প্রণব মুখার্জির কাছে চট্টগ্রাম ছিল আবেগের জায়গা

‘চট্টগ্রাম না দেখলে বাংলাদেশে আসা সম্পূর্ণ হয় না’

ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি সদ্যপ্রয়াত প্রণব মুখোপাধ্যায়ের কাছে বিশেষ আবেগের জায়গা ছিল চট্টগ্রাম। তিনি বলতেন, চট্টগ্রাম না দেখলে বাংলাদেশে আসা সম্পূর্ণ হয় না। মাত্র দুই বছর আগে চট্টগ্রামে পা রেখে প্রণব মুখার্জি বলেছিলেন, ভারতবর্ষ ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে চট্টগ্রামের অনন্য ভূমিকা ছিল। চট্টগ্রামে না এলে অপূর্ণতা থেকে যেত।

২০১৮ সালের ১৬ জানুয়ারি রেডিসন ব্লু চিটাগাং বে ভিউ হোটেলে এক সুধী সমাবেশে তিনি এমন মন্তব্য করেন। ওই সমাবেশে প্রণব মুখার্জির হাতে চট্টগ্রাম নগরের চাবি তুলে দেন সদ্যবিদায়ী সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন। অন্যদিকে প্রীতিলতা ট্রাস্টের কর্মকর্তাদের কাছে ৬ লাখ ২৮ হাজার টাকার চেক তুলে দেন প্রণব মুখার্জি। সেবার ভারতের সর্বজনশ্রদ্ধেয় এই রাজনীতিবিদের সঙ্গে এসেছিলেন তার মেয়ে শর্মিষ্ঠা মুখার্জিও।

সেখানে চট্টগ্রাম নিয়ে নিজের আবেগ প্রকাশ করে প্রণব মুখার্জি বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশে অনেকবার এসেছি। কিন্তু চট্টগ্রামে আসার সুযোগ হয়নি। অনেকদিনের ইচ্ছে ছিল চট্টগ্রাম যাব। কদিন বাঁচি তা তো বলা যায় না। স্রষ্টা সে ইচ্ছে পূরণ করেছে। চট্টগ্রাম না দেখলে বাংলাদেশে আসা সম্পূর্ণ হয় না।’

প্রণব মুখার্জির হাতে চট্টগ্রামের চাবি তুলে দেন সিটি করপোরেশনের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন।
প্রণব মুখার্জির হাতে চট্টগ্রামের চাবি তুলে দেন সিটি করপোরেশনের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন।

ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি সোমবার (৩১ আগস্ট) বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যা সোয়া ৬টার দিকে দিল্লির আর্মি’স রিসার্চ অ্যান্ড রেফারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর মৃত্যুতে শ্রদ্ধা জানিয়ে বুধবার (২ সেপ্টেম্বর) একদিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ সরকার। এদিন জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হবে।

দুই বছর আগে চট্টগ্রামের সুধী সমাবেশে প্রণব মুখার্জি বলেন, ‘চট্টগ্রাম বাংলাদেশের প্রধান বন্দর বলেই নয়, এই শহরের অন্য গুরুত্বও আছে। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামে এখানকার মানুষের বিপুল ভূমিকা ছিল। ঠিক তেমনি বাংলাদেশকে স্বাধীন করার ক্ষেত্রেও চট্টগ্রাম এগিয়ে ছিল। সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে স্বাধীন বাংলাদেশের বার্তা পৌঁছে দিয়েছিল চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণাও পৃথিবীর মানুষের নজরে এনেছিলেন এই বেতারকেন্দ্রের কর্মীরা।’

প্রণব মুখার্জি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক ডিলিট ডিগ্রি গ্রহণ করেন।
প্রণব মুখার্জি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক ডিলিট ডিগ্রি গ্রহণ করেন।

