যেতে পারছি না। বর্তমানে আমাকে শহরে ভাড়া বাসায় থাকতে হচ্ছে।’

প্রবাসী জহির বলেন, ‘সারাজীবন প্রবাসে কষ্ট করার পর দেশে এসেও আমার কষ্ট শেষ হচ্ছে না। তবে আমি আইনের প্রতি ভরসা রাখি যে, দেশের আইন অন্তত আমাকে শেষ বয়সে শান্তিতে থাকার ব্যবস্থা করে দেবে।’

বিএস/সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!