প্রধানমন্ত্রীর উপহার নিয়ে নয়-ছয় হল চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায়ও

করোনাভাইরাসে উদ্ভুত পরিস্থিতিতে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে কর্মহীন মানুষের জন্য পাঠানো প্রধানমন্ত্রীর মানবিক সহায়তার টাকা গ্রহণের তালিকায় এবার দেখা গেল চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলার লালানগর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও ইউপি সদস্যদের স্বজন, তাদের নিকটাত্মীয়দের পাশাপাশি প্রবাসী, এমপিওভুক্ত শিক্ষকসহ বিত্তবানদের নাম।

সরকারের ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্মহীন হয়ে আর্থিক কষ্টে পড়ে যাওয়া নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য তালিকাভুক্ত প্রতিটি পরিবারের জন্য আড়াই হাজার টাকা মোবাইল ব্যাংকিং সেবা নগরের মাধ্যমে সারাদেশের ভুক্তভোগীদের মুঠোফোনে সরাসরি পাঠিয়েছেন। কোনো কোনো জায়গায় সরকারের নেওয়া প্রশংসিত এই অনুদান ব্যবস্থার অপব্যবহার করেছেন জনপ্রতিনিধিরাই।

প্রধানমন্ত্রীর উপহার নিয়ে নয়-ছয় করার অভিযোগ উঠেছে ইউপি সদস্যদের মধ্যে ২ নম্বর ওয়ার্ডের কাজী মঈন উদ্দিন, ৪ নম্বর ওয়ার্ডের আইয়ুব আলী, ৫ নম্বর ওয়ার্ডের দিদারুল ইসলাম, ৮ নম্বর ওয়ার্ডের কাঞ্চন মিয়া ছাড়াও লালানগর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মীর তৌহিদুল ইসলাম কাঞ্চনের বিরুদ্ধেও।

খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, এক ওয়ার্ডের বাসিন্দার নাম অন্য ওয়ার্ডে তুলে নেওয়া হয়েছে সহায়তার টাকা। তালিকায় থাকা অনেকেরই মোবাইল নম্বরের ঘরে দেওয়া হয় ইউপি সদস্যের নম্বর। ফলে তালিকায় নাম থাকার পরও কৌশলে মোবাইল নম্বর বদলে দেওয়ায় অনেকেই পাননি প্রধানমন্ত্রীর উপহার।

চট্টগ্রাম প্রতিদিনের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলার লালানগর ইউনিয়নে দুই বিধবার আইডি কার্ড ব্যবহার করে টাকা পাওয়ার মোবাইল নম্বরের ঘরে নিজের ব্যবহৃত মোবাইল নম্বর দিয়েছেন ৪ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য আইয়ুব আলী। তার ৪ নম্বর ওয়ার্ডের তালিকায় ৬৭ নম্বর ছেনোয়ারা বেগমের স্বামী মৃত মো. দুলাল, ৭৩ নম্বর হোচনা আরা বেগমের স্বামী মৃত আহমদর রহমান। তালিকায় দেওয়া মোবাইল নম্বরে ফোন করলে অপর প্রান্তে পাওয়া যায় ইউপি সদস্যকে। প্রধানমন্ত্রীর মানবিক সহযোগিতা প্রার্থীদের নামের তালিকায় তার নম্বর কেন জিজ্ঞেস করলে ইউপি সদস্য আইয়ুব আলী বলেন, ‘নাম্বার তো আমি দিই নাই। কিভাবে আসছে জানি না’— এটুকু বলেই সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন তিনি।

