পিকে হালদারের টাকা পাচারে চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীর হাত, পাঁচতারা হোটেল উঠছে ইউরোপে

কানাডাসহ কয়েকটি দেশে শত শত কোটি টাকা পাচার করা পি কে হালদারের জালিয়াতিতে ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে কাজ করেছেন চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী আবদুল আলিম চৌধুরী। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধানে এ বিষয়ে তথ্যপ্রমাণ বেরিয়ে এসেছে।

জালিয়াতির মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও পুঁজিবাজারে অর্থ সরিয়ে নিয়ে আত্মসাৎ করেছেন পি কে হালদার। এই ক্ষেত্রে ১৪টি প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করা হয়েছে। ১৪ প্রতিষ্ঠানের মাত্র দুটি ঠিকানা ব্যবহার করা হয়েছে। টাকা আত্মসাতের অভিযোগে পি কে হালদার ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা হয়েছে ইতোমধ্যে। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির আরও অভিযোগ অনুসন্ধান করছে দুদক।

দুদকের অনুসন্ধানে জানা গেছে, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং নামের একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণের নামে জে কে ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের নাম ব্যবহার করে প্রায় ২০০ কোটি টাকা তুলে নেন পি কে হালদার। একই কায়দায় এফএএস ফাইন্যান্স থেকে প্রায় ১০০ কোটি টাকা নেওয়া হয়। জাল এনআইডি ও ভুয়া ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠানের নাম ব্যবহার করে রিলায়েন্স, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং ও এফএএস ফাইন্যান্স থেকে প্রায় ৪৫০ কোটি টাকা লোপাট করা হয়। এই কাজে পি কে হালদারকে সহায়তা দিয়েছেন চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী আবদুল আলিম চৌধুরী।

দুদকের অনুসন্ধান বলছে, চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী আবদুল আলিম চৌধুরী নিজে ঋণের নামে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ৬৫০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে বিদেশে পাচার করেছেন।

এদিকে সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী আবদুল আলিম চৌধুরী ইউরোপীয় দেশ মন্টেনিগ্রোয় ফোর পয়েন্টস বাই শেরাটন ও ওয়েস্টিন নামে দুটি পাঁচতারকা হোটেলের বড় অংশীদার। ওই দুটি হোটেলে তিনি ৬০৩ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন।

মন্টেনেগ্রোয় ওয়েস্টিন হোটেলের নির্মাণকাজের যাত্রারম্ভে দেওয়া পার্টিতে মন্টেনেগ্রোর নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে আবদুল আলিম চৌধুরী (ডানে)।
মন্টেনেগ্রোয় ওয়েস্টিন হোটেলের নির্মাণকাজের যাত্রারম্ভে দেওয়া পার্টিতে মন্টেনেগ্রোর নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে আবদুল আলিম চৌধুরী (ডানে)।

দেশের অন্তত সাতটি ব্যাংক ও একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে আলিমের প্রায় ৪১৬ কোটি টাকার দেনা রয়েছে বলে জানা গেছে। তার বিরুদ্ধে এসব ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের দায়ের করেছে ১৯টি অর্থঋণ মামলা ও ১৭টি চেকের মামলা। চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার বাসিন্দা আবদুল আলিম চৌধুরী চট্টগ্রাম নগরীর ওআর নিজাম আবাসিকের ৫ নম্বর রোডের ‘ন্যাম হাউজ’ নামের বাড়িটির মালিক।

জানা গেছে, জে কে ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের নামে চট্টগ্রামের ওয়ান ব্যাংকের জুবিলী রোড ও স্টেশন রোড শাখায় একাধিক হিসাব খোলা হয়েছিল। বিডি ট্রেডিং নামের অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের মালিক ইরফান আহমেদ। দুই প্রতিষ্ঠান থেকে ২০১৪-১৮ সাল পর্যন্ত বিদেশে পাচার করা হয় ৪০০ কোটি টাকা।

দুদক জানায়, দুবাইয়ে অর্থ পাচারে চট্টগ্রামের ওই ব্যবসায়ীকে ব্যবহার করেছেন পি কে হালদার। দুবাইয়ে রোয়েল আমরো লিমিটেড নামের কোম্পানির হিসাবে শত শত কোটি টাকা পাচার করা হয়।

