প্রতারণা, গর্ভপাতের চাপ/ চট্টগ্রামের সদ্যবিদায়ী এলএওর বিরুদ্ধে বান্ধবীর অভিযোগ অশেষ

বিয়ে না করে কেবল আশ্বাস দিয়েই তিনি রীতিমতো সংসার পাতিয়ে বসেছিলেন বান্ধবীর সঙ্গে। এভাবে চলছিল ভালোই। কিন্তু হঠাৎ করে বান্ধবীর গর্ভে সন্তান চলে আসার পরই শুরু হয় তার বিগড়ে যাওয়ার পালা। প্রতারণা, গর্ভপাতের চাপ, হুমকিধমকি—আরও কতো কী! অনন্যোপায় বান্ধবী শেষমেশ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের দ্বারস্থ হওয়ার পর এবার ফেঁসে যেতে চলেছেন চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের সিনিয়র সহকারী কমিশনার পদমর্যাদার সদ্য বিদায়ী ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা (এলএও) আসিফ ইমতিয়াজ। চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের অভ্যন্তরীণ তদন্তের সুপারিশে গত মাসে তাকে সুনামগঞ্জের তাহিরপুরে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) হিসেবে বদলি করা হয়।

ভুক্তভোগী নারীর কী অভিযোগ?
asif-imtiaz-uno-adc-wifeজনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব বরাবর একটি লিখিত অভিযোগে ময়মনসিংহের ভুক্তভোগী ওই নারী জানান, ২০১৮ সালের এপ্রিলে এক বান্ধবীর মাধ্যমে আসিফ ইমতিয়াজের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। পরে তিনি জানতে পারেন আসিফের ডিভোর্স হয়ে গেছে। সেই সূত্র ধরে কয়েকদিন ফোনে কথা হয় তাদের। এরপর এপ্রিল মাসে তার সঙ্গে ঢাকায় এসে সাক্ষাৎ করেন ওই নারী। প্রথম সাক্ষাতেই তাদের কথা হয় বিয়ে নিয়ে।

ওই নারী জানান, এরপর মে মাসের প্রথম সপ্তাহে তিনি মিরপুর ছয় নম্বরে একটি বাসা ভাড়া নেন। বাসা নেওয়ার খবর দেওয়ার পর তিনি ঢাকায় যান। ওই বাসায় আসিফ ইমতিয়াজের বোন ও ভগ্নিপতির সঙ্গে কথা হয়। তাদের সামনেই মে মাসের মধ্যে বিয়ে করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেন সে সময় চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের সিনিয়র সহকারী কমিশনার পদমর্যাদায় কর্মরত ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা (এলএও) আসিফ ইমতিয়াজ।

ডিভোর্সে এতো সময় লাগছে কেন—এমন প্রশ্নে আসিফ তার বান্ধবীকে জানান, আগের শ্বশুর আইনজীবী হওয়ায় ডিভোর্সের প্রক্রিয়ায় একটু বেশি সময় লাগছে। যেদিন ডিভোর্স পেপার হাতে পাবেন, তার পরের দিনই বিয়ে করবেন। এমন আশ্বাসের পাশাপাশি বোন ও ভগ্নিপতিকে সাক্ষী রাখায় ওই নারী একপর্যায়ে আসিফের সঙ্গে থাকতে রাজি হন।

বাড়ি ভাড়া নেওয়ার সময় বাড়িওয়ালা তার আইডি নম্বরসহ সব বিষয় নিশ্চিত হওয়ার পর বাড়ি ভাড়া দিয়েছেন বলে ওই নারীকে জানান। আসিফের কর্মস্থল চট্টগ্রাম হওয়ায় তিনি একা ওই বাসায় থাকতেন না। সেজন্য আসিফ তাকে মিরপুরে একটি হোস্টেল ঠিক করে দেন। বৃহস্পতিবার রাতে আসিফ চট্টগ্রাম থেকে আসলে, তখন তারা বাসায় থাকতেন।

কদমতলীর ব্যাংকে এক মাসে লেনদেন ২০ লাখ
ওই নারী জানান, কখনও শনিবার আবার কখনও রোববার সকালে আসিফ ইমতিয়াজ চট্টগ্রাম চলে যেতেন। দুই মাস থাকার পর মিরপুরের বাসাটা তারা ছেড়ে দেন। পরে পরিচিত একজনের মাধ্যমে বনশ্রীতে একটি সাবলেট নেন। সেই বাসা পাওয়া পর্যন্ত তারা দুজন বিভিন্ন আত্মীয়স্বজনের বাসায় থাকতেন। ২০১৮ সালের জুন মাসে ছয় দিনের প্রশিক্ষণে আসিফ চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় যান। ওই ছয় দিন তারা বিজয়নগরের একটি অভিজাত হোটেলে ছিলেন।