ওই ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের তালিকায় ক্রমিক নম্বর ১৯৩ রোকেয়া বেগমের স্বামী মো. বাবুল। তার নাম-ঠিকানা সব ঠিক থাকলেও মোবাইল নম্বর ইউপি সদস্য দিদারুল ইসলামের। দিদারুল ইসলামের আপন ভাই আজিজুল ইসলামের ছেলে ওমান প্রবাসী মোহাম্মদ ওমর ফারুকের ক্রমিক ১০৬। আরেক সৌদি প্রবাসী ও অঢেল সম্পদের মালিক সৈয়দুল ইসলামের স্ত্রী ডেজি সুলতানার ক্রমিক নম্বর ১১৯। তালিকায় ১০৭ নম্বরে থাকা মুহাম্মদ খোরশেদ আলম রাঙ্গুনিয়া আলম শাহ পাড়া কামিল মাদ্রাসার দাখিল সেকশনের এমপিওভুক্ত শিক্ষক এবং ১২৩ মোহাম্মদ খোরশেদ আলম যিনি সৌদি প্রবাসী হওয়ার পরেও তাদের নাম তালিকাভুক্ত করায় এলাকায় চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে।

এ বিষয়ে দিদারুল ইসলামের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘রোকেয়া বেগম মোবাইল ব্যবহার করেন না। তাই আমার নম্বর দেওয়া হয়েছে। আর তালিকায় অন্য যাদের না দেওয়া হয়েছে তারা উপযুক্ত তাই দিয়েছি।’

৫ নম্বর ওয়ার্ডের তালিকার ৯১ নম্বর সিরিয়ালে থাকা ডেজি আক্তার জানান, তিনি কোন টাকা পাননি। ৯৩ নম্বরের মিজানুর রহমান নিজেও পাননি এবং ৯৪ নম্বরের আজগর হোসেন ৯৫ নম্বরের জসিম উদ্দিন ও ৯৬ নম্বর ক্রমিকের বাবুলও টাকা পাননি বলে জানান মিজানুর রহমান। এছাড়াও ভুক্তভোগীরাই অভিযোগ করেছেন, ৯৯ নম্বর ক্রমিকের শ্যামল দাস, ১০১ নম্বরের ফাতেমা বেগম, ২৫৭ নম্বরের মোহাম্মদ হাকিম, ২৬৩ নম্বরের পটুরানী নাথের নাম ও আইডি নম্বর ব্যবহার করে অন্য মোবাইল নম্বর দিয়ে টাকা উত্তোলন করে আত্মসাৎ করা হয়েছে।

এ ব্যাপারে ইউপি সদস্য আবু তালেব বলেন, ‘অনেকে পেয়েছে। আবার কেউ কেউ পায়নি।’

অন্য মোবাইল নম্বর দিয়ে টাকা আত্মসাতের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমাদের দায়িত্ব ছিল আইডি নম্বর, মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করে জমা দেওয়া। বাকিটা ইউপি সচিব করেছেন। উনি কী করেছেন তা আমরা জানি না।’

৮ নম্বর ওয়ার্ডের তালিকায় ২৯২ নম্বর দিলুয়ারা বেগম ইউপি সদস্য কাঞ্চন মিয়ার প্রবাসী বড় ভাই ইউসুফের স্ত্রী। তাদের সন্তানও স্থানীয় সচ্ছল ব্যবসায়ী। ২৯৬ নম্বরে থাকা আয়েশা খাতুনের মুঠোফোনে ফোন করলে তিনি জানান ইউপি সদস্য কাঞ্চন তার চাচাতো ভাই। তালিকার ২৮৫ নম্বর ক্রমিকের মুহাম্মদ আলী ও ২৯৫ নম্বরের মো. আব্দুল ছমতের নাম ব্যবহার করে ভিন্ন মোবাইল নাম্বার দিয়ে টাকা উত্তোলন করার অভিযোগ উঠেছে কাঞ্চন মিয়ার বিরুদ্ধে। জানা গেছে, ২২০ নম্বর ক্রমিকের শিল্পী দেবীর নাম ঠিকানা ব্যবহার করে উপজেলা সদরের বাসিন্দা শিল্পী নামের আরেকজনের মোবাইল নম্বর দিয়ে টাকা উত্তোলন করা হয়েছে।