সেদিনের আলোচনায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রসঙ্গও টানেন ভারতের এই সাবেক রাষ্ট্রপতি। তিনি বলেন, ‘চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় খুব বেশি দিনের নয়, ১৯৬৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু ৫৫ বছরে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। শুধু উপমহাদেশ নয়, দক্ষিণ এশিয়ায় এটি একটি বড় বিশ্ববিদ্যালয় বলে গণ্য। গুণগত মানের জন্য এ বিশ্ববিদ্যালয় খ্যাতি লাভ করেছে। আমাদের দেশ থেকেও অনেক শিক্ষার্থী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসাবিজ্ঞানে পড়তে আসছে।’

দুই বছর আগে ১৬ জানুয়ারির সেই সকালে প্রণব মুখার্জি বিমানযোগে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে এসে নগরের দামপাড়া পুলিশ লাইন্সে যান। সেখানে ব্রিটিশ পুলিশের অস্ত্রাগার হিসেবে ব্যবহৃত দুটি স্থাপনা পরিদর্শন করেন। এর মধ্যে একটি ছিল সূর্যসেনের নেতৃত্বে স্বাধীনতাকামী বিপ্লবীদের অস্ত্রাগার লুট করার স্থাপনা। এ সময় পুলিশ কর্মকর্তারা অস্ত্রাগারের ইতিহাস প্রণব মুখার্জির কাছে তুলে ধরেন। অস্ত্রাগার পরিদর্শন শেষে তিনি যান পাহাড়তলীর ইউরোপিয়ান ক্লাবে। প্রণব মুখার্জি কাঠের কাঠামোর ঐতিহ্যময় এ ক্লাবটি ঘুরে ঘুরে দেখেন। কাঠের পাটাতনের নিচে ব্রিটিশ সেনাদের অস্ত্র রাখার জায়গাটিও তাকে দেখানো হয়। প্রণব মুখার্জি প্রীতিলতার আত্মাহুতির ইতিহাসসংবলিত স্মৃতিফলক পরিদর্শন করে তাঁর স্মৃতিফলকে শ্রদ্ধা জানান।

চট্টগ্রাম সফরকালে প্রণব মুখার্জি পাহাড়তলীতে প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা জানান।
চট্টগ্রাম সফরকালে প্রণব মুখার্জি পাহাড়তলীতে প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা জানান।

পরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যান ভারতের এই সাবেক রাষ্ট্রপতি। সেখানে সম্মানসূচক ডক্টরেট (ডিলিট) ডিগ্রি গ্রহণ করেন তিনি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আনন্দঘন পরিবেশে আনুষ্ঠানিকভাবে মুখার্জিকে ডিলিট ডিগ্রি, ক্রেস্ট, উত্তরীয় ও প্রতিকৃতি তুলে দেন চবির উপাচার্য প্রফেসর ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী।

ডিলিট ডিগ্রি গ্রহণের পর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিপ্লবী মাস্টারদা সূর্য সেনের জন্মস্থান পরিদর্শনে রাউজান যান প্রণব মুখার্জি। ১৬ জানুয়ারি বিকেলে তিনি রাউজানের সূর্যসেন পল্লীতে পৌঁছান। সূর্যসেনের জন্মভিটায় নির্মিত হাসপাতালটি ঘুরে দেখেন। রাউজান বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ গেটের পাশে মাস্টারদা সূর্য সেনের আবক্ষমূর্তিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান প্রণব মুখার্জি। এরপর সূর্যসেন স্মৃতি পাঠাগারের উদ্বোধন করেন। পরে তিনি সেখানে রাখা স্মারক বইয়ে স্মাক্ষর করেন।

প্রণব মুখার্জি এর আগে ২০১৩ সালের মার্চেও বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন। ওই সময় তিনি ভারতের রাষ্ট্রপতির দায়িত্বে ছিলেন। তখন তিনি শ্বশুরবাড়ি নড়াইলের পুটিবিলা গ্রামে যান।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!