পায়ে পচন ধরা লোকটি পড়ে ছিল রাস্তায় জমা বৃষ্টির পানিতে

তিনি ছিলেন হকার। কাজির দেউড়ি এলাকায় কোনো এক দুর্ঘটনায় লোকটি আঘাত পান পায়ে। টাকার অভাবে পারেননি চিকিৎসা করাতে। সেই পায়ে ধীরে ধীরে পচন ধরতে থাকে। একসময় এসে লোকটি হারিয়ে ফেলেন মানসিক ভারসাম্য। পরিবারও সরে যায় দূরে। সেই থেকে তার ঠিকানা রাস্তা। কখনও তাকে দেখা যায় জামালখান-চেরাগী পাহাড়ে। কখনও আন্দরকিল্লার রাস্তার ধারে। পচন ধরে পা থেকে আঙ্গুল খসে পড়তে থাকলে পরিবারের কেউ একজন এসে বুধবার (১৭ জুন) তাকে নিয়ে যায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে চিকিৎসা দেওয়া তো দূরের কথা, রীতিমতো তাড়িয়েই দেওয়া হল। পরিবারের বিরক্ত লোকগুলো শেষমেশ তাকে ফেলে গেল এনায়েতবাজারের রাস্তায়।

রাস্তায় জমা বৃষ্টির পানিতে পড়ে ছিল লোকটি। আশেপাশের কেউ আসা তো দূরের, কেউ এগিয়ে যেতে চাইলে উল্টো বাধা দেয় বাজারের মানুষ। অসহ্য যন্ত্রণায় লোকটির চিৎকার শুনে সাহস করে এগিয়ে যান এক মানবাধিকার কর্মী। তখনও তেড়ে আসে বাজারের কিছু মানুষ। শেষে চট্টগ্রাম নগর পুলিশের মানবিক পুলিশ ইউনিটের ত্বরিৎ সহায়তায় সেই লোকটিকে নিয়ে যাওয়া হয় পাশের একটি মন্দিরের বারান্দায়। কিন্তু সেখানেও বিপত্তি। মন্দির কর্তৃপক্ষসহ এলাকার মানুষ ওই লোককে কোনোভাবেই জায়গা দিতে চান না। শুক্রবার তাকে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়া হবে এবং লোকটি যদি প্রস্রাব-পায়খানা করে তাহলে সেগুলো পরিস্কার করে দেওয়া হবে— এমন প্রতিশ্রুতি দিয়ে মন্দিরের বারান্দায় একটা রাত রাখার জন্য শেষে রাজি করানো হয়।

এলাকার লোকজন রাজি হলে কী হবে, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল আগেই বলে দিয়েছে পরিস্কার না করে আনলে লোকটিকে ঢোকাতেই দেওয়া হবে না। গত বুধবারও এই কারণে সরকারি এই হাসপাতালটি ওই লোককে বের করে দিয়েছিল। শুক্রবার (১৯ জুন) সকালে মানবিক পুলিশ ইউনিট ও ওই মানবাধিকার কর্মীসহ কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবক মিলে লোকটির পায়ে ছোট্ট একটি অপারেশনের ব্যবস্থা করতে যাচ্ছেন। এরপর তাকে আবার চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করানোর চেষ্টা করবেন তারা— এখন পর্যন্ত পরিকল্পনা এমনই।

পরে একরাতের জন্য ঠাঁই হল মন্দিরের বারান্দায়
পরে একরাতের জন্য ঠাঁই হল মন্দিরের বারান্দায়

বৃহস্পতিবার (১৮ জুন) এনায়েতবাজারের রাস্তায় পড়ে থাকা যন্ত্রণাকাতর লোকটির চিৎকার শুনে সাহস করে এগিয়ে গিয়েছিলেন যে মানবাধিকার কর্মী, তার নাম ইকবাল মুন্না।

