প্রধানমন্ত্রীকে আঞ্চলিক গান শোনাতে হল আধুনিক গানের শিল্পীকে!

শিল্পীরা অচ্ছুৎ সিটিভির ১২ ঘণ্টার উদ্বোধনীতে

বাংলাদেশ টেলিভিশন চট্টগ্রাম কেন্দ্রের (সিটিভি) ১২ ঘণ্টার সম্প্রচারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে দাওয়াত না পাওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন চট্টগ্রামের শিল্পীরা। রোববার (২৬ জানুয়ারি) ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে সিটিভির ১২ ঘণ্টা সম্প্রচারের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

প্রধানমন্ত্রী ওই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে নিজ আগ্রহেই শুনতে চেয়েছিলেন মলয় ঘোষ দস্তিদারের গাওয়া চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার গান ‘আঁরা চাটগাঁইয়া নওজোয়ান’। তখন চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক ইলিয়াস হোসেন প্রতিউত্তরে প্রধানমন্ত্রীকে জানান, ‘স্যার, আজকে যেহেতু উদ্বোধন হলো আমরা নেক্সট টাইম যখন আবার কনফারেন্স হবে তখন গান শোনাব। জেলা প্রশাসকের ওই উত্তরের পর প্রধানমন্ত্রী প্রশ্ন করেন, ‘এখানে একজনও গায়ক নাই? এইটা একটা কথা হল?’

এ সময় আঞ্চলিক ভাষার গান গাইতে এগিয়ে আসেন আধুনিক গানের শিল্পী মোস্তফা কামাল। তিনি চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘সেদিন মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী যখন বলতেসে টেলিভিশন কেন্দ্র উদ্বোধন হবে একটা গান হলে ভালো হতো না? ডিসি স্যার বললেন, ‘ ‘না’ আজকে তো উদ্বোধন, গান আমি আপনাকে আরেকদিন অ্যারেঞ্জ করে শোনাবো। তখন উনি (প্রধানমন্ত্রী) আবার রিপিট করে বললেন একজন গানের শিল্পীও কি এখানে নেই? তখন আমি দৌঁড়ে গেলাম আর কি। ভাবলাম আজকে ইজ্জত সম্মান তো যাবেগা মনে হয়! তাও প্রধানমন্ত্রী শুনতে চাইছেন আঞ্চলিক গান, আমি তো আধুনিক গানের শিল্পী। তারপরও সাহস করে গেলাম গাইতে চট্টগ্রামের মান তো বাঁচাইতে হবে। প্রধানমন্ত্রীকে গান শোনাতে পারাটা নিঃসন্দেহে অনেক বড় পাওয়া। সে সময় একজন শিল্পীও সেখানে ছিল না।’

চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের সম্মেলন কক্ষে একই অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধন করেন চট্টগ্রাম ওয়াসার ‘চট্টগ্রাম পানি সরবরাহ উন্নয়ন ও স্যানিটেশন প্রকল্পের (প্রথম সংশোধিত) আওতায় নির্মিত ‘শেখ রাসেল পানি শোধনাগার’। তবে সিটিভির ১২ ঘণ্টার সম্প্রচারের অনুষ্ঠানের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তারকা শিল্পীদের দাওয়াত না পাওয়ায় রীতিমত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও ক্ষোভ ঝেড়েছে চট্টগ্রামের শিল্পী, সঙ্গীত পরিচালক ও সংস্কৃতি সংশ্লিষ্টরা।

‘আঁরা চাটগাঁইয়া নওজোয়ান’ গানটির রচয়িতা, সুরকার ও গায়ক কিংবদন্তী শিল্পী মলয় ঘোষ দস্তিদারের সাথে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানে অনিবার্যভাবে আরও যাদের নাম আসে তারা হলেন লক্ষ্মীপদ আচার্য্য, শেফালী ঘোষ ও শ্যাম সুন্দর বৈষ্ণব। তাদেরই যোগ্য উত্তরসূরী হিসেবে বিবেচিত হন সঞ্জিত আচার্য্য, কল্যাণী ঘোষ এবং তাদের সমসাময়িক আরো কয়েকজন শিল্পী। কিন্তু এ সব খ্যতিমান শিল্পীদের কেউই ছিলেন না বিটিভি চট্টগ্রাম কেন্দ্রের ১২ঘণ্টার সম্প্রচার অনুষ্ঠানে। এছাড়া চট্টগ্রামের শিল্পী-সংস্কৃতি অঙ্গনের বিশিষ্টজনদের কাউকেই দেখা যায়নি অনুষ্ঠানে। শিল্পী-সংস্কৃতি ও বিশিষ্টজনদের অভিমত, সিটিভির বর্তমান জিএম তার ইচ্ছামতই এই কেন্দ্র পরিচালনা করছেন। এই বিশৃঙ্খল অনুষ্ঠানটাই তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ। শেষ পর্যন্ত খোদ প্রধানমন্ত্রীকেই বলতে হলো— ‘একজন গানের শিল্পীও কি এখানে নেই।’ সিটিভির ১২ ঘণ্টার সম্প্রচার অনুষ্ঠান যেমন সবার জন্য নয়, তেমনি অনুষ্ঠান প্রদানেও আছে নানা অনিয়ম ও অস্বচ্ছতা।

