পতেঙ্গা সৈকতের সৌন্দর্য ম্লান নোংরা আবর্জনার স্তূপে

চট্টগ্রামের জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত। নগরীর ৪১ নম্বর ওয়ার্ডের পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতে কয়েক মাস আগের মতো সে সুন্দর দৃশ্য এখন আর বিরাজ করে না। যেখানে মানুষ সুসজ্জিত বাগানের রঙ-বেরঙের বর্ণিল নানা ধরনের ফুলের সুভাস নিয়ে, রঙ-বেরঙের বসার আসনে বসে, সমুদ্র পাড়ে হেঁটে, সমুদ্রের বিশাল ঢেউয়ের বিশালতা উপভোগ করার কথা। সেখানে সমুদ্র সৈকতের সৌন্দর্য উপভোগ করার চেয়ে বিরক্তিকর মনোভাবই প্রকাশ পাচ্ছে অনেক দর্শনার্থীদের মধ্যে।

পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতে কয়েক মাস আগেই কোটি টাকা ব্যয় করে সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ করা হয়েছিল। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) চট্টগ্রাম সিটি আউটার রিং রোড প্রকল্পের আওতায় পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতে পাঁচ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ করে। পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতের সৌন্দর্যবর্ধিত হওয়ার পর দু’পাশে যত দূর চোখ যেতো, দেখা যেতো কেবল মানুষ আর মানুষ। সুসজ্জিত বাগানের ফুলের সঙ্গে মুঠোফোনে ছবি তুলতে ব্যস্ত থাকতেন দর্শনার্থীরা। অনেকেই আবার হাঁটারপথ (ওয়াকওয়ে) ধরে সমুদ্রের সৌন্দর্য উপভোগে ব্যস্ত রাখতেন নিজেকে। অনেকে একটু নিচে নেমে সমুদ্রের বালুচরে হেঁটে বেড়াতেন।

সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়, কিছু দিন যেতে না যেতেই যেখানে-সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলার কারণে পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতের সৌন্দর্য হারিয়ে গেছে বললেই চলে। সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য যে সুসজ্জিত ফুলের বাগান করা হয়েছিল সেখানে ফুল তো দূরের, গাছের দেখাও নেই। প্রতিদিনই হাজার হাজার দর্শনার্থীর উপচেপড়া ভিড় থাকে সমুদ্র সৈকতে। সেই সাথে আরো ভিড় থাকে বিভিন্ন হকারদের যেমন- চা, বিস্কুট, পানি, বাদাম, সিপস, হাওয়ায় মিঠাই, ঘুরি, আমড়া, ছোলা ও বাচ্চাদের নানান ধরনের খেলনা বিক্রেতাদের। ক্যামেরাম্যান তো আছেই, এছাড়াও ঘোড়া নিয়ে ঘোরাঘুরি করে অশ্বারোহীরা।

ঘুরতে এসে দর্শনার্থীরাও এটা ওটা খাবে না তা কি করে হয়? কিন্তু খাবার শেষ করার পর খাবারের উচ্ছিষ্ট অংশ, বিভন্ন প্যাকেট, কাগজ, খালি পানির বোতল ছাড়াও নানা ধরনের বর্জ্য ফেলে পরিবেশের সৌন্দর্য নষ্ট ও দূষিত করে ফেলছেন। পর্যাপ্ত পরিমাণে ডাস্টবিন থাকা সত্ত্বেও ময়লা আবর্জনা ডাস্টবিনে না ফেলে যেখানে সেখানে ময়লা ফেলার কারণে পরিবেশ নোংরা করে ফেলছেন। শুধু তাই নয় যেখানে সেখানে ঘোড়া, কুকুরের মল-মূত্র ত্যাগ পরিবেশে দুর্গন্ধ ছড়ায় ও পরিবেশ নষ্ট করে ফেলছে। আর হালকা একটু বৃষ্টি হলেই সেসব ময়লা-আবর্জনা, পশুর মল-মূত্র সরাসরি সমুদ্রের পানিতে গিয়ে পড়ে। ফলে সমুদ্রের পানিও দূষিত হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু পরিচ্ছন্নকর্মীদের কোথাও দেখা নেই।

সিলেট থেকে ইসলামী ব্যাংকের কর্মকর্তা মো. নীরব আনোয়ার পরিবার নিয়ে কয়েকদিনের ছুটিতে এসেছেন চট্টগ্রামে। চট্টগ্রাম এসে পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতে আসবেন না তা কি হয়? কিন্তু এসেই তিনি দুঃখ প্রকাশ করেন এই ভেবে যে তিনি কোথায় এলেন!

