পোড়া ঘরে দাঁড়িয়ে কণ্ঠশিল্পীর ক্ষোভ— অপরাধীদের গল্প শহরের দেয়ালে লিখে পৃথিবী ছেড়ে চলে যাব

ঘর পোড়ানোর ২০ দিনেও গ্রেপ্তার হয়নি আসামি

পুড়ে যাওয়া ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছেন প্রতিভাবান সঙ্গীতশিল্পী পিজিত মহাজন। দৃশ্যটা হৃদয় বিদীর্ণ করে দেওয়ার মত। পুড়ে যাওয়া এই ঘরের সঙ্গে হারিয়ে গেছে তার প্রয়াত মায়ের রেখে যাওয়া হাজারো স্মৃতি, বাবার তিল তিল কষ্টের টাকায় গড়া শেষ সম্বল বাড়িটা। ওই বাড়িতে ছিল কণ্ঠশিল্পী পিজিতের শখের হার‌মো‌নিয়ামসহ গান গাওয়ার বেশ কিছু স্মৃতিবিজড়িত যন্ত্রপাতি। ছিল গান বিষয়ক নানা বই-ডায়েরি, খাতাসহ নানা উপকরণ। ১০ জুন গভীর রাতে ‘শত্রুতার জেরে লাগিয়ে দেওয়া’ আগুনে পুড়ে সব ছাই হয়ে গেছে।

ঘটনাটি ঘটেছে চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলার ১নং রাজানগর ইউনিয়নের ৫ নং ওয়ার্ডের ঠান্ডাছড়ি এলাকার রানীরহাট পুলিশ ক্যাম্প সংলগ্ন হিন্দুপাড়া গ্রামে।

গত ১০ জুন মধ্যরাতে কণ্ঠশিল্পী পিজিত মহাজনের রাঙ্গুনিয়া উপজেলার রাজানগর রানীরহাট পুলিশ ক্যাম্প সংলগ্ন হিন্দু পাড়ায় অবস্থিত গ্রামের বাড়িটি আগুনে পুড়ে যায়। তবে পূর্ব শত্রুতার জেরে প্রতিবেশীরা পেট্রোল ঢেলে আগুনে ঘর পুড়িয়ে দিয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন পিজিতের পরিবার।

এ ঘটনায় পিজিতের পিতা স্বপন মহাজন বাদী হয়ে গত ১৩ জুন প্রথমে রাঙ্গুনিয়া থানায় সাধারণ ডায়েরি ও পরে ১৭ জুন চট্টগ্রাম চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্টেটের আদালতে মামলা দায়ের করেছেন। মামলায় আসামি করা হয়েছে একই এলাকার ধ্রুব দাশের ছেলে ডেন্টাল চিকিৎসক অনুপ দাশ, প্রতিবেশী মৃদুল দে’র ছেলে মিটন দে ও টিটন দেসহ অজ্ঞাত ৮-১০ জনকে।

অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, স্বপন মহাজন একসময় রাঙ্গুনিয়া উপজেলার রানীরহাট বাজারের নামকরা ব্যবসায়ী ছিলেন। তিনি নিজ অর্থায়নে নিজ ঘরেই প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন লোকনাথ সেবাশ্রম মন্দির। সেই মন্দিরে প্রতি বছর ২ দিন ব্যাপী চলতো মহোৎসব। হাজারেরও বেশি অতিথিকে খাওয়ানো হতো প্রসাদ। কিন্তু স্ত্রীর মৃত্যুর পরে তিনি শারীরিক, মানসিক ও আর্থিক দিক থেকে ভেঙে পড়েন। বর্তমানে তিনি মন্দিরের সেবক হয়ে ধর্মকর্ম নিয়ে থাকেন। তার দুই ছেলে সঙ্গীতশিল্পী পিজিত মহাজন ও বড় ছেলে রাজীব মহাজন দুজনই ঢাকায় থাকেন।

