পেঁয়াজের আগুন আরো বেড়েছে, কেজিপ্রতি মূল্য ২৫০ টাকা

রাধুনীদের মতে বাঙ্গালীর রান্নায় পেঁয়াজ ছাড়া তরকারি বা ভর্তা কিছুই সম্ভব না। বিশেষভাবে মাংস ও মাছ রান্নায় আদা, রসুন হয়তো বাদ দেয়া চলে কিন্তু থাকতেই হবে পেঁয়াজ।

রান্নায় পেঁয়াজ নিয়ে চট্টগ্রামের স্বনামধন্য রন্ধনশিল্পী রওশন আরা বলেন, ‘রান্নায় পেঁয়াজকে আমরা বর্জন করতে পারি না কিন্তু কম খেতে পারি। পেঁয়াজ ছাড়া রান্না কল্পনা করা যায় না।’

এদিকে পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধির ইতিহাস হলো বাংলাদেশে। শুক্রবার (১৫ নভেম্বর) বাজারে পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ২০০-২৫০ টাকায়।

পেঁয়াজের দামের রেকর্ডসংখ্যক উর্ধ্বগতির কারণ অনুসন্ধানে বেরিয়ে এলো নানা তথ্য।

চট্টগ্রামের মশলা জাতীয় পণ্যের প্রধান আড়ত খাতুনগঞ্জের হামিদুল্লাহ বাজার। আমদানিকারকদের কাছ থেকে আনা পেঁয়াজ এখান থেকে চট্টগ্রামের বিভিন্ন বড় বাজারে যায়।

কমিশনিং এজেন্ট মোহাম্মদ ইদ্রিস বলেন, ‘আমরা একটা গ্যাপে পড়ে গেছি। বড় আমদানিকারক ভারত ছাড়া অন্য জায়গা থেকে পেঁয়াজ আমদানি করতে এলসি খুলেছে। এলসি খোলার পর ওই দেশে ব্যবসায়ীদের সাথে যোগাযোগ করা, তারপর জাহাজে করে আনা, এসবতো সময়সাপেক্ষ। আরও পনেরোদিন সময় লাগবে আসতে। এখন আমাদের কাছে পেঁয়াজ কম।’

তিনি আরো বলেন, ‘৪-৫দিন ধরে কোন পেঁয়াজ আসেনি। ভারত ছাড়া অন্য দেশগুলো থেকে যতটুকু এসেছে তা যথেষ্ট নয়।’

চট্টগ্রাম বন্দরে ৬৬ হাজার টনের এলসি
সংকট কাটাতে ৬৬ হাজার ১৬২টন পেঁয়াজ আমদানির অনুমতিপত্র (এলসি) খোলা হলেও বৃহস্পতিবার পর্যন্ত চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে পেঁয়াজ এসেছে ৬ হাজার টনের মতো।

এস আলম গ্রুপের কোনো পেঁয়াজ এখনও বন্দরে এসে পৌঁছেনি। তারা ৫৫ হাজার টন পেঁয়াজ আমদানির ঘোষণা দিয়েছিল।

চট্টগ্রাম বন্দরের উদ্ভিদ সংগনিরোধ কর্তৃপক্ষের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী— বৃহস্পতিবার পর্যন্ত মিশর থেকে সর্বোচ্চ ৩ হাজার ৩০৬ টন পেঁয়াজ এসেছে।পাশাপাশি চীন থেকে ৮৭৬ টন, মিয়ানমার থেকে ১ হাজার ২২৮ টন, তুরস্ক থেকে ৮৬ টন, সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে ১১২টন এবং পাকিস্তান থেকে ১৩৯টন পেঁয়াজ বন্দরে এসেছে। গত ২৯ সেপ্টেম্বর থেকে ১৩ নভেম্বর পর্যন্ত এই ৫ হাজার ৯৪৭ টন পেঁয়াজ এসেছে। সেপ্টেম্বরের শেষদিকে ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দেওয়ার পর আমদানি করতে নতুন দেশ খুঁজতে শুরু করে বাংলাদেশ। এসব দেশ থেকে আমদানি চললেও পেঁয়াজের দাম বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। সেপ্টেম্বরে যে পেঁয়াজের দর কেজিতে ছিল ৩০-৪০ টাকা, তা এখন ২০০ টাকায় গিয়ে ঠেকেছে।

উদ্ভিদ সংগনিরোধ কর্তৃপক্ষের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী— ৪১টি আমদানি অনুমতিপত্রের বিপরীতে মিসর, চীন, পাকিস্তান, তুরস্ত ও উজবেকিস্তান থেকে ৬৬ হাজার ১৬২ টন পেঁয়াজ আমদানি হবে।

উদ্ভিদ সংগনিরোধ কর্তৃপক্ষের উপ-পরিচালক আসাদুজ্জামান বুলবুল বলেন,‘এস আলম গ্রুপের ১১টি আমদানি অনুমতিপত্রের বিপরীতে মিসর থেকে ৫৫ হাজার মেট্রিক টন পেঁয়াজ আমদানির অনুমতিপত্র নেওয়া হয়।’
এ মাসের প্রথম দিকে এলসি করার পর এস আলম গ্রুপের বাণিজ্যিক বিভাগের প্রধান ব্যবস্থাপক আখতার হাসান চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘সপ্তাহখানেকের মধ্যে পেঁয়াজ দেশে এসে পৌঁছাবে। কিন্তু সেই পেঁয়াজ এখনো চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছেনি।’

খাতুনগঞ্জের ১৬ সিন্ডিকেট
মূল্য স্বাভাবিক করতে প্রশাসনের নিয়মিত নজরদারি, জরিমানা কিংবা অভিযান থাকলেও দাম কমেনি পেঁয়াজের। প্রায় ১ মাসের বেশি সময় ধরে পেঁয়াজের দামের উর্ধ্বগতি রোধ অনেকটা অসম্ভব। পেঁয়াজের দামের সাথে যুক্ত হয়েছে ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের প্রভাবও।

রোববার (১১ নভেম্বর) পেঁয়াজের পাইকারি দর ৯০-১০০ ও খুচরা ১৩০-১৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে। গত কয়েকদিনে খুচরা বাজারে এ পেঁয়াজের দাম বেড়ে দাঁড়ালো ২০০-২৫০ টাকা।

এদিকে সংশ্লিষ্ট অনেকেই অভিযোগ করে বলেন— একটি চক্র পেঁয়াজের আমদানি মূল্য বাড়িয়ে লিখে খুচরা বাজারে বাড়তি দামে পেঁয়াজ বিক্রি করছেন। ফলে জেলা প্রশাসন বাজার নিয়ন্ত্রণে একাধিক বৈঠক ও অভিযান পরিচালনা করেও নিয়ন্ত্রণে না এসে বরং লাফিয়ে বেড়েছে পেঁয়াজের দাম।

জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তৌহিদুল ইসলাম বলেন, ‘খাতুনগঞ্জ পাইকারি বাজারে ১৬ সদস্যের একটি সিন্ডিকেট আছে। এরমধ্যে টেকনাফের ১২ আমদানিকারক, সিএন্ডএফ প্রতিষ্ঠান, পাইকারি বিক্রেতার পাশপাশি খাতুনগঞ্জের দুই এবং রিয়াজউদ্দিন বাজারের দুই আড়তদার রয়েছেন।’

টেকনাফের সিন্ডিকেটে রয়েছেন আমদানিকারক সজিব, মম, জহির, সাদ্দাম, বিক্রেতা ফোরকান, গফুর, মিন্টু, খালেক, টিপু, টেকনাফ স্থল বন্দরের সিএন্ডএফ এজেন্ট কাদের, কমিশন এজেন্ট শফি, আলিফ এন্টারপ্রাইজ, খাতুনগঞ্জের মেসার্স আমির ভান্ডার, মেসার্স আল্লার দান স্টোর, স্টেশন রোড নুপুর মার্কেটের মেসার্স সৌরভ এন্টারপ্রাইজ, হোসেন ব্রাদার্স।

পেঁয়াজের দাম নিয়ন্ত্রণে প্রশাসনের পরিকল্পনা
লাফিয়ে লাফিয়ে বৃদ্ধি পাওয়া পেঁয়াজের দামের লাগাম ধরতে নানা পরিকল্পনা নিয়েছিলো চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি বরং সিন্ডিকেটের কারসাজিতে দামের লাগাম ধরা সম্ভব হয়নি।

জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে পেঁয়াজের দাম নিয়ন্ত্রণ করতে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তৌহিদুল ইসলাম প্রায় এক সপ্তাহ ধরে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেছেন।পেঁয়াজের বড় পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জ ও খুচরা বাজারে অভিযান চালিয়ে জেল জরিমানা আদায় করেছেন।

চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক ইলিয়াছ হোসেন পেঁয়াজের বাজার নিয়ন্ত্রণের পরিকল্পনার কথা উল্লেখ করে চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমরা পেঁয়াজ আমদানিকারক ব্যবসায়ীদের সাথে বৈঠক করছি। অনেক আমদানিকারক কোম্পানি পেঁয়াজ আমদানি করছেন। কারণ এখন বেশি দামে পেঁয়াজ ক্রয় করতে হচ্ছে। সামনে দেশে পেঁয়াজের মৌসুম শুরু হচ্ছে। কিন্তু কয়েকদিনের মধ্যে পেঁয়াজের দাম এমনিতেই কমে যাবে। তাই ব্যবসায়ীরা ক্ষতির কথা চিন্তু করেই এলসি করছেন না।

পেঁয়াজ নিয়ে সংসদে বক্তব্য
শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুন জানান,‘ভারতের পেঁয়াজ রপ্তানির নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে দিল্লীর বাংলাদেশ হাই কমিশনের কমার্শিয়াল কাউন্সিলের সাথে যোগাযোগ অব্যাহত রয়েছে। মঙ্গলবার সংসদের অধিবেশনে মন্ত্রীদের জন্য নির্ধারিত প্রশ্নোত্তর পর্বে তিনি এ তথ্য জানান।

এ সংক্রান্ত লিখিত প্রশ্ন উত্থাপন করেন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য আনোয়ার হোসেন খান। জবাবে মন্ত্রী আরো বলেন,‘দেশে বর্তমানে পেঁয়াজের বার্ষিক চাহিদা ২৪ লাখ মেট্রিকটন। গত বছর পেঁয়াজের উৎপাদন হয়েছিল ২৩ দশমিক ৩০ লাখ মেট্রিক টন।এরমধ্যে ৩০ শতাংশ সংগ্রহকালীন এবং সংরক্ষণকালীন ক্ষতি বাদ দিলে উৎপাদনের পরিমাণ দাঁড়ায় ১৬ দশমিক ৩১ লাখ মেট্রিকটন।’

উৎপাদিত পেঁয়াজ স্থানীয় চাহিদা মেটানোর জন্য যথেষ্ট না হওয়ায় বিদেশ থেকে বিশেষ করে ভারত থেকে প্রতি বছর নির্দিষ্ট পরিমাণ পেঁয়াজ আমদানি করতে হয়। সংসদে মন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুন বলেন,‘সম্প্রতি ভারতের মহারাষ্ট্রে বন্যা হওয়ায় পেঁয়াজের ফলন ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় ভারতের অভ্যন্তরীণ বাজারে পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে।

ফলশ্রুতিতে ভারত সরকার ১৩ সেপ্টেম্বর পেঁয়াজের সর্বনিম্ন রপ্তানি মূল্য প্রতিটন ৮৫০ ডলার নির্ধারণ করে। আগে ভারতের রপ্তানি মূল্য ছিল ২৫০-৩০০ ডলার। এখন তা ৮৫০ ডলারে দাঁড়ানোর কারণে দেশের বাজারে পেঁয়াজের দাম বেড়েছে।’

এএস/এসএস

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!