পুলিশের সোর্স ছিল শিশু আয়নীর খুনি-ধর্ষক রুবেল, মশকরায় ব্যস্ত ছিল পুলিশ

‘আপনার মেয়েকে জ্বিন চালান দিয়ে নিয়ে আসবো’

বাবাহারা একমাত্র মেয়েকে উদ্ধারের আশায় বারবার যখন পুলিশের কাছে ধর্না দিচ্ছিল মা, তখন এসআই দুলাল মিয়া বলেন, ‘আমরা আপনার মেয়েকে জ্বিন চালান দিয়ে নিয়ে আসবো।’

আয়নীকে ধর্ষণের পর শ্বাসরোধ করে হত্যার স্বীকারোক্তি দিয়ে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দিও দেন সেই রুবেল।
আয়নীকে ধর্ষণের পর শ্বাসরোধ করে হত্যার স্বীকারোক্তি দিয়ে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দিও দেন সেই রুবেল।

পুলিশের টিপ্পনি বোঝার পরেও অভিযুক্ত হিসেবে রুবেলকে ধরে আনার অনুরোধ করেন মা। তখন পাহাড়তলী থানার এই এসআই অনেকটা ধমকের সুরে বলেন, ‘রুবেল ভালো ছেলে, আপনার মেয়ে প্রেম করে পালিয়েছে।’

মেয়ে হারানোর শোকে পুলিশের দ্বারস্থ হয়ে এমন কথা শুনতে হয়েছে ধর্ষণের পর হত্যার শিকার আবিদা সুলতানা আয়নীর (১০) মা বিবি ফাতেমাকে।

পুলিশের বিরুদ্ধে এমনই অভিযোগ করেন বিবি ফাতেমা। যদিও অভিযোগগুলো মিথ্যা দাবি করেন এসআই দুলাল। তবে অভিযুক্ত রুবেল সবজি বিক্রির আড়ালে এই পুলিশ কর্মকর্তার সোর্স হিসেবে কাজ করতেন পাহাড়তলীতে। তাই সোর্সকে বাঁচাতেই তদন্তকাজে ইচ্ছেকৃত বিলম্ব করা হয় বলে দাবি করে আয়নীর আইনজীবীও।

মঙ্গলবার (২১ মার্চ) চট্টগ্রাম নগরীর পাহাড়তলী এলাকার মুরগি ফার্ম এলাকা থেকে নিখোঁজ হয় চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্রী আয়নী। ঘটনার দিনই স্থানীয় সবজি বিক্রেতা মো. রুবেল বিড়ালের বাচ্চার লোভ দেখিয়ে আয়নীকে অপহরণ করেছে—এমন অভিযোগ নিয়ে বিবি ফাতেমা পাহাড়তলী থানায় গেলেও বিষয়টি আমলে নেয়নি পুলিশ। রুবেলের নামে মামলা করে জিজ্ঞাসাবাদ করার আকুতি জানান ফাতেমা। কিন্তু মামলা না নিয়ে উল্টো রুবেলের পক্ষেই সাফায় গেয়েছিল পুলিশ। পরে সাধারণ ডায়েরি করেই বিবি ফাতেমাকে ঘরে পাঠায় তারা।

সাতদিনের তদন্তে সেই রুবেলকে জিজ্ঞাসাবাদের পরও আয়নী অপহরণের সঙ্গে কোনো সম্পৃক্ততা পায়নি পুলিশ। কিন্তু সেই রুবেলকেই আটকের একদিন পর আসল ঘটনা বের করে আনে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।

মঙ্গলবার (২৮ মার্চ) সন্দেহজনক হিসেবে আটকের পর জিজ্ঞাসাবাদ করে পিবিআই। এর একদিন পর বুধবার রুবেলের দেওয়া তথ্যমতে, একই এলাকার একটি পুকুর পাড় থেকে আয়নীর মৃতদেহ উদ্ধার করে পিবিআই। এমনকি আয়নীকে ধর্ষণের পর শ্বাসরোধ করে হত্যার স্বীকারোক্তি দিয়ে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দিও দেন সেই রুবেল।

আয়নীর পরিবারের দাবি, এসআই দুলালকে অনুরোধের পরও রুবেলের কোনো সম্পৃক্ততা পায়নি বলে জানান তিনি। এমনকি রুবেল ‘ভালো ছেলে’ বলেও মন্তব্য করেন তিনি। কিন্তু ঘটনার দিন যদি এসআই দুলাল পক্ষপাতমূলক আচরণ না করে সুষ্ঠ তদন্ত করতেন, তবে আরও এক সপ্তাহ আগে গ্রেপ্তার হতো রুবেল, হয়তো জীবিত ফিরে পাওয়া যেতো আয়নীকেও।

আয়নীর অপহরণ মামলা আইনজীবী ও মানবাধিকার সংগঠন বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের মহাসচিব জিয়া হাবিব আহসান বলেন, ‘আয়নী হত্যাকাণ্ডে রুবেলের সঙ্গে এসআই দুলালও দায়ী। তিনি যদি সেদিন সিরিয়াসলি তদন্ত করতো, রুবেলকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করতো, তবে আয়নীকে জীবিত ফিরে পাওয়া যেতো।’

