পাথরঘাটায় ঝরে পড়া ৭ জীবনের মূল্য কতো?

পৃথিবীতে বিশ্বাসের অভাব থাকলেও মানুষের নিশ্বাসের কোনো বিশ্বাস নেই। চোখের পলকে মুহূর্তেই হঠাৎ নাই হয়ে যায় প্রাণচঞ্চল মানুষ। খুব তুচ্ছ ঘটনার সূত্র ধরে বড় ঘটনার সূত্রপাত হয়। একে একে ঝরে পড়ে তাজা প্রাণ। পাথরঘাটার গ্যাসলাইন বিস্ফোরণে নিহত সাতজনের কেউই কল্পনাতেও ভাবেনি ওই সকালের ভোরই হবে তাদের জীবনের শেষ ভোর।

এ নিয়ে ঘটনাস্থলে উপস্থিত অনেকে বলেন, এমন হৃদয়বিদারক ঘটনার পরক্ষণেই গঠন করা হয় ৩ সদস্য কিংবা ৫ সদস্যের তদন্ত কমিটি। ৭ দিনের মধ্যে কথা থাকে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার। তারপর সামনে আসে আরেকটি বড় কোন ঘটনা। তারপর এই তদন্ত কমিটির তদন্ত প্রতিবেদনের সেই ৭ দিন আর আসেই না। এভাবেই নতুন নতুন ঘটনার নিচে চাপা পড়ে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন। এমনকি জানা যায় না ঘটনার মূল কারণই বা কী। এ নিয়ে আশার কোন বাণী নেই। এই সাতটি জীবনের কি কোন মূল্য নেই?

সাতটি জীবনের নির্ধারিত মূল্য
জীবনের প্রয়োজনে বের হয়ে বিস্ফোরণে প্রাণ হারিয়ে এই ৭ জীবনের মূল্য কয়েক হাজার কিংবা লাখ টাকায় সীমাবদ্ধ। ঘটনা চাউর হতেই মুহূর্তের মধ্যে পাশে এসে দাঁড়ান নেতা-কর্মীরা। চসিক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন তৎক্ষণাৎ ঘোষণা দেন নিহত ৭ জনের পরিবারকে ১ লাখ টাকা দেওয়া হবে। একই সাথে দাফনকাজ সম্পন্ন করার জন্য ২০ হাজার টাকা। প্রয়াত মহিউদ্দিন চৌধুরীর ছেলে বোরহানুল হাসান সালেহীন নিহতদের স্বজনদের ১০ হাজার টাকা দেওয়ার ঘোষণা দেয়। প্রশাসনের পক্ষ থেকে ২০ হাজার এবং বিএনপির সভাপতি ডা.শাহাদাত হোসেনের পক্ষ থেকে ১০ হাজার। প্রতি জীবনের মূল্য ১ লাখ ৬০ হাজার। নিহতদের স্বজনদের আহাজারিতে ভারি হয়ে উঠে চমেক হাসপাতালের পরিবেশ।

এদিকে নিহতের স্বজনরা বলেন, ‘টাকা পেলেই কি জীবন ফিরে আসবে? প্রত্যেক পরিবারের সাজানো গোছানো সংসার ও স্বপ্ন মুহূর্তেই মাটির সাথে মিশে একাকার হয়ে গেলো। আপনজনের জীবনের প্রয়োজন যে অমূল্য তা কেবল পরিবারই বুঝবে।’

অ্যানি বড়ুয়া
‘ওমারে এদুগ্গুন মুখ দেখি বউঅর মুখ ন দেহি কা! ঘরের লক্ষ্মী গেইয়ে গেই! ওবুক ওবুক আঁর ঘরর লক্ষ্মী গেইয়ে গেই। আঁই ক্যান গইজ্জুম, ক্যান গইজ্জুম। তুই কিল্লাই গিয়্যুছ’— এভাবেই বুক চাপড়ে আহাজারি করছিলেন অ্যানি বড়ুয়ার শাশুড়ি বিজলি বড়ুয়া। লাশঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আহাজারি করতে করতে মূর্ছা যান। বাকি স্বজনরা সান্ত্বনা দিতে গিয়ে তারাও কান্নায় ভেঙে পড়েন। বিজলি বড়ুয়াকে বাড়ি ফিরিয়ে নিতে চাইলে কান্না করে বলতে থাকেন— আই ন যাইয়ুম দে। আই ন যাইয়ুম দে!

কক্সবাজার রামুর বাসিন্দা জিন প্রসাদ বড়ুয়ার মেয়ে অ্যানি বড়ুয়া। পটিয়ার উনানপুরা গ্রামের ইঞ্জিয়ার পলাশ বড়ুয়ার সাথে ১৭ বছর আগে বিয়ে হয় নিহত অ্যানি বড়ুয়ার। ১০ বছর ধরে শিক্ষকতা করছেন মেহের আঁটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। দুই ছেলে অভিষেক বড়ুয়া আর অভিজিৎ বড়ুয়াকে নিয়ে সাজানো সংসার। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষার কেন্দ্রে যাওয়ার জন্য রওনা দিতে ঘর থেকে বের হওয়ার পর পথেই গ্যাসলাইন বিস্ফোরণে নিথর দেহ পড়ে থাকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা দেয়ালের খণ্ডগুলোর চাপায়।

জুলেখা বেগম ফারজানা-আতিকুর রহমান শুভ
স্ত্রী জুলেখা বেগম ফারজানা এবং দুই ছেলে আতিকুর রহমান শুভ ও আতিফুর রহমান শুভ্রকে নিয়ে সাজানো সংসার আইনজীবী আতাউর রহমানের। বড় ছেলে শুভকে নিয়ে স্কুলের দিকে রওনা দেন মা জুলেখা বেগম ফারজানা। আদালত ভবনের চেম্বারে না যেতেই আতাউর রহমানের কাছে খবর আসে মেডিকেল থেকে। ছুটে গিয়ে যখন দেখেন ছেলে আর সহধর্মিণীর নিথর দেহ তখন তিনিও জ্ঞান হারান। বাবাকে কান্না করতে দেখে চুপসে যায় তিন বছর বয়সী আতিফুর।

আতিফুরকে ভাইয়ের নাম জিজ্ঞেস করা হলে বলে, এ টি আই কে ইউ এল আতিকুল। জবাব দেয় হ্যাঁ হ্যাঁ আতিকুল। আতিফুর জানে না তার মা আর বড় ভাইকে আর কখনও সে দেখবে না। আর কোনোদিন আদর করে কাছে ডেকে নেবে না তাকে। সাতকানিয়া উপজেলার কালিয়াইশ গ্রামের বাসিন্দা আতাউর রহমানদের বাসা পাথরঘাটার নজু মিয়া লেনে। রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাবার সময় বিস্ফোরণে বিধ্বস্ত দেওয়াল পড়ে প্রাণ হারায় মা জুলেখা বেগম ফারজানা এবং ছেলে আতিকুল রহমান শুভ। পরিবারের অন্যান্য আত্মীয়-স্বজন দেশে না থাকায় ছুটে আসেন প্রতিবেশীরা।

নুরুল ইসলাম
প্রচণ্ড বিস্ফোরণে ভাঙা দেয়ালের ছিঁটকে আসা টুকরো টুকরো অংশের আঘাতে লুটিয়ে পড়েন রঙমিস্ত্রি নুরুল ইসলাম। সকালেই কাজ করতে আসেন এই এলাকায়। পাশের টং দোকান থেকে চা-নাশতা খেয়ে যাবার আগেই চাপা পড়েন উড়ে আসা দেয়ালের ভাঙ্গা টুকরোর আঘাতে। স্ত্রী সাদিয়া সুলতানা আর ১১মাস বয়সী একমাত্র কন্যা মিফতাহুল জান্নাতকে নিয়ে থাকতেন চান্দগাঁও থানার ক্ষেতচর এলাকায়। অভাবের সংসারে একমাত্র স্বামী নুরুল ইসলাম ছিল ভরসার নাম। সেই ভরসা আজ দেয়াল চাপায় শেষ।

১১ মাস বয়সী কন্যা মিফতাহুল জান্নাত ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে নানী মনোয়ারা বেগমের দিকে। মায়ের কাছে যেতে চাইলেও অবুজ শিশুটিও বুঝে নিচ্ছে মা স্বাভাবিক নেই।

মোহাম্মদ সেলিম
ভাসমান জীবন তার। এক সময় থাকতেন তুলাতুলীর বস্তিতে। বস্তি উচ্ছেদের পর মাথা গোঁজার ঠাঁই হয়েছে কাজির দেউড়ি এলাকায়। রিকশা চালিয়েই সংসার চালাতেন। যাত্রী নিয়ে গন্তব্যে যাওয়ার আগেই হয়েছেন মৃত্যু পথিক। কক্সবাজার মহেশখালীর গোরকঘাটা থেকে জীবিকার তাগিদে এসেছেন শহরে। জীবিকার যোগান হলেও জীবনটাই নাই হয়ে গেল সেলিমের।

মোহাম্মদ শুক্কুর
দিনে আনে দিনে খায়। দিনমজুরিতেই সংসার চলতো শুক্কুরের। কাজের সন্ধানে এসে চাপা পড়েন দেয়ালের ধ্বংসস্তুপে।

অজ্ঞাত ব্যক্তি
নাম-পরিচয় জানা যায়নি কিছুই। আদৌ পরিবার আছে কি নেই তাও অজানা সবার। কি কারণেই বা এই মৃত্যুকূপে পা রেখেছেন অজ্ঞাত ব্যক্তি তাও জানা নেই কারো। হয়তো পরিবার অপেক্ষায় আছে নয়তো নয়।

বিস্ফোরণের দায় নিতে চায় না কেউ
এখনও পর্যন্ত বিস্ফোরণের ঘটনার সূত্রপাত কী— নিশ্চিত করে তা উদঘাটিত হয়নি। কেবলমাত্র ধারণার উপরেই চলছে দোষারোপ। ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তাদের বক্তব্য, গ্যাস লাইনের ত্রুটির জন্যই এই দুর্ঘটনা। ইতিমধ্যে গ্যাসলাইনে কোনো সমস্যা থেকে বিস্ফোরণের সূত্রপাত হয়নি বলে দিনে দিনেই তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির (কেজিডিসিএল) কর্মকর্তারা।

ক্ষোভ প্রকাশ করে অ্যানি বড়ুয়ার প্রতিবেশী সুনয়না চক্রবর্তী চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘এটা কারও দোষ না। বিস্ফোরণের দায় নিহতদের। কেন তারা ওই পথ দিয়ে গেল!’

এসএস

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!