২৬ মার্চের পর ‘লকডাউনে’ যাবে চট্টগ্রাম?

জল-স্থল-আকাশপথ বন্ধ, নেমেছে সেনাবাহিনী

করোনাভাইরাসের ভয়াবহ ঝুঁকিতে রয়েছে চট্টগ্রাম— সরকারের পক্ষ থেকে কড়া এই বার্তা এসেছে আগেই। চট্টগ্রামে এখন পর্যন্ত প্রায় এক হাজার মানুষ হোম কোয়ারেন্টাইনে আছেন। এদের সবাই বিদেশফেরত। এদের মধ্যে কারও করোনাভাইরাস থাকলে তা ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছিল প্রশাসন থেকে। শেষমেশ সৌদি আরব থেকে আসা কক্সবাজারের এক বৃদ্ধ নারীকে করোনাভাইরাস আক্রান্ত বলে শনাক্ত করা হল মঙ্গলবার (২৪ মার্চ)। ৭৫ বছর বয়সী ওই নারী দেশে ফিরে ১৩ মার্চ উঠেন চট্টগ্রামের সিডিএ আবাসিক চান্দগাঁওয়ে ছেলের বাসায়। এ কারণে নগরীর চান্দগাঁও আবাসিক ও বাকলিয়া থানার কালামিয়া বাজার এলাকায় ওই নারীর দুই ছেলের দুটি বাড়ি লকডাউন করে দিয়েছে প্রশাসন। এ ঘটনায় কক্সবাজার শুধু নয়, আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে চট্টগ্রামেও।

এদিকে কক্সবাজারে করোনাভাইরাসে শনাক্ত হওয়া প্রথম রোগীর বসবাসের স্থানসহ বিশাল একটি জায়গা লকডাউন করে দেওয়া হয়েছে। এ অঞ্চলে করোনা রোগী পাওয়ায় বান্দরবান পার্বত্য জেলার তিন উপজেলা লামা, আলীকদম ও নাইক্ষ্যংছড়িকে লকডাউন করেছে জেলা প্রশাসন। চট্টগ্রামও কি সে পথেই হাঁটছে— এমন প্রশ্নের জন্ম হয়েছে অনেকের মনেই। লকডাউন চলাকালে এলাকা থেকে কেউ বেরোতে পারে না, আবার বাইরে থেকে কেউ ঢুকতেও পারে না।

লকডাউনের ঘোষণা না এলেও করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে মঙ্গলবার (২৪ মার্চ) থেকে আন্তঃনগর ট্রেন, লোকাল, মেইল ও ডেমু ট্রেন চলাচল বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। একইদিন রাত ১২টার পর থেকে অভ্যন্তরীণ সব ফ্লাইটও বন্ধ হয়েছে। যাত্রীবাহী লঞ্চও আর চলছে না। বাস চলাচল বন্ধ হতে যাচ্ছে ২৬ মার্চ থেকে। আপাতত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ থাকছে আগামী ৯ এপ্রিল পর্যন্ত। এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা স্থগিত হয়েছে আগেই। অফিস-আদালতে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে আগামী ৪ এপ্রিল পর্যন্ত।

সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে ইতিমধ্যে চট্টগ্রামের স্কুল-কলেজ, বিনোদন স্পটগুলো ছাড়াও কোচিং সেন্টার-রেস্টুরেন্ট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সব ধরনের জনসমাগমে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। বুধবার (২৫ মার্চ) বিপণিবিতান-মার্কেটও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এতে ধারণা করা হচ্ছে, ধীরে ধীরে লকডাউনের (অবরুদ্ধ) দিকে এগোচ্ছে চট্টগ্রাম। আবার সরকারের মন্ত্রীরাও বলছেন অবস্থা বুঝে লকডাউনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে, অর্থাৎ যদি করোনা শনাক্ত হয় তার বিস্তার রোধে সরকার অবশ্যই লকডাউনের পথে হাঁটবে।

চীনের ‘উহান’ শহরে যখন সর্বপ্রথম করোনাভাইরাস শনাক্ত হয় তখন অন্যত্র যাতে তা ছড়িয়ে না পড়ে সেজন্য চীন উহানের সব কিছু বন্ধ করে দিয়েছিল, যাকে বলা হয় লকডাউন।

ঢাকায় করোনাভাইরাস শনাক্ত হওয়ার পরপরই সরকার ১৬ মার্চ সারা দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ৩১ মার্চ পর্যন্ত বন্ধ ঘোষণা করে। এমনকি বহু কাঙ্খিত মুজিববর্ষের কর্মসূচি পর্যন্ত কাটছাট করেছে সরকার। ১৭ মার্চ বিনোদন কেন্দ্রগুলোতে ভীড় দেখে নড়েচড়ে বসেন সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা। ১৮ মার্চ একে একে বন্ধ হতে থাকে পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত, পারকি সমুদ্র সৈকত, চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানাসহ সকল পার্ক ও বিনোদন কেন্দ্র।

১৯ মার্চ চট্টগ্রাম নগর পুলিশ সকল কমিউনিটি সেন্টার ও হোটেলে জনসমাগমের বুকিং বাতিল করতে নির্দেশনা জারি করে। জেলা প্রশাসন হোম কোয়ারেন্টাইন (স্বেচ্ছাবন্দি) পালনে কড়া নজরদারি শুরু করে। ১৮ মার্চ থেকে চট্টগ্রাম বিভাগের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করছেন। চট্টগ্রামে এ পর্যন্ত অনেক প্রবাসীকে আর্থিক জরিমানাও করা হয়েছে। তবে কোন দেশ থেকে কতজন প্রবাসী ফেরত এসেছেন তার পূর্ণাঙ্গ ডাটা এখনো নেই কোন সংস্থার কাছে।

পূর্ণাঙ্গ তথ্যউপাত্ত না থাকার কারণ হিসেবে প্রশাসনিক কর্মকর্তারা বলছেন, চট্টগ্রাম বিমানবন্দর হয়ে বিদেশফেরতদের সবাই চট্টগ্রামের অধিবাসী নয়। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের প্রবাসী চট্টগ্রাম হয়ে দেশে ফিরছেন। কড়াকড়ি আরোপের আগেই হাজার হাজার প্রবাসী দেশে প্রবেশ করেছেন। প্রথম দিকে তো শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে থার্মাল স্ক্যানারও ছিল না। ১০ মার্চ এসেছে সেই থার্মাল স্ক্যানার।

আরও আশঙ্কার বিষয় বৃহস্পতিবার চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে বিভাগীয় কমিশনারের বৈঠকে কুমিল্লা জেলা প্রশাসক একেএম শামসুল হক তুলে ধরে বলেন, ইমিগ্রেশন ডাটা অনুযায়ী জানুয়ারি মাসে কুমিল্লায় এসেছেন ১০ হাজার প্রবাসী দেশে। কিন্তু তাদের ১০ ভাগও কুমিল্লায় নেই। তারা ঢাকা-চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন শহরে ছড়িয়ে পড়েছেন।

অভিন্ন সুর ছিল সব দায়িত্বশীল কর্মকর্তার কন্ঠে। জবাবে বিভাগীয় কমিশনার এবিএম আজাদ বলেন, ‘আগে যা হয়েছে হয়েছে, এখন সেটা রিকভার করতে হবে।’ তিনি ইমিগ্রেশনের কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছেন প্রবাসফেরতদের পার্সপোটের ফটোকপি সংরক্ষণ করতে। জেলা ও উপজেলা প্রশাসনকে নির্দেশ দেন ইমিগ্রেশন থেকে তথ্য নিয়ে দ্রুত প্রবাসফেরতদের আইডেন্টিফাই করে হোম কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করতে।

একই দিন প্রধানমন্ত্রীর মূখ্য সচিব ও মন্ত্রিপরিষদ সচিব মাঠ প্রশাসনের সবার সাথে ভিডিও কনফারেন্স করে সারা দেশে রাজনৈতিক সভা সমাবেশ, ধর্মীয় মাহফিল, তীর্থযাত্রাসহ সকল ধরনের জনসমাগম নিষিদ্ধ করেছে এবং কঠোরভাবে তা তদারকি করার জন্য মাঠ প্রশাসনকে নির্দেশও দিয়েছেন।

আবার সুপ্রিম কোর্ট দেশের সকল আদালতকে কারাগার থেকে আসামি আদালতে হাজির না করে মামলা চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। যদি একান্ত উপস্থিত করতেই হয় সেক্ষেত্রে মামলার কার্যক্রমই স্থগিত রেখে পরবর্তিতে তারিখ নির্ধারণ করার নির্দেশ দিয়েছেন। চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতি চট্টগ্রাম আদালতের বিচারকদের সাথে বৈঠক করে মামলার পক্ষগুলোকে আদালতে আইনজীবীর মাধ্যমে হাজিরা দিলে তা গ্রহণ করতে সম্মত করিয়েছেন।

বৃহস্পতিবার (১৯ মার্চ) তথ্য মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে সাংবাদিকদের সাথে আলাপচারিতায় তথ্যমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ বলেছেন, করোনার উৎপত্তিস্থল চায়না এটিকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পেরেছে। আমাদের সরকারও প্রস্তুতি নিয়েছে। প্রয়োজন হলে দেশের যেকোনো জায়গা লকডাউন হতে পারে।

লকডাউনের বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মো. ইলিয়াছ হোসেন বলেন, এখনও সরকারের পক্ষে থেকে আমাদেরকে সে রকম কোন নির্দেশনা দেওয়া হয়নি। আপাতত জনসমাগম বন্ধের নির্দেশনা আছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুযায়ী হোম কোয়ারেন্টাইনের বিষয়ে আমরা মাঠপর্যায়ে কাজ করছি। সার্বিক অবস্থা যদি লকডাউনের দিকে যায়, সরকার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে তখন আমরাও সেদিকে যাবো।

করোনাভাইরাসে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে মাদারীপুর জেলার শিবচর উপজেলাকে লকডাউন করা হয়েছে। কারণ শিবচরে ৬৩৯ জন প্রবাসী দেশে এসেছেন ইটালিসহ ইউরোপে করোনা আক্রান্ত দেশ থেকে। তাই ওষুধ ও নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দোকান ছাড়া সবকিছু বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এর ফলে কেউ শিবপুরে প্রবেশ করতেও পারবেন না, শিবপুর থেকে বাইরেও যেতে পারবেন না।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!