এছাড়াও ২০৯ নম্বর ক্রমিকের মৃত আনোয়ার হোসেনের পুত্র মো. করিম ৬ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা। কিন্তু তাকে ৮ নম্বর ওয়ার্ডে তালিকাভুক্ত করে নিয়ে দেওয়া হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর মানবিক সহায়তা। একইভাবে ২৯৯ নম্বরের নাম থাকা আহমদ ছফুরের পুত্র মো. নাছের উদ্দীন ৫ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা এবং ২৮৮ নম্বর ক্রমিকের অধর বসাকের পুত্র রুপন বসাক ২ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা। কিন্তু তাদেরকে মানবিক সহযোগিতা দেওয়া হয়েছে ৮ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা দেখিয়ে।
জানতে চাইলে ৮নং ওয়ার্ডের সদস্য কাঞ্চন মিয়া বলেন, ‘ভাবী পাওয়ার যোগ্য তাই তাকে দিয়েছি।’ অন্য ওয়ার্ডের বাসিন্দাদের নাম তার ওয়ার্ডে কেন জানতে চাইলে ‘এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে আমি বাধ্য নই’ বলে মোবাইল সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন তিনি।

মানবিক সহায়তার জন্য ২ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য কাজী মঈন উদ্দিন তার সহোদর কাজী সাইফুদ্দিনসহ (তালিকায় ৩৯ নম্বর) বেশ কয়েকজন নিকটাত্মীয়ের নাম অন্তর্ভুক্ত করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমার ভাইয়ের নাম মহিলা সদস্য দিয়েছেন। আর আমার কাজী বংশটা অনেক বড়। দলীয়ভাবে কিছু তালিকাভুক্ত হয়েছেন। আমার কোন হাত নেই।’

তালিকা প্রণয়নের এসব অনিয়মের বিষয়ে জানতে চাইলে লালানগর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মীর তৌহিদুল ইসলাম কাঞ্চন চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘তালিকা প্রণয়ন করতে প্রতিটি ওয়ার্ডে আলাদা কমিটি গঠন করে দিয়েছিলাম। ইউপি সদস্য, আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতৃবৃন্দ সমন্বিতভাবে এই তালিকা করেছেন। আমি শুধু স্বাক্ষর করে সেটা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মহোদয়ের কার্যালয়ে জমা দিয়েছি। তাছাড়া যারা সরকারের ১০ টাকা কেজিতে চালসহ অন্য সুযোগ সুবিধা ভোগ করছেন তাদেরকে তালিকার বাইরে রাখতে বলা হয়েছে। কোন প্রবাসী যদি করোনা পরিস্থিতিতে বিদেশে কষ্টে থাকেন তার নাম দিতে অসুবিধা নেই।’

এদিকে তালিকায় মীর মো. সাকিব নামে চেয়ারম্যানের এক ভাতিজা ও জিগারুল ইসলাম নামের এক ভাগ্নের নাম থাকার অভিযোগ উঠেছে। চেয়ারম্যানের দুই ভাগিনা ও ভাতিজার বিষয়ে জানতে চাইলে চেয়ারম্যান বলেন, ‘মীর মো. সাকিব এতিম ছেলে। জিগারুল পেশায় সিএনজিচালক। তারা কেউ আমার রক্তের সম্পর্কের ভাগিনা-ভাতিজা নয়। পাড়ার ভাগিনা-ভাতিজা। নাম আমি দিই নাই, তবে তারা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর মানবিক সহযোগিতা পাওয়ার উপযুক্ত হওয়ায় কমিটি তাদের নাম তালিকাভুক্ত করেছে।’

অনিয়মগুলো প্রসঙ্গে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মো. ইলিয়াছ হোসেনের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এই উপহার বিতরণে কোন রকম অনিয়ম হলে ছাড় দেওয়ার সুযোগ নেই। আমরা অবশ্যই সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নেবো।’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!