এরপর বনশ্রীতে বাসা পাওয়ার পর প্রতি সপ্তাহেই কখনও দুই দিন আবার কখনও তারও বেশি দিন একসঙ্গে থাকতেন তারা। বিউটি পার্লার করার জন্য আসিফ ওই নারীকে ট্রেড লাইসেন্সও করতে বলেন। কথামতো ময়মনসিংহে একটি ট্রেড লাইসেন্সও করেন ওই নারী। ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে দেবেন—এমন কথা বলে ওই নারীর ছবিসহ পাসপোর্ট, ট্রেড লাইসেন্স এবং তার মায়ের ছবিও নেন আসিফ।

ওই নারী বলেন, কিন্তু সেগুলো দিয়ে আসিফ ব্যাংক ঋণের কোনো ব্যবস্থা না করে চট্টগ্রামের কদমতলীর স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকে একটি অ্যাকাউন্ট করেন। শুরুতে তিনি এটা জানতেন না। একদিন বাসায় আসিফের মানিব্যাগে ওই নারী তার নামে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের একটি ডেবিট কার্ড দেখতে পান। তবে তিনি আসিফকে এ নিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করেননি। কারণ বললেই আসিফ তাকে গালিগালাজ ও মারধর করবেন—এমন আশংকা ছিল তার। পরে ব্যাংকে গিয়ে তিনি জানতে পারেন, এক মাসে ওই অ্যাকাউন্টে ২০ লাখ টাকা লেনদেন করেছেন চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের সিনিয়র সহকারী কমিশনার পদমর্যাদার সদ্য বিদায়ী ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা (এলএও) আসিফ ইমতিয়াজ।

শিশু গর্ভে আসার পরই বিগড়ে যান আসিফ
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে দেওয়া অভিযোগে ভুক্তভোগী ওই নারী লিখেছেন, ‘চলতি বছরের জানুয়ারিতে আমি গর্ভবতী হই। এটা তাকে জানানোর পরই আমার সাথে খারাপ আচরণ শুরু করে। গর্ভের শিশু নষ্ট করার জন্য প্রচন্ড চাপ দেয়। এক সপ্তাহ পরই সে আমাকে ফেসবুকসহ সব যোগাযোগ মাধ্যমে ব্লক করে দেয়। তার সাথে আমি কোনো যোগাযোগ করতে পারছিলাম না। নানাভাবে তাকে ম্যাসেজ দেয়ার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হই। পরে চট্টগ্রামে গিয়ে তার সাথে সাক্ষাৎ করার চেষ্টা করেও পারিনি। পরে ডিসির সাথে সাক্ষাৎ করে ঘটনা বলার পর তিনি বিষয়টি দেখার আশ্বাস দেন এবং একজন এডিসিকে দায়িত্ব দেন।’

চট্টগ্রাম থেকে সুনামগঞ্জ
ওই নারী বলেন, ‘এডিসি তার কাছে বিষয়টি জানতে চাইলে তিনি পুরোপুরি অস্বীকার করেন। আমি সব ডকুমেন্ট দেয়ার পর এডিসি তাকে চট্টগ্রাম থেকে বদলির করার সুপারিশ করেন। তার সুপারিশমতে চলতি বছরের এপ্রিল মাসে তাকে সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) হিসেবে বদলি করা হয়। এরপর থেকে তার সাথে আমার কোনো যোগাযোগ নেই। আর জানুয়ারি মাসে তার সাথে আমার শেষ সাক্ষাৎ হয়। এরপর সে দেখা করতে চাইলেও আমি করিনি।’

অভিযোগে ওই নারী বলেন, ‘আমার আশঙ্কা, দেখা করলে সে জোর করে আমার গর্ভের শিশুসন্তান নষ্ট করবে, না হয় আমাকে মারধর করবে। এখন পর্যন্ত নানাভাবে তিনি (ইউএনও) আমাকে হুমকিধমকি দিয়ে যাচ্ছেন। তার ভয়ে আমি ঢাকায় নির্দিষ্ট কোনো জায়গায় থাকতে পারছি না। একেক দিন একেক জায়গায় দিন যাপন করছি।’

বিষয়টি দেখছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ
ভুক্তভোগীর অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় বিষয়টি নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে প্রেরণ করেছে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসককে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আব্দুল আহাদ বলেন, মন্ত্রিপরিষদ থেকে এ সংক্রান্ত একটি চিঠি পাবার পর ইতিমধ্যে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (উপপরিচালক স্থানীয় সরকার) কে তদন্তভার দেওয়া হয়েছে।

অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে বদলি হওয়া আসিফ ইমতিয়াজের মোবাইলে একাধিকবার কল করলেও তার সাড়া মেলেনি।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!