শিল্পী সঞ্জিত আচার্য্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি পোস্টে বলেন, ‘আমি না হয় দেশের বাইরে। কিন্তু কল্যাণী ঘোষ, গীতা তো আছে। আসলে আমরা অবহেলিত। এখন ভাবছি আঞ্চলিক গান আর গাইবো না।’ অন্য একটি পোস্টে সিনিয়র শিল্পী কল্পনা লালা বলেন, ‘আমরা যারা চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের শিল্পী আমরা কেউই দাওয়াত পাইনি। কি জানি, কেন এতো অবহেলা আমাদের প্রতি..।’

চট্টগ্রাম শিল্পী কল্যাণ সংস্থার সাবেক সভাপতি ও উপদেষ্টা কায়সারুল আলম রীতিমত হতাশা প্রকাশ করে চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘১২ ঘণ্টা সম্প্রচারের উদ্বোধনীর ব্যাপারে কোনরকম ইনফরমেশনই আমি পাইনি। আবেগ মানে স্বপ্ন, এইটা না থাকলে তো শিল্প বা সাহিত্যকলা হয় না। তবুও থাক কর্তৃপক্ষ যেভাবে চাইছে সেভাবেই তো চলছে।’

শুধুমাত্র দাওয়াত পাওয়া কিংবা না পাওয়া নয়। চট্টগ্রামের শিল্পী ও সংস্কৃতি সংশ্লিষ্টরা চাইছেন সিটিভির সম্প্রচারিত অনুষ্ঠানমালার মানের উন্নয়নে জোরালো সমন্বয়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সিটিভির অভ্যন্তরীণ কিংবা বাহ্যিক কোন মত বিনিময় সভাতেই ডাকা হয় না চট্টগ্রামের সাবেক এবং তারকা শিল্পীদের।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক তারকা শিল্পী চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘শিল্পীরা যাচ্ছে না এই কথা ঠিক না। কেউ না কেউ তো যাচ্ছে। যাদের ব্যক্তিগত কার্যসিদ্ধি হাসিলের উদ্দেশ্যে রয়েছে তারাই যাচ্ছে। তবে প্রচারিত অনুষ্ঠান সমৃদ্ধশালী করার স্বার্থে বৃহত্তর ঐক্যর প্রয়োজন।’

বাংলাদেশ টেলিভিশনের (বিটিভি)তালিকাভুক্ত সঙ্গীত পরিচালক ফরিদ বঙ্গবাসী চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘৯৬ সাল থেকে শুরু করে গত ২৪ বছরে চট্টগ্রামের শিল্পীরাই এই কেন্দ্রের পেছনে সময় দিয়েছে, বিভিন্নভাবে অবদান রেখেছে। কিন্তু তারাই আজ অবহেলিত। সিটিভির কোন প্রোগ্রামেই শিল্পীদের বলা হয় না। কেন জানিনা।’

তবে কেন উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে কেন শিল্পীদের দাওয়াত দেওয়া হয়নি এমন প্রশ্নের জবাবে বিটিভি চট্টগ্রাম কেন্দ্রের ব্যবস্থাপক নিতাই কুমার ভট্টাচার্য বলেন, ‘সিটিভি কোন প্রোগ্রাম আয়োজন করেনি এইটি জেলা প্রশাসন আয়োজন করেছে।’ তবে সিটিভির পক্ষ থেকে জেলা প্রশাসনকে কোন শিল্পীকে দাওয়াত দেওয়া কিংবা জানানো বিষয়টি অবগত করা হয়েছে কী না এমন প্রশ্ন এড়িয়ে গিয়ে তিনি বলেন, ‘সব জেলা প্রশাসন করেছে।’

এসএস

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!