‘পাগলি’ মায়ের কুড়িয়ে পাওয়া নবজাতক নিয়ে পুলিশ-পথচারীর মর্মস্পর্শী কাহিনি

পাগলিটাও মা হয়েছে, তবে বাবা হয়নি কেউ। পাগলি বলে যায়নি ছেড়ে প্রসব ব্যথার ঢেউ—কবিতার চরণগুলোর মতই মানসিক ভারসাম্যহীন আয়েশা (২৬) ফুটপাতে জন্ম দিলেন এক কন্যাশিশুর। এমন ঘটনা ঘটেছে নগরীর আগ্রাবাদ এলাকায়। আগ্রাবাদের ফুটপাত জুড়ে মানসিক ভারসাম্যহীন আয়েশার রাজ্য। পথে পথে খুঁজে যদি পায় তবেই জোটে খাবার। দিন চলে এভাবেই।

মঙ্গলবার (২০ আগস্ট) ভোরে প্রসবব্যথার যন্ত্রণা সইতে না পেরে গর্ভ থেকে নিজেই বের করেন সন্তান। সন্তানের মায়া বোঝার বোধশক্তি নেই বলেই ছুঁড়ে ফেলে দেন রাস্তার ওপারে। রক্তমাখা ছেঁড়া কাপড় জড়ানো অবস্থায় পড়ে ছিলেন রাস্তার একপাশে। খানিক পর পর ময়লা কাগজ দিয়ে রক্ত মুছে ছুঁড়ে মারছেন পথের দিকে। ভোর হওয়াতে তেমন মানুষের আনাগোনা ছিল না সেখানে। নাইট ডিউটি ছিল বলে আক্তারুজ্জামান সেন্টার মার্কেটের সামনে টহল দিচ্ছিলেন ডবলমুরিং থানার এসআই মোস্তাফিজুর রহমান।

বাদামতলী ক্রসিং থেকে ২০ গজ উত্তর দিকে সোনালী ব্যাংকের সামনে ফুটপাতের ওপর কয়েকটি কুকুরকে কিছু একটা নিয়ে টানাটানিসহ মারামারি করতে দেখে কৌতূহলবশত এগিয়ে গিয়ে সেখানে সদ্য প্রসূত এক জীবন্ত শিশুকে দেখতে পেয়ে বুকের ভেতরটা নাড়া দিয়ে উঠে।

ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে এসআই মোস্তাফিজুর বলেন, ‌‘শাহিনুর নামের এক মহিলার সাহায্য নিয়ে পরক্ষণে শিশুটিকে উদ্ধার করে দ্রুত আগ্রাবাদ মা ও শিশু হাসপাতালে নিয়ে যাই। শিশুটির মায়ের সন্ধান করি। পরে জনতা ব্যাংকের সামনে মানসিক ভারসাম্যহীন মায়ের সন্ধান পাই। মা ও নবজাতক শিশুটিকে চমেক হাসপাতালে ভর্তি করি৤’

সাহায্যকারী পথচারী শাহিনুর ডায়াবেটিসের রোগী। প্রতিদিন নিয়ম করে সকালে হাঁটতে বের হন। আজও যখন হাঁটছিলেন তখন ভারসাম্যহীন আয়েশাকে স্বাভাবিক ভেবে দেখেও এড়িয়ে যান। দুইবার রাউন্ড দিয়ে আসার পর আয়েশাকে দেখে ভেবেছিলেন পিরিয়ডজনিত সমস্যার কারণে রক্তমাখা কাগজ ফেলছেন পথে। পরে পুলিশের ডাকে তিনিও এগিয়ে আসেন।

সাহায্যকারী শাহিনুর চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘প্রতিদিনই দেখতাম এই পাগলিটাকে। আজকেও স্বাভাবিক ভেবেছিলাম। পরে স্যারের (এসআই মোস্তাফিজুর রহমান) ডাকে সামনে এসে দেখি এই অবস্থা। বাচ্চাটিকে ওড়না দিয়ে ডেকে নিই। আংশিক নাড়ি ছিল, তা দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছিল। তারপর স্যারসহ দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাই। পাগলিটা তো বোঝে না বাচ্চাটিকে কাছে দিতেই মেরে ফেলতে চাইছে। আজ রাতে তাদের দেখাশোনার জন্য হাসপাতালে থাকবো।’

ডবলমুরিং থানার সহকারী কমিশনার আশিকুর রহমান চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘মা এবং শিশুটি চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ৩৩ নং ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন রয়েছে। আমাদের এসআই মোস্তাফিজুর রহমান তাদের উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায়। নবজাতক বাচ্চাটির জন্য নতুন জামাকাপড়ও নেওয়া হয়। মা ও শিশু দুজনেই সুস্থ আছে।’

এদিকে নবজাতক শিশুটি সুস্থ থাকলেও মায়ের বুকের দুধ পায়নি। মায়ের কাছে নিলেই ভারসাম্যহীন মা মেরে ফেলতে চাইছে। একই ওয়ার্ডে থাকা আরেক দম্পতির চোখে পড়ে ঘটনাটি। তারা এগিয়ে এসে বাচ্চাটিকে কোলে তুলে নেয়। এর দুদিন আগে এই দম্পতির বাচ্চা পৃথিবীর আলো দেখার আগেই গর্ভে মারা যায়। সদ্য সন্তানকে দুগ্ধপান না করাতে পেরে তিনিও যন্ত্রণায় কাতর। এই বাচ্চাটিকে পেয়ে তিনিও সাময়িক মুক্তির স্বাদ পেয়েছেন।

এসআই মোস্তাফিজুর রহমান চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমরাও তো মানুষ। চোখের সামনে জীবন্ত একটা শিশু হাত-পা নাড়ছে আর আমি তাকে এই কুকুরদের খাবার হিসেবে ফেলে রাখবো? নিজের কাছে নিজেকে অপরাধী মনে হতো যদি বাঁচাতে না পারতাম। এখন মা-মেয়ে দুজনেই সুস্থ আছে। তবে তাদের সার্বক্ষণিক দেখার জন্য একজন লোক রাখবো। পুরো সুস্থ হলে তখন ব্যবস্থা নেবো তাদের কোথায় রাখা যায়। আপাতত সুস্থ হয়ে উঠার অপেক্ষা করছি।’

এসআর/সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!