প্রতারক গার্মেন্টস কর্তার খপ্পরে চট্টগ্রামের দুই তরুণ, হতাশ মুখে হাসি ফোটাল পুলিশ

আল মঈন ও জাবেদ— পড়েন একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের এমবিএতে। চাকরির বাজারের খারাপ দেখে দুই বন্ধু মিলে সিদ্ধান্ত নিলেন উদ্যোক্তা হওয়ার। কিন্তু নিজেদের স্বপ্ন বাস্তবে রূপ দিতে লাগবে বিশাল অংকের টাকা। তাই নিজেদের জমানো টাকার সাথে আত্মীয়দের কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে শুরু করেন গার্মেন্টস পণ্য কেনাবেচার ব্যবসা। নিজেকে তৈরি পোশাকের একটি নামি কারখানার বড় কর্তা পরিচয় দিয়ে তাদের সঙ্গে ভাব জমায় এক প্রতারক। ব্যবসা বাড়ানোর কথা বলে অভয় দিয়ে সেই প্রতারক নিজের কব্জায় নেয় দুই তরুণের সব পুঁজি। আর সেই টাকা হাতে পেয়ে নিমেষেই গায়েব সেই ‘বড় কর্তা’।

মাথায় হাত দুজনেরই। কী জবাব দেবে পরিবারের কাছে? কী করেই বা ফেরত দেবে ধার করা টাকা? জীবনের প্রথম উদ্যোগের প্রথম স্তরেই এত বড় ধাক্কায় যখন চোখে অন্ধকার দেখা শুরু করলো দুই তরুণ, তখনই আশার আলো হয়ে পাশে দাঁড়াল চট্টগ্রামের ইপিজেড থানা পুলিশ। সব শুনে পুলিশ দিল ভরসা, জাগালো আশাও।

ইপিজেড থানায় অভিযোগের ৬ দিনের মাথায় পরিচয়বিহীন সেই প্রতারককে ধরতে ওঠেপড়ে লাগে পুলিশ। প্রমাণ হিসেবে তাদের সামনে ছিল শুধু একটি ফোন নাম্বার। আর সেটিকেই সূত্র হিসেবে ব্যবহার করে আটক করা হয় প্রতারকদের। সাথে উদ্ধার করা হয় টাকাও।

চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে ইপিজেড থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) উৎপল বড়ুয়া বলেন, ‘প্রথমে ভুক্তভোগীরা অভিযোগই দিতে চাইছিলেন না। প্রতারকদের পরিচয় জানা না থাকায় তারা মনে করেছে প্রতারকদের আমরা ধরতে পারবো না। আমি ব্যক্তিগতভাবে তাদের আশ্বস্ত করি যে তাদের টাকা উদ্ধার করে দিতে আমরা আপ্রাণ চেষ্টা করব। আমার কথায় পরে তারা প্রতারকের একটি মোবাইল নাম্বার দিয়ে অভিযোগ করে। আমি থানার উপ-পরিদর্শক মো. জসিমকে দায়িত্ব দিই। তার নেতৃত্বে একটি দল নাম্বারটি ট্রেস করে প্রতারকের বাসায় পৌঁছে যায়। তাকে এই জানুয়ারির ১৭ তারিখ আটক করা হয়। লোপাট হওয়া টাকাও তরুণদের হাতে তুলে দেই।’

ঘটনার শুরু যেভাবে
মঈন ও জাবেদ দুই বন্ধু মিলে তৈরি পোশাক কেনাবেচার একটি ব্যবসা শুরু করার ইচ্ছা পোষণ করেন। সেই সুবাদে তাদের সঙ্গে পরিচয় হয় কর্ণফুলী ইপিজেডে অবস্থিত এমএএস ইন্টিমেন্টস বাংলাদেশ প্রাইভেট লি. নামের একটি তৈরি পোশাক কারখানার কোয়ালিটি ইনচার্জ ইয়ার মোহাম্মদ (৩৮) ও একই কারখানার ওয়াশিং ডিপার্টমেন্টের জিএম মো. সরোয়ারের (৪২) সাথে। দুই বন্ধুর ব্যবসার কথা শুনে সাহায্যের আশ্বাস দেন এই দুই প্রতারক।

দুই প্রতারক জানান, তাদের কারখানাতে আন্ডারবক্সারের এর বিপুল পরিমাণ অর্ডার বাতিল হয়ে গেছে। তারা চাইলে কম দামে মঈনদের নিয়ে দিতে পারেন জিনিসগুলো। প্রতারকদের প্রস্তাবে রাজি হয়ে পণ্যগুলো কেনার আগ্রহ দেখান তারা। ১০ জানুয়ারি নগরীর দেওয়ানহাট এলাকার আলিফ রেস্টুরেন্টে চারজনের মধ্যে একটি ছোট মিটিংও হয়। ওই মিটিংয়ে জানানো হয়, কারখানায় মোট ৪২ হাজার পিস আন্ডার বক্সার আছে— যার আনুমানিক মূল্য প্রায় ১২ লাখ ৬০ হাজার টাকা। কিন্তু মঈনরা যদি সবগুলো পণ্য একসাথে কেনেন, তাহলে অর্ধেক মূল্য ৬ লাখ টাকায় কিনতে পারবে।