দুদকের অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, পি কে হালদার রিলায়েন্স লিজিংয়ের এমডি থাকাকালে জাল এনআইডি ব্যবহার করে ভুয়া দুই ব্যক্তির নামে ১৫০ কোটি টাকা ঋণ দিয়ে আত্মসাৎ করেছেন। জে কে ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের মালিক ইরফান আহমেদ খান ও ভার্স মেটাল ইন্ডাস্ট্রিজের মালিক ফয়সাল মুস্তাকের নামে নেওয়া হয় এই ঋণ। বাস্তবে ইরফান আহমেদ খান ও ফয়সাল মুস্তাকের কোনো অস্তিত্ব নেই। ভুয়া এনআইডি তৈরি করে ট্রেড লাইসেন্স ইস্যু করা হয়েছে। এনআইডি ও ট্রেড লাইসেন্সের ঠিকানা খুঁজে পাওয়া যায়নি।

জাল এনআইডি ব্যবহার করে দ্রিনান অ্যাপারেলস নামীয় একটি কাগুজে প্রতিষ্ঠানের নামে প্রায় ১০০ কোটি টাকা ঋণ নেওয়া হয় ইন্টারন্যাশনাল লিজিং থেকে। ভুয়া কোম্পানিটির চেয়ারম্যান ছিলেন লে. কর্নেল (অব.) কাজী মোমরেজ মাহমুদ ও এমডি ছিলেন আবু রাজীব মারুফ। চেকে স্বাক্ষর পাওয়া গেছে রাজীম সোমের- যার এনআইডি ভুয়া। ব্যাংক এশিয়ার ধানমন্ডি শাখায় যে হিসাবে টাকা স্থানান্তর করা হয় সংশ্নিষ্ট এই গ্রাহকের এনআইডি ছিল ভুয়া।

দুদকের অনুসন্ধান থেকে আরও জানা যায়, দ্রিনান অ্যাপারেলসের পক্ষে এমডি আবু রাজীব মারুফ ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্য ২০১৬ সালের ৯ মার্চ ২০ কোটি টাকা মেয়াদি ঋণ ও ৪০ কোটি টাকা চলতি মূলধনসহ মোট ৬০ কোটি টাকার ঋণের আবেদন করেছিলেন ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ে। জামানত হিসেবে আনান কেমিক্যালসের মানিকগঞ্জের ১০০ শতাংশ জমি, সিকিউরিটি হিসেবে পিপলস লিজিং থেকে আনান কেমিক্যালসের কেনা এক কোটি ৪৪ লাখ ৪০ হাজার ৯০০টি শেয়ার দেখানো হয়। এসব যাচাই ছাড়াই ওই পরিমাণ ঋণ দেওয়া হয়।

ঋণ প্রস্তাবটি ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদনের পর ঋণ মঞ্জুরিপত্রে স্বাক্ষর করেন ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাশেদুল হক। যিনি দুদকের মামলায় বর্তমানে জেলে।

দুদকের অনুসন্ধান থেকে আরও জানা যায়, দ্রিনান অ্যাপারেলস এমডি আবু রাজীব মারুফের ২০১৬ সালের ৮ মে ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের সাবেক এমডি রাশেদুল হক বরাবর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের চেক নং গ০০০৮৬১২ অনুযায়ী ১২ কোটি টাকা বিতরণ করা হয়। এরপর ৪৮ লাখ ৭৫ হাজার ১৮৫ টাকা বিতরণ করা করা হয়। একইভাবে কাগুজে প্রতিষ্ঠান ওয়াকামা লিমিটেড, পি অ্যান্ড এল, কণিকা, উইন্টেল ইন্টারন্যাশনাল, দেয়া শিপিং, আরবি, বর্ণ, নিউট্রিক্যাল, মুন, আর্থস্কোপ, এমটিবি মেরিনসহ দুই ডজন কাগুজে প্রতিষ্ঠান ব্যবহার করে পি কে হালদার ও তার সহযোগীরা চারটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে লুট করেছেন প্রায় কয়েক হাজার কোটি টাকা।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!