জানা যায়, ঘটনার দিন রাত ১০ টায় তিনি অদূরে শ্বশুরবাড়ীতে রাতের খাবার খেতে যান। সেখানে খাবার শেষে শ্যালকের সাথে কিছু সময় গল্প করেন। হঠাৎ আগুন লাগার চিৎকার শুনে দৌড়ে এসে আসামি অনুপ, মিটন ও টিটনকে মন্দিরের পাশ দিয়ে মশাল হাতে পালিয়ে যেতে দেখেন। আসামিদের নানা অপকর্মের প্রতিবাদ করায় আক্রোশে এ আগুন লাগানো হয়েছে বলেও তিনি অভিযোগপত্রে উল্লেখ করেন। তিনি দাবী করেন, মিটন দে ও তার লোকজন জানালা দিয়ে পেট্রোল ঢেলে তার বাড়িতে আগুন দিয়েছে। তিনি আসামিদের দৃষ্টান্তমুলক শাস্তির দাবি জানান।

এদিকে ঘটনার ১৯ দিন অতিবাহিত হলেও এখনো কোন আসামি গ্রেফতার হয়নি। অথচ আসামিরা এলাকায় প্রকাশ্যে ঘোরাফেরা করছে। মামলা দায়েরের পরও আসামি গ্রেফতার না হওয়ায় ভয় আর শঙ্কায় দিন কাটাচ্ছে শিল্পী পিজিত মহাজনের পরিবার। বিশেষ করে আদালতে মামলা করে তারা উল্টো বিপাকে পড়েছেন বলে জানান সঙ্গীত শিল্পী পিজিত মহাজন।

তিনি জানান, আসামিরা প্রতিনিয়ত হুমকি-ধমকি দিচ্ছেন। শুধু আসামি পক্ষই নয়, স্থানীয় সরকারদলীয় নেতারাও তাকে কোনঠাসা করার চেষ্টা করছে বলে জানান তিনি। এ অবস্থায় পরিবারের নিরাপত্তা চেয়ে প্রশাসনের উর্ধতন মহলের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন তিনি।

সঙ্গীতাঙ্গনসহ সবার সহযোগিতা চেয়ে ‘সৃষ্টিকর্তার আদালতে বিচারের’ প্রত্যাশায় পিজিত মহাজন তার ফেইসবুক পেইজে লিখেছেন, ‘আমার বাবার শেষ সম্বল, আমার মায়ের রেখে যাওয়া হাজারো স্মৃতির এবং বাবার তিলে তিলে কষ্টের টাকায় গড়া বাড়িটা ছাই করে দিয়েছে আগুন জ্বালিয়ে, তখন আর ক্যারিয়ার, ইমেজ— এসব ভেবে বসে থাকলে নিজেকে নিজের কাছে ছোট মনে হচ্ছে।’

মামলা দায়েরের পরও আসামি গ্রেফতার না হওয়া এবং প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ানোয় ক্ষোভ প্রকাশ করে পিজিত লিখেন, ‘একদিন এই নিকৃষ্ট অপরাধীদের গল্প শহরের দেয়ালে দেয়ালে লিখে চলে যাব পৃথিবী ছেড়ে। এপারে বিচার না হলেও ওপারে বিচার হবে এই জঘন্য কর্মকান্ডের। আজ ১৭ দিন হতে চলেছে আসামিরা কলার উচুঁ করে ঘুরে বেড়াচ্ছে, আর আমরা খোলা আকাশের নিচে।’

এবিষয়ে পিজিত মহাজনের পিতা স্বপন মহাজন বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে আসামিরা আমাকে বসতভিটা থেকে উচ্ছেদ করে বাড়ি-ঘর, মন্দির দখল করতে নানানভয়ভীতি প্রদর্শন করতো। এমনকি মারধর করাসহ ঘরের ঘেরা-বেড়া কেটে দিতো। এর পরেও খ্যান্ত না তারা। প্রতিনিয়ত রাতের আধারে ঘরের চালে ইট-পাটকেল ছূঁড়ে মারতো। তাদের নানাবিধ কৌশল ফলপ্রসূ না হলে সর্বশেষ গত ১০ জুন রাতে ঘরের জানালা দিয়ে পেট্রোল ঢেলে আগুন লাগিয়ে ঘর জ্বালিয়ে দিয়েছে। এতে আমার ১০ লক্ষ টাকার ক্ষতি হয়েছে। আমি এর সুষ্ঠু বিচার চাই।’

