পর্যটন নগরীতে ছিনতাইকারীদের রাজত্ব, ছিনতাইয়ের ঘটনা আড়াল করে পুলিশ

ঢাকার মোহাম্মদপুর থেকে পর্যটননগরী কক্সবাজারে ঘুরতে আসেন সুমাইয়া খানম ও রিফাত হাসান দম্পতি। ২৭ ফেব্রুয়ারি রাতে সাড়ে ১১টার দিকে ঘোরাফেরা শেষে ফিরছিলেন হোটেলে। কিন্তু কলাতলী মোড় আসতেই তাদের গতি রোধ করে একদল ছিনতাইকারী। অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে রিফাতের গলা চেপে ধরে তাদের মোবাইল, টাকা ছিনিয়ে নেয় ছিনতাইকারী চক্র।

রিফাত-সুমাইয়ার মতো গত এক সপ্তাহে ১০ জনের বেশি লোক ছিনতাইয়ের শিকার হয়েছে কক্সবাজার শহরে। শুধু পর্যটক নন, স্থানীয় বাসিন্দা থেকে শুরু করে বিভিন্ন পেশার মানুষ সর্বস্ব হারাচ্ছেন ছিনতাইকারী চক্রের কাছে। সম্প্রতি এক অ্যাডভোকেটকে বুকে ও পিঠে এলোপাথাড়ি ছুরিকাঘাত করেছে ছিনতাইকারীরা।

আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতির কারণে পর্যটননগরীতে এমন ঘটনা হচ্ছে বলে জানান স্থানীয় বাসিন্দারা। সেইসঙ্গে ছিনতাইয়ের ঘটনায় থানায় অভিযোগ জানালেও ছিনতাইকারীদের ধরতে পুলিশের কোনো অগ্রগতি নেই বলে অভিযোগ করেন ভুক্তভোগীরা।

২৭ ফেব্রুয়ারি সকালে সুমাইয়া-রিফাত দম্পতির মতো একই স্থানে ছিনতাইয়ের শিকার হন একটি বেসরকারি মোবাইল কোম্পানির কর্মকর্তা রাজ নামের এক ব্যক্তির। তার কাছ থেকে মোবাইল নিয়ে ফেলে ছিনতাইকারীরা। পরে ওই ঘটনায় কক্সবাজার সদর মডেল থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন তিনি। এটির তদন্তের দায়িত্ব পড়ে এএসআই মনিরুলের ওপর। কিন্তু ভুক্তভোগী রাজ বলেন, অভিযোগ তদন্তকারী কর্মকর্তাকে ওসি (তদন্ত) বলে দেয়ার পরও তদন্ত দূরের কথা ফোন করলে সে ফোন তিনি রিসিভও করেন না।

এর আগে গত ২৬ ফেব্রুয়ারি রাত ৯টার দিকে শহরের মোহাজেরপাড়া থেকে বোনের বাসায় বেড়াতে যাওয়ার সময় পৌর প্রিপারেটরি উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক সুজন দাশ ও তার স্ত্রী এনজিওকর্মী কৃষ্ণা দাশ ছিনতাইকারীর কবলে পড়েন। শহরের মোহাজেরপাড়ার সমিতির বিল্ডিংয়ের গলির সামনে পৌছঁলে পেছন থেকে ২/৩ জন ছিনতাইকারী সুজনের স্ত্রীর গলায় ছুরি ধরে। এ সময় প্রাণভয়ে তারা স্বর্ণের চেইন, কানের দুল ও মোবাইল দিয়ে দেয় ছিনতাইকারীদের। পরে অজ্ঞাতনামাদের আসামি করে শিক্ষক সুজন দাশ বাদী হয়ে থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন।

এছাড়া গত ১ মার্চ ছিনতাইকারীদের ছুরিকাঘাতে গুরুতর আহত হন অ্যাডভোকেট রেজাউল করিম রেজা। ওইদিন সন্ধ্যা ৭টার দিকে শহরের বাসটার্মিনাল থেকে অটোরিকশা করে কলাতলীর হোটেলে যাওয়ার সময় উত্তরণের সামনে রেজাকে ঘিরে ফেলে একদল ছিনতাইকারী। এ সময় আইনজীবীর পেটে ও পিঠে এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাত করে তার মোবাইল ও নগদ টাকা ছিনিয়ে নেয় ছিনতাইকারীরা।

ওই ঘটনার পরদিন বুধবার (২ মার্চ) কক্সবাজার জেলা আইনজীবী সমিতি মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ করে। প্রতিবাদ সমাবেশে স্পেশাল পিপি অ্যাডভোকেট একরামুল হুদা বলেন, কক্সবাজার শহরে বর্তমানে ছিনতাইকারীদের রামরাজত্ব চলছে। আমার স্কুলপড়ুয়া ছাত্রকেও ছুরিকাঘাত করে মোবাইল ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে। পুলিশ অপরাধীদের আটক করতে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। যে কারণে দিন দিন এই জেলা শহরের আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি ঘটছে।

এদিকে একই দিন ১ মার্চ সকাল সোয়া ৬টার দিকে শহরের সেন্ট্রাল হাসপাতালের সামনে ছিনতাইয়ের শিকার হন একটি বেসরকারি সংস্থার কর্মী প্রিয়তোষ বেদজ্ঞ। এ ঘটনায় রাতে থানায় অভিযোগ দাখিল করতে গেলে সেটি গ্রহণ না করে উল্টো তাকে মোবাইল হারানো বা চুরির জিডির পরামর্শ দেন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি)।

প্রিয়তোষ বেদজ্ঞের ছোট ভাই সাংবাদিক মনতোষ বেদজ্ঞ বলেন, সকালে দুই যুবক ছুরির ভয় দেখিয়ে আমার ভাইয়ের সর্বস্ব ছিনিয়ে নেয়। এ ঘটনায় ভাইকে নিয়ে থানায় যাই। কিন্তু থানার কর্তব্যরত কর্মকর্তা বলেন, ছিনতাইয়ের জিডি নেওয়া সম্ভব নয়। চুরি বা হারানোর অভিযোগে জিডি করতে হবে।

এরপর বিষয়টি আমি তাৎক্ষণিক থানার ওসিকে মুঠোফোনে অবহিত করি এবং প্রতিকার চাই। তিনি আমাকে নিজের কক্ষে ডেকে নিয়ে একই পরামর্শ দেন। ওসি বলেন, চুরি বা হারানোর ডায়েরি করলে আমরা দ্রুত উদ্ধারের ব্যবস্থা করতে পারব।

কক্সবাজার সদর মডেল থানার ওসি শেখ মুনীর উল গিয়াস বলেন, ছিনতাইয়ের ঘটনা আড়াল করে হারানো ডায়েরি করার পরামর্শের বিষয়টি সত্য নয়। আমি ভুক্তভোগীকে বলেছি কোনো অপরাধ সংঘটিত হওয়ার পর জিডি করা যায় না। হয়তো মামলা, নয়তো হারানো ডায়েরি করতে হবে।

কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম বলেন, ছিনতাইয়ের ঘটনা যদি হয়ে থাকে, তাহলে প্রকৃত তথ্য দিয়ে ভুক্তভোগী থানায় অভিযোগ দাখিল করতে পারেন। সেক্ষেত্রে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তা মামলা হিসেবে নথিভুক্ত করবেন। ভুক্তভোগী কেন মিথ্যা তথ্য দিয়ে জিডি করবেন? আমি মনে করি, প্রকৃত তথ্য দিয়ে অভিযোগ করা উচিত।

ডিজে

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!