পানির দরে চামড়া/ ক্ষতির ক্ষোভে পরিবেশে নতুন চ্যালেঞ্জ!

রাঙ্গুনিয়ার বখতিয়ার আযম, পেশায় ট্রাকচালক। দুটো টাকা বাড়তি আয়ের আশায় জমানো টাকার সঙ্গে আরও একলাখ টাকা ধার করে গড়ে ৩৫০ টাকা দরে ৫১৫টি গরুর চামড়া কিনেছেন। আড়তদার কিংবা তাদের কোন প্রতিনিধি এবার চামড়া কিনতে এলাকায় যায়নি। তাই তিনি নিজেই ট্রাক ভরে চামড়াগুলো নিয়ে এসেছেন শহরে। বহদ্দারহাট, মুরাদপুর এলাকায় কেউ না কেনায় সর্বশেষ আতুরারডিপো এলাকায় এসে মূল্য পাচ্ছেন প্রতিটি চামড়া ১০ টাকা! হতাশ বখতিয়ার ১০ টাকায় বিক্রি না করে একপর্যায়ে আতুরারডিপো এলাকায় ডাস্টবিনে ফেলে দিলেন সবগুলো চামড়া।

চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বখতিয়ার আযম জানালেন, ‘নিজের জমানো টাকা শেষ। এখন থেকে ধারে-শোধে দৌঁড়াতে হবে।’

এভাবে শুধু বখতিয়ার আযম নয়, হাটহাজারীর আফসার উদ্দিন জুয়েল, ফটিকছড়ির একরামুল হকসহ মৌসুমী সকল চামড়া ব্যবসায়ীর একই দশা। তারা কাঙ্ক্ষিত মূল্য না পেয়ে নগরীর আতুরারডিপো, বহদ্দারহাট, মুরাদপুর, চৌমুহনীসহ শহরের বিভিন্ন এলাকায় চামড়া ফেলে চলে গেছেন। আর্থিক ক্ষতির এই ক্ষোভ পরিবেশের জন্য নতুন এক চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে।

বিষয়টিকে বির্পযয় হিসেবে বর্ণনা করে খোদ চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন নিজেই মঙ্গলবার (১৩ আগস্ট) কন্ট্রোল রুমে জরুরি সভায় বসেছিলেন। বর্জ্য অপসারণে সফলতা দেখালেও অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে এই চামড়া অপসারণের বিষয়টি চসিক নতুন চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করে ইতোমধ্যে সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে চামড়া অপসারণে মাঠে সক্রিয় থাকতে দেখা গেছে।

এই সংকট কেন জানতে চাইলে চট্টগ্রামের বৃহত্তর কাঁচা চামড়া আড়তদার সমবায় সমিতির সভাপতি আবদুল কাদের চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘ঢাকার ট্যানারি মালিকদের কাছে চট্টগ্রামের চামড়া আড়তদারদের পাওনা প্রায় ৫০ থেকে ৬০ কোটি টাকা। আমাদের সমিতির ১১২ জন সদস্য আছে। বকেয়া টাকা না পাওয়ায় আমার সমিতির প্রায় ৮০ থেকে ৯০ জন সদস্য এবার চামড়া কিনতে পারেননি। অনেকেই কোরবানও করতে পারেননি। ব্যাংক লোনসহ ঢাকার ট্যানারি মালিকরা সরকার প্রদত্ত সকল সুযোগ সুবিধা ভোগ করেন। আর আমাদের টাকাও আটকে রাখেন।’
তবে কী পরিমাণ চামড়া তারা এবার সংগ্রহ করেছেন তা জানাতে পারেননি তিনি।

সমিতির সাধারণ সম্পাদক খোরশেদ আলম বলেন, ‘চট্টগ্রামে ট্যানারি না থাকায় আমরা ঢাকার ব্যবসায়ীদের হাতে জিম্মি। চট্টগ্রামের ২২টি ট্যানারি থেকে কমতে কমতে এখন দুটি ট্যানারি আছে। ইটিপি না থাকায় মদিনা ট্যানারি বন্ধ। রিফ লেদার কিছু চামড়া ক্রয় করে। অনিশ্চিত জেনেও আমরা আমাদের সাধ্যমতো চামড়া কিনেছি। যেসব চামড়া কিনতে পারিনি তা চামড়ার সমস্যা। চামড়ায় ১২ ঘন্টার মধ্যে লবণ মাখাতে হয়। গ্রাম থেকে পচিয়ে ২৪ ঘন্টা পর চামড়া শহরে আনলে আমরা ওই চামড়া কিনে কী করবো?’

