পরিবারহারা বিপন্ন শিশুরা মাথা গোঁজার ঠিকানা খোঁজে আকাশের নিচে
আবাসনের অভাবে পথশিশুদের পুনর্বাসনের চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছে
নেই পরিবার-পরিজন, নেই মাথা গোঁজার একটুকু ঠাঁই। দিনের বেলা মূলত খাবারের খোঁজে এখানে-সেখানে ঘুরে বেড়ালেও গভীর রাতে রাস্তার পাশে কিংবা বিভিন্ন মোড়ে তাদের পাওয়া যায় ঘুমন্ত অবস্থায়। নানা উদ্যোগ নিয়েও শুধুমাত্র সুনির্দিষ্ট আবাসনের অভাবে এই পথশিশুদের লেখাপড়ার ব্যবস্থা্ তো নয়ই, পুনর্বাসনও করা যাচ্ছে না।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউশন অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ (বিআইডিএস) ও ইউনিসেফের ২০০৫ সালের গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে মোট ৯ লাখ ৭৯ হাজার ৭২৮ জন পথশিশু রয়েছে। এর মধ্যে চট্টগ্রাম বিভাগে রয়েছে ৫৫ হাজার ৮৫৬ জন।
পথশিশু শব্দটি সেই সব শিশুদের প্রকাশ করে, যাদের কাছে রাস্তাই (বিস্তৃত অর্থে বস্তি, পতিত জমি ইত্যাদিও এর অন্তর্ভুক্ত) তাদের স্বাভাবিক বাসস্থান অথবা জীবিকা নির্বাহের উৎস হয়ে উঠেছে এবং তারা দায়িত্বশীল কোনো প্রাপ্তবয়স্ক কর্তৃক সুরক্ষিত, পথ নির্দেশনা প্রাপ্ত ও পরিচালিত নয়।
বাংলাদেশ মানব উন্নয়ন সূচকে ১৩৩তম স্থানে থাকা একটি দেশ, যেখানে জনসংখ্যার অর্ধেক মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে, সেখানে এই শিশুরা সামাজিক স্তরগুলোর মধ্যে সর্বনিম্ন স্তরের প্রতিনিধিত্ব করে। দেশের জনসংখ্যা এখন বেড়েছে, আর রাস্তার শিশুর সংখ্যাও বেড়ে দাঁড়িয়েছে।
এই শিশুদের নিয়ে সরকারি ও বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোর নানারকম কর্মসূচি রয়েছে। এর বাইরে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনও এসব সুবিধাবঞ্চিত পথশিশুদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে কাজ করছে।
চট্টগ্রাম শহরের বিভিন্ন এলাকায় প্রচুর সুবিধাবঞ্চিত শিশুর দেখা মেলে। নগরে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের নিয়ে কাজ করে— এমন দুটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন চারুলতা ও নগরফুলের স্বেচ্ছাসেবীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, শহরে লিগ্যাল অভিভাবক থাকা এবং লিগ্যাল অভিভাবক না থাকা— এই দুই ধরনের সুবিধাবঞ্চিত শিশু তাদের নজরে পড়লেও লিগ্যাল অভিভাবকহীন শিশুদের নিয়ে কাজ করা বেশ কঠিন। নির্দিষ্ট কোনো ঠিকানা ও অভিভাবক না থাকা এমন শিশুর সংখ্যা শহরে কতজন তার কোনো সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি। তবে বেসরকারি সংস্থা নগরফুলের এক জরিপের তথ্য অনুযায়ী, পরিবার-পরিজন ও বাসস্থানহীন পথশিশুর সংখ্যা দেড় হাজারের কাছাকাছি।
কিভাবে এই জরিপ পরিচালিত হয়েছে— এই প্রশ্নের উত্তরে নগরফুলের স্বেচ্ছাসেবী ইমাম হোসাইন চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘গত শীতে আমরা পুরো নগরের সব এলাকাতেই শীতবস্ত্র বিতরণ করেছি। সেখানে গভীর রাতে রাস্তায় কিংবা বিভিন্ন মোড়ে যেসব শিশুদের পেয়েছি, তাদেরকেই আমরা একেবারে বাস্তুচ্যুত পথশিশু হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছি। ওই সময় আমরা এমন শিশু পেয়েছি প্রায় দেড় হাজার।’
সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের নিয়ে কাজ করা আরেকটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন চারুলতার উদ্যোক্তাদের একজন অভীক রায়হান। চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে তিনি বলেন, ‘আমরা মূলত সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের পড়াই। তাদের শিক্ষা উপকরণ সরবরাহ করি। পাশাপাশি বিভিন্ন সময়ে তাদের পরিবারকে খাদ্য সহায়তাসহ বিভিন্ন জরুরি সহযোগিতা দিয়ে থাকি। তবে যেসব শিশু একেবারেই ছিন্নমূল, তাদের নিয়ে আমরা সেভাবে কাজ করতে পারি না।’
এই না পারার কারণ ব্যাখ্যা করে অভিক রায়হান বলেন, ‘সবচেয়ে বড় সংকট হচ্ছে নির্দিষ্ট ঠিকানা না থাকা এসব শিশুকে আবাসন সুবিধার আওতায় আনা ছাড়া কাজ করাই সম্ভব না। তবু আমরা চেষ্টা করি। কিন্তু এখানে বিভিন্ন রাজনৈতিক ও পারিপার্শ্বিক অসুবিধাও থাকে। অনেক সময়ে আমরা খুব চেষ্টা করে একটা ছিন্নমূল শিশুকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিলেও এক দুই দিন পর দেখা যায় সে আর আগের জায়গায় নেই। তাকে পাওয়া যায় না। এখন এটা কেন হয় তার উত্তর আমরা নিজেরাও জানি না।’
এসব শিশুদের জন্য শুধুমাত্র আবাসিক সুবিধা নিশ্চিত করতে না পারায় ইচ্ছা ও সুযোগ থাকলেও জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ঘোষিত মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণাপত্র, ১৯৪৮ এর ২৫ নম্বর ধারার ১ ও ২ উপধারা এবং ২৬ ধারার ১ ও ২ নম্বর উপধারা দ্বারা সংরক্ষিত অধিকার পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এসব শিশু।
ঘোষণাপত্রের ২৫ এর ১ ধারায় বলা হয়েছে, ‘খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিত্সা ও প্রয়োজনীয় সমাজকল্যাণমূলক কার্যাদির সুযোগ এবং এ সঙ্গে পীড়া, অক্ষমতা, বৈধব্য, বার্ধক্য অথবা জীবনযাপনে অনিবার্যকারণে সংঘটিত অন্যান্য অপারগতার ক্ষেত্রে নিরাপত্তা এবং বেকার হলে নিরাপত্তার অধিকারসহ নিজের এবং নিজ পরিবারের স্বাস্থ্য এবং কল্যাণের জন্য পর্যাপ্ত জীবনমানের অধিকার প্রত্যেকেরই রয়েছে।
অন্যদিকে ২৫ এর ২ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, ‘মাতৃত্ব এবং শৈশবাবস্থায় প্রতিটি নারী এবং শিশুর বিশেষ যত্ন এবং সাহায্য লাভের অধিকার আছে। বিবাহবন্ধন-বহির্ভূত কিংবা বিবাহবন্ধনজাত সকল শিশু অভিন্ন সামাজিক নিরাপত্তা ভোগ করবে।’
এবং একই ঘোষণাপত্রের ২৬ এর ১ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, ‘প্রত্যেকেরই শিক্ষালাভের অধিকার রয়েছে। অন্ততঃপক্ষে প্রাথমিক ও মৌলিক পর্যায়ে শিক্ষা অবৈতনিক হবে। প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক হবে। কারিগরী ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা সাধারণভাবে লভ্য থাকবে এবং উচ্চতর শিক্ষা মেধার ভিত্তিতে সকলের জন্য সমভাবে উন্মুক্ত থাকবে।’