নীরব আনোয়ার বললেন, ‘এতো সুন্দর একটা জায়গা, ফেসবুকে অনেকের পোস্টে দেখলাম কতো সুন্দর পরিবেশ। চারদিকে ফুল, রংবেরঙের বসার আসন এসব দেখেই নিরিবিলিতে পরিবার নিয়ে একটু সময় কাটাতে এলাম কিন্তু বিচের পরিবেশ খুবই বাজে। যেখানে সেখানে ময়লা আবর্জনাতে ছড়াছড়ি। আর হকারদের জ্বালায় বাঁচা যায় না। শান্তিতে কোথাও বসার পথ ও নেই হকাররা এসে বিরক্ত করতে থাকে। আর এখানে এতো মানুষ গরমে অসহ্য লাগছে সব। সাগরের যে বাতাস, তাও গায়ে লাগছে না। আসলে যতোটা ভালো সময় কাটাবো ভেবে আসলাম ততোটা ভালো সময় কাটাতে পারলাম না। এ জন্য আমরাই দোষী, নিজেরা যেখানে সেখানে ময়লা ফেলি তাতো পরিবেশ নষ্ট করবেই।’

পতেঙ্গা সৈকতের সৌন্দর্য ম্লান নোংরা আবর্জনার স্তূপে 1

বাচ্চার হাত থেকে খালি চিপসের প্যাকেটটা নিয়ে ডাস্টবিনে না ফেলেই নিচে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন মো. জসিমুল্লাহ। ডাস্টবিন থাকা সত্ত্বেও তিনি কেন পরিবেশ নষ্ট করছেন জানতে চাইলে তিনি সহাস্যে বলেন, ‘এখানে এতো মানুষ, তার মধ্যে পরিচিত মানুষদেরই খুঁজে পাওয়ায় দায়, সেখানে ডাস্টবিন কেমনে খুঁজি। কেউ তো ডাস্টবিন ব্যবহার করছে না। যার যেখানে ইচ্ছে ময়লা ফেলে যাচ্ছে। চারপাশ তো এমনেই নষ্ট হয়ে আছে। তবে আমি খুবই দুঃখিত আমাদের আসলে এমন করা উচিত না।’

নোমান নামে একজন বলেন, ‘দেখেন এখানে ডাস্টবিন রাখা আছে তাও কিছু অসুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ আছে যারা যেখানে সেখানে ময়লা এবং চিপসের প্যাকেটসহ বিভিন্ন কাগজপত্র যেখানে সেখানে ফেলছে। শুধু তাই নয় চারপাশে অশ্বারোহীদের ঘোরাঘুরি। যেখানে সেখানে ঘোড়াগুলোর মল-মূত্র ত্যাগ করার কারণে একটু বৃষ্টি হলেই দেখা যায় সব ময়লা আবর্জনা ও মলমূত্র সমুদ্রের পানিতে গিয়ে পড়ে যেটা পানিকেও দূষিত করে ফেলছে।’

অক্সিজেন থেকে ঘুরতে আসা সোমেনা পারভিন জানান, ‘ঘুরতে এসেছি একটু মাইন্ড রিফ্রেশ করার জন্য। কিন্তু আপনি এখানে কোথাও বসে নিরিবিলিতে পাঁচ মিনিট সময়ও কাটাতে পারবেন না। এসেই শুনবেন, আপা বাদাম খাবেন, আপা চা, আপা কফি নেন, চানাবুট খাবেন আপা, এই হাওয়ায় মিঠাই ওহফ আমি না পুরো বিরক্ত হয়ে গেছি। যখন মোবাইলে ছবি তুলতে যাব তখন ক্যামেরাম্যান এসে বলে— ছবি তুলে দিই আপা সত্যি অনেক সুন্দর হবে। এসবের কারণে যে পরিবেশটা উপভোগ করবো তারও উপায় নেই।’

চা বিক্রেতা রাজু মিঞা বলেন, ‘এখানে লোকজন যারা আসেন তাদের কাছে যে চা, কফি