প্রতারকদের এমন লোভনীয় প্রস্তাবে সাড়া দিয়ে পরের দিনই পণ্যগুলো কিনতে রাজি হয়ে যান দুই বন্ধু। এই সুযোগটি পেয়ে নিজেদের স্বপ্নপূরণ হওয়ার স্বপ্ন দেখতে থাকেন দুই বন্ধু। কথামতো পরদিন সকাল ১১টায় দুই প্রতারকসহ মঈনরা টাকা নিয়ে হাজির হন কর্ণফুলী ইপিজেডের এমএএস কারখানার সামনে। বিশ্বাস করে পূর্বনির্ধারিত ৬ লাখ টাকার একটি ব্যাগ হাতে তুলে দেন প্রতারক ইয়ার মোহাম্মদের হাতে। টাকা হাতে পেয়ে তিনি কারখানা থেকে টাকা বুঝে পাওয়ার রশিদ আনতে ঢুকলেন ভেতরে। বাইরে ৩ ঘণ্টা অপেক্ষা করলেও দুই বন্ধু দেখা পাচ্ছিলেন না ইয়ার মোহাম্মদ ও সারোয়ারের। তাদের দুজনেরই ফোনও বন্ধ পাওয়া যায়। কী ঘটেছে তা আর বোঝার বাকি রইলো না দুই বন্ধুর। তারা ধরেই নিলেন— সব শেষ, আত্মহত্যা করা ছাড়া পথ নেই তাদের। পুলিশের কাছে অভিযোগ করতে যাওয়ার ইচ্ছে হলেও আশেপাশের লোকদের থেকে পুলিশের নানা হয়রানির কথা শুনে সেই ইচ্ছাও বাদ দেন তারা।

কিন্তু ঘটনাটি কোনোভাবে জেনে যান ইপিজেড থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) উৎপল বড়ুয়া। তিনি নিজে যেচে আশ্বাস দিলেন টাকা পুলিশই উদ্ধার করে দেবে। তার কথায় খানিকটা বিশ্বাস এনে দুই তরুণ থানায় একটি অভিযোগ দিলেন। তবে প্রতারকদের নাম-ঠিকানা কোন কিছু জানা না থাকায় শুধুমাত্র প্রতারকদের ব্যবহৃত মোবাইল নাম্বার দিয়েই শুরু হলো অপারেশন।

আধুনিক প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে সাতদিনের মধ্যেই রোববার (১৭ জানুয়ারি) পটিয়া উপজেলার পটিয়া কমিউনিটি সেন্টারের পাশে কবির হাজীর বিল্ডিং থেকে আটক করা হয় প্রতারক ইয়ার মোহাম্মদকে। সেই সাথে উদ্ধার করা হয় টাকাও। এই প্রতারক বাঁশখালী উপজেলার ১ নং ওয়ার্ডের ১১ নং পুঁইছড়ি ইউনিয়নের মৃত আনোয়ার হোসেনের পুত্র। আটক আসামিকে প্রতারণার দায়ে পাঠানো হয় কারাগারে। আর ভুক্তভোগীদের কাছে তুলে দেওয়া হয় তাদের খোয়ানো টাকার একাংশ।

আর এত বড় উপকারের জন্য নিজেদের হাতে পুলিশকে মিষ্টি খাইয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলো ভুক্তভোগী দুই তরুণ। এ ব্যাপারে ভুক্তভোগী মো. আল মঈনের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি প্রথমে পুলিশের কাছে যেতে চাইনি। তার ওপর আমার কাছে কোনো ধরনের ডকুমেন্টও ছিল না। কিন্তু ওসি স্যারের কথা শুনে আমি অভিযোগ করি। তারপর ওনারা আমাদের যে পরিমাণ সাপোর্ট দিয়েছেন আমি তা কখনোই ভুলবো না। আমার পকেটে দুই টাকাও ছিলো না। ওসি স্যার আমাকে নিজের টাকায় নাস্তা করিয়েছেন, ভাত খাইয়েছেন, ওনাদের ব্যবহারে আমি মুগ্ধ। আর টাকা ফেরত পাওয়ার অনুভূতি আমি প্রকাশ করতে পারবো না। আমি যেন আমার প্রাণ ফিরে পেয়েছি।’

কেএস

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!