তিনি বললেন, ‘অসহায় লোকটিকে অনেক আগে থেকে জামাল খান-চেরাগী পাহাড় এলাকায় দেখতাম। একসময় আন্দরকিল্লা রাজাপুকুর লেইনে ছিল, কিন্তু অনেকদিন ধরে দেখি না। আজ হঠাৎ করে আমি এনায়েতবাজার গোয়ালপাড়া এলাকায় একটা কাজে গেলে দেখি, বৃষ্টিতে রাস্তার পানিতে সেই লোকটি পড়ে আছে। তখন আমি এলাকার কয়েকজন মানুষকে ডেকে উনাকে একটা মন্দিরের বারান্দায় তুলে আনতে গেলে বাজারের কিছু মানুষ আমাকে বাধা দেয়। তখন আমি সাথে সাথেই চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ সদর দপ্তরের মানবিক পুলিশ ইউনিটের শওকত হোসাইনকে ফোন করলে বাধা দেওয়া লোকগুলো দূরে সরে যায়। ওই সময় উপস্থিত থাকা কয়েকজনের কাছ থেকে জানতে পারি, উনাকে গতকাল (বুধবার) চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখান থেকে চিকিৎসা না করে বের করে দেয়। তাই তার পরিবার তাকে রাস্তায় রেখে চলে যায়। কিন্তু আমরা তো এমন কাজ মানতে পারি না বা করতে পারি না।’

‘আর তখনই আমি মানবিক পুলিশ ইউনিটের শওকত ভাইকে সব খুলে বলি। তখন উনি সাথে সাথেই কাজির দেউড়ি স্টেডিয়াম এলাকায় আসলে আমরা আবারও এই বৃষ্টিতে লোকটির কাছে আসি। উনার অবস্থা দেখে সামান্য খাবারদাবার দিই। তার সঙ্গে কথা বলে শুক্রবার (১৯ জুন) সকালে লোকটির চিকিৎসার জন্য মানবিক পুলিশ ইউনিটের শওকত ভাইয়ের সাথে আলাপ করে সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করি’— বলেন ইকবাল মুন্না।

সামনের পরিকল্পনা নিয়ে তিনি বলেন, ‘তাকে পরিস্কার না করা ছাড়া হাসপাতালেও রিসিভ করছে না। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে উনাকে দুই দিন আগে বের করে দিয়েছে, যার কারণে তার পরিবারও আশা ছেড়ে দিয়েছে। তাই আমরা উনাকে রাস্তা থেকে তুলে মন্দিরের বারান্দায় রেখে মন্দির কর্তৃপক্ষ ও এলাকার মানুষজনকে বলে এসেছি যে, আগামীকাল শুক্রবার (১৯ জুন) সকালে আমরা তার ট্রিটমেন্ট করবো। যদি প্রস্রাব-পায়খানা করে তা আমরা পরিস্কার করে দেবো। তারপরও যেন উনাকে একটা দিন এখানে থাকতে দেয়।’

ইকবাল মুন্না জানান, ‘শুক্রবার সকাল ১১টায় তার প্রথম ডিসিং বা ছোট একটা অপারেশন হবে রাস্তায়। পরে তাকে মেডিকেল নিয়ে যাবো পুলিশের মানবিক টিমসহ আমি। তবে উনার পা একট কেটে ফেলতে হবে ৯৯% কনফার্ম। কারণ এটা পুরাটাই পোকা খেয়ে ফেলেছে।’

তিনি বলেন, ‘আমরা জানতে পারি যে কাজির দেউড়ির মোড়ে একটি দুর্ঘটনায় লোকটি পায়ে আঘাত পান। এরপর থেকে টাকার অভাবে চিকিৎসা করতে না পারায় আস্তে আস্তে তার পায়ে পচন ধরে যায়। আর এতে লোকটি মানসিক ভারসাম্যও হারায়। এখন তার ঠিকানা রাস্তা।’

‘দেখলাম, কতোটা বীভৎস অবস্থা। পুরো পা পঁচে আঙ্গুলগুলো খসে পড়ছে। যন্ত্রণায় অনবরত লোকটি চিৎকার করে চলছে। যে কান্না ও আর্তচিৎকার সুশীল সমাজের কারও কানে পৌঁছায় না। মহান রাব্বুল আল-আমিনের কাছে ফরিয়াদ করি যেন লোকটি এই নরক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পান’— বলেন মুন্না।

মানবিক পুলিশ ইউনিটের শওকত হোসেন বলেন, ‘লোকটা যখন অসহায়ভাবে তার পায়ের দিকে তাকাচ্ছিলো, তখন আমার কলিজাটা ফেটে যাচ্ছিল। আমরা মানবিক পুলিশ ইউনিট আমাদের সর্বোচ্চটা দিয়ে চেষ্টা করবো তাকে রিকোভারি করার জন্য।’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!