অন্যদিকে একজন ভুক্তভোগীকে সাহায্য করার বদলে ঠাট্টা-মশকরা করার বিষয়টি মানবাধিকার লঙ্ঘন বলে মনে করেন জিয়া হাবিব। তিনি বলেন, ‘এসআই দুলাল এমন সময়ে ঠাট্টা করে নিজের পেশাদারিত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন, সেইসঙ্গে মানবাধিকার লঙ্ঘনও করেছেন তিনি।’

পিবিআই তদন্তে আয়নী হত্যাকাণ্ডে জড়িত অপরাধীদের চিহ্নিত করা না হলে পরবর্তীতে এসআই দুলালের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও জানান জিয়া হাবিব।

এদিকে সকল অভিযোগ মিথ্যা দাবি করেছেন এসআই দুলাল। তিনি বলেন, ‘জ্বিন চালান বা প্রেম করে পালিয়ে যাওয়া—এই সম্পর্কিত কোনো কথা আমি বলিনি। ২১ মার্চ নিখোঁজ ডায়েরি করার সঙ্গে সঙ্গেই আমি ফিল্ডে গেছি। কিন্তু তেমন কোনো ক্লু পাইনি।’

এসআই দুলাল আরও বলেন, ‘২৬ মার্চ ফাতেমা আমাদের বলেন, রুবেল আমার মেয়ের সঙ্গে ৪-৫ মিনিট কথা বলেছে—এমন একটা সিসিটিভির ফুটেজ আছে। আমরা সেই ফুটেজের সত্যতা পাই এবং রুবেলকে থানায় ডেকে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করি। কিন্তু রুবেল জানায়, ওই মুহূর্তে আয়নী তার কাছে বিড়ালের বাচ্চা চেয়েছিল। এরপর রুবেল বলে, বিড়ালের বাচ্চা হলে রুবেল তার বোনের বাসা থেকে একটি এনে দেবে। তারপর তারা দু’জন চলে যায়।’

তিনি বলেন, ‘রুবেলের কথাবার্তায় সেদিন কোনো সন্দেহ না হওয়াতে আমরা তাকে ছেড়ে দিই। কারণ তার বয়স্ক মা থানায় এসে অভিযোগ করে, আমরা নাকি তার গরিব ছেলেকে থানায় এনে নির্যাতন করেছি। তাই আমি ওসি স্যারের নির্দেশে রুবেলকে তার মায়ের হেফাজতে দিই। আমরা তাকে অবজারভেশন করছিলাম নিয়মিত।’

পিবিআই একদিনে পারলো, আপনারা এক সপ্তাহেও পারলেন না, তাহলে কি আপনাদের তদন্তে ঘাটতি ছিল—এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘না, আমাদের ঘাটতি ছিল না। আমরা তাকে আবারও ডেকে আনার জন্য মঙ্গলবার (২৮ মার্চ) ফোন করলে রুবেল জানায় তাকে পিবিআইয়ের কিছু কর্মকর্তা জিজ্ঞাসাবাদ করছে। আমি তখন ফোনে পিবিআইয়ের এক ইন্সপেক্টরের সঙ্গে কথা বলি। ওনাকে বলি যে, রুবেল কে আমাদেরও দরকার, আমরা জিজ্ঞাসাবাদ করবো। এরপর আরও সময় আমি আবারও রুবেলকে ফোন দিই। তখন আমাদের আগ্রহ দেখে হয়তো পিবিআই রুবেলকে আরও বেশি সন্দেহ করেছে এবং অ্যারেস্ট করে নিয়ে গেছে।’

এর আগে গত ২১ মার্চ বিড়ালের বাচ্চা দেওয়ার লোভ দেখিয়ে একটি নির্জন ভবনে আয়নীকে ধর্ষণের পর শ্বাসরোধ করে হত্যা করে রুবেল। এরপর সবজির ভ্যানে করে আয়নীর লাশ নিয়ে পুকুরের পাড়ে ময়লার স্তূপে ফেলে দেয়। তার কাপড় ও স্যান্ডেল ফেলে দেওয়া হয় পাশের আরেকটি নালাতে। আয়নীর লাশ যাতে মানুষের নজরে না আসে সেজন্য প্রতিদিন সেই লাশের বস্তার ওপর খড়কুঁটো ফেলতেন রুবেল।

ওইদিন আরবী পড়তে বের হয়ে নিখোঁজ হয় ১০ বছর বয়সী আবিদা সুলতানা আয়নী। অনেক খোঁজাখুঁজির পরও কোথাও না পেয়ে থানায় মামলার চেষ্টা করেন স্বজনরা। কিন্তু থানায় মামলা না নেওয়ায় মঙ্গলবার সকালে চট্টগ্রামের নারী শিশু নির্যাতন দমন বিশেষ ট্রাইব্যুনাল-২ এ মামলার আবেদন করেন শিশুটির মা। মামলায় মো. রুবেল নামের সবজি বিক্রেতাকে আসামি করা হয়। আবেদনের শুনানি শেষে আদালতের বিচারক শরমিন জাহান পাহাড়তলী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে (ওসি) সরাসরি এজাহার গ্রহণের নির্দেশ দেন।

ডিজে

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!