অভিযোগ অস্বীকার করে অভিযুক্ত অনুপ দাশ বলেন, ‘আমি দীর্ঘ ১০ বছর ধরে এ এলাকায় দাঁতের চিকিৎসক হিসেবে সফলতার সাথে চিকিৎসাসেবা দিয়ে যাচ্ছি। অথচ আমার বিরুদ্ধে ভয়ভীতি প্রদর্শন, মারধর ও রাতের আধারে ঘরের চালে ইট-পাটকেল নিক্ষেপের অভিযোগ এনে ঘরে আগুন দেয়ার ঘটনায় জড়িয়ে কেন মামলা দায়ের করেছেন তা বুঝতে পারছি না। কারণ বাদীর সাথে মামলার ২ ও ৩ নং অভিযুক্ত ব্যক্তির দীর্ঘ ৪-৫ বছর ধরে পারিবারিক বিরোধ চলে আসছিল। এই বিরোধ নিষ্পত্তি নিয়ে এলাকার হিন্দু সমাজে ও ইউনিয়ন পরিষদে ৭-৮ বার সালিশ বিচার বসেছে। প্রতিবার বিচারে প্রমাণিত হয়েছে যে, বাদী নিজেই অভিযুক্ত মিটন দের ঘরের চালে ঢিল ছুটতো। বিচারে দোষী প্রমাণিত হওয়ায় স্বপন মহাজনকে জরিমানাও করা হয়েছে। এটা নিয়ে দুই পরিবারের দ্বন্দ্ব দীর্ঘদিন থেকেই আছে। হয়তো সে কারণে তাদের আসামি করতে পারে।’

কেন তাকে এই ঘটনায় জড়ানো হলো— এমন প্রশ্নের জবাবে অনুপ দাশ বলেন, ‘এই ঘটনায় আমাকে জড়ানোর একটাই কারণ, তাহলো গত ২ বছর ধরে মিটনের সাথে আমি একটা শেয়ারে জিপ (চাঁদের) গাড়ি ক্রয় করেছি। মূলত সে কারণেই উনি মনে করছেন আমি এদের ইন্ধনদাতা বা আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতা। এছাড়া অন্য কোন কারণ খুঁজে পাচ্ছি না। তাছাড়া বাদীর বাড়ি থেকে আমার বাড়ির দূরত্ব ১ কিলোমিটার। একই সম্প্রদায়ের মানুষ হিসাবে জানা-শোনা থাকলেও তাঁর সাথে আমার কোন ব্যক্তিগত, ব্যবসায়িক বা আত্মীয়তার সম্পর্ক নেই।’

এ ব্যাপারে রাজানগর ইউপি চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার শামসুল আলম তালুকদার বলেন, ‘খবর পেয়ে আমি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখলাম স্বপন মহাজনের সেমিপাকা ঘরটি পুরোটাই আগুনে পুড়ে গেছে। কোন আসবাবপত্র বের করতে পারেনি। তবে বাইরে থেকে ঘরে আগুন লাগিয়ে দেয়ার বিষয়টি রহস্যজনক। তাই বিষয়টি পুলিশ প্রশাসনকে আমলে নিয়ে তদন্তসাপেক্ষে দোষীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছি।’

এবিষয়ে রাঙ্গুনিয়া থানার ইনচার্জ (ওসি) মাহবুব মিল্কি বলেন, ‘আমরা সঙ্গীতশিল্পী পিজিত মহাজনের ঘর পোড়ার বিষয়টি গুরুত্বসহকারে দেখছি। এই ঘটনায় যারা জড়িত তদন্তসাপেক্ষে দোষীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!