চ্যামড়া ব্যবসায়ী সমিতির উপদেষ্টা আবদুল মান্নান বলেন, ‘আমি পৈতৃকসূত্রে চামড়া ব্যবসায়ী। আমার আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য ছিল। ঢাকার ব্যবসায়ীদের হাতে জিম্মি হয়ে আমিও ব্যবসার পরিসর ছোট করে নিতে বাধ্য হয়েছি। ট্যানারি মালিকদের কাছে যদি এক কোটি টাকা বকেয়া পাই, তারা শোধ করে এক লাখ টাকা। এই টাকায় চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী চামড়া কিনবে? নাকি কোরবানির গরু কিনবে?’

তিনি বলেন, ‘চোখের সামনে শিল্পটা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। চট্টগ্রামের ২২টা ট্যানারির স্থলে এখন চালু আছে একটি মাত্র ট্যানারি। তারা পাঁচ থেকে সাত শতাংশ চামড়া ক্রয় করে। ২২টা যদি চালু থাকতো ঢাকার ট্যানারি মালিকদের চট্টগ্রামের বব্যসায়ীরা আমলে নেওয়ারও দরকার হতো না।’

এবার আড়তদাররা চট্টগ্রামে সাড়ে ৫ লাখ গরুর চামড়া ও ৮০ হাজার ছাগলের চামড়া সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল। ঢাকার বাইরে সরকার প্রতি বর্গফুট চামড়ার দর ৩৫ টাকা থেকে ৪০ টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছে। বড় গরুর প্রতিটি চামড়া সাধারণত ১৮ থেকে ২০ বর্গফুট হয়। ছোট গরুর চামড়া সর্বোচ্চ ১২ থেকে ১৫ বর্গফুট পর্যন্ত হয়। তবে চামড়া ব্যবসায়ীরা এই দাম নিয়ে কারসাজি করেছে। তারা বললো সরকার লবণ মেশানো চামড়ার দাম নির্ধারণ করেছে এই দরে। এই যুক্তি দিয়েও কেউ কেউ লবণ ছাড়া চামড়া কিনতে অপারগতা দেখিয়েছে।

এয়াকুব আলী চৌধুরী নামের আরেক আড়তদার জানালেন, ‘ঈদের আগ মুহূর্তে লবণের দাম দ্বিগুণ হয়ে গেছে। ৭৪ কেজি লবণের বস্তা ৩০০ টাকার স্থলে ৬৫০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। চামড়া শিল্পের শ্রমিকদের মজুরিও বেড়েছে। চট্টগ্রামে ট্যানারি না থাকায় সব মিলে আমাদের দিন ভালো যাচ্ছে না।’

জামিয়া মাদানিয়া শুলকবহরের শিক্ষক মাওলানা আবদুল্লাহ নোমান জানিয়েছেন, তারা গড়ে ৩৫০ হিসেবে সংগৃহীত সব চামড়া আড়তে বিক্রি করেছেন। প্রায় আড়াইশ চামড়া তারা দান হিসেবে পেয়েছেন। তাই তাদের আর্থিক ক্ষতির কোন বিষয় নেই। দাম বেশি হলে আয় বেশি হতো।

পূর্ব মোহরা আজিজিয়া মাদরাসা ও এতিমখানার নির্বাহী পরিচালক মাওলানা আমানউল্লাহ বলেন, ‘আমরা নিজ উদ্যোগে গাড়িতে করে বাড়ি বাড়ি গিয়ে গতকাল ১৬২টি চামড়া সংগ্রহ করেছি। তবে কোনও কাস্টমার না পেয়ে শেষ পর্যন্ত আজ বিকেলে সিটি কর্পোরেশনের গাড়ি ডেকে তা অপসারণের ব্যবস্থা করেছি। না হলে তো গন্ধে থাকা যাবে না। এসব চামড়া কী করব?’

আতুরারডিপো এলাকায় চামড়া অপসারণ তদারকিতে থাকা চসিকের পরিচ্ছন্নতা পরিদর্শক সুমন বিশ্বাস বলেন, ‘আমার চাকরির বয়স প্রায় ত্রিশ বছর। আমি কখনও এমন বিপর্যয় দেখিনি। আমাদের ওপর এটা অতিরিক্ত একটি ঝামেলা।’

চসিক উত্তর জোনের বর্জ্য অপসারণ কমিটির প্রধান ৭ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মোবারক আলী বলেন, ‘প্রায় লক্ষাধিক চামড়া এখন চসিকের ময়লার ভাগাড়ে। এটি চসিকের জন্য অতিরিক্ত একটি আপদ হিসেবে দেখা দিয়েছে।’

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!