২৬ এর ২ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, ব্যক্তিত্বের পূর্ণ বিকাশ এবং মানবিক অধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতা-সমূহের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ সুদৃঢ় করার লক্ষ্যে শিক্ষা পরিচালিত হবে। শিক্ষা সকল জাতি, গোত্র এবং ধর্মের মধ্যে সমঝোতা, সহিষ্ণুতা ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক উন্নয়নের প্রয়াস পাবে এবং শান্তিরক্ষার স্বার্থে জাতিসংঘের কার্যাবলীকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
এই বিষয়ে অভীক রায়হানের সাথে পুরোপুরি একমত ইমাম হোসাইনও। এই শিশুদের আবাসন সুবিধার আওতায় আনাসহ সমাজের মূলধারার মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে সরকারি উদ্যোগের বিকল্প নেই— এমন মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘এই যে দেড় হাজার শিশু এদের তো থাকার ব্যবস্থাই নেই। এখন স্বেচ্ছাসেবকদের পক্ষে এটা করাও সম্ভব না। সরকারিভাবে এদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বছর ২০১৭ সালের জাতীয় শিশু দিবসে ঘোষণা করেছিলেন যে, কোনো শিশু পথে থাকবে না। তার ধারাবাহিকতায় মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে একটি প্রকল্প নেওয়া হয়, যেটি পথশিশু পুনর্বাসন কার্যক্রম নামে পরিচিত। জাতীয় শিশু একাডেমির অধীনে এমন ছিন্নমূল শিশুদের পুনর্বাসনের জন্য ১০০ সিটের একটি শিশু বিকাশ কেন্দ্র থাকলেও তাতে এই মুহূর্তে সবমিলিয়ে শিশু রয়েছে ৬০ জন। এই পুনর্বাসন কেন্দ্রে আবার ভর্তি হতে হয় আবেদন করে। চট্টগ্রাম জেলা শিশু বিষয়ক কর্মকর্তা নূরুল আবছার ভূঁঞা চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে এসব তথ্য জানিয়েছেন। ফলে ছিন্নমূল শিশুরা বরাবরই থেকে যাচ্ছেন নজরদারির বাইরেই।
এক্ষেত্রে সরকারি তরফ থেকে স্বয়ংক্রিয় পুনর্বাসন ব্যবস্থা চালু করার দাবি তুলে নগরফুলের স্বেচ্ছাসেবী ইমাম হোসাইন বলেন, ‘একেবারে ছিন্নমুলদের নিয়ে আমরা কাজ করি না। আবার তাদের নিয়ে গিয়ে সেখানে ভর্তি করিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রেও কিছু বাধা তো আছেই। এক্ষেত্রে স্বেচ্ছাসেবীরা দায়িত্বপ্রাপ্তও না। কিন্তু প্রশাসনিকভাবে এদের পুনর্বাসন কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়ার একটা ব্যবস্থা থাকা উচিত। এমনিতেই পুনর্বাসন সুবিধা পর্যাপ্ত না। তার ওপর যতটুকু সক্ষমতা আছে সেটার সদ্ব্যবহার করতে না পারলে সেটা হবে দুঃখজনক।’
সরকারিভাবে পথশিশুদের স্বয়ংক্রিয় পুনর্বাসন ব্যবস্থা করার বিষয়ে স্বেচ্ছাসেবীদের এমন দাবির বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে চট্টগ্রাম জেলা শিশু বিষয়ক কর্মকর্তা নূরুল আবছার ভূঁঞা চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘এখন পর্যন্ত আমরা আবেদনের মাধ্যমেই ভর্তি নিই। সিদ্ধান্ত পরিবর্তন কেন্দ্রীয় ব্যাপার। জাতীয়ভাবে যদি এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় তাহলে আমরা অবশ্যই বাস্তবায়ন করবো।’
এই বিষয়ে নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ফজিলাতুন নেসা ইন্দিরার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেও সফল হওয়া যায়নি। তবে প্রতিমন্ত্রীর একান্ত সচিব হাবীবুর রহমান বলেন, ‘এখন পর্যন্ত আমাদের পুনর্বাসনের যে কার্যক্রম আছে, সামনে সেগুলো আরও বাড়ানো হবে। সে সময়ে এমনটা হতে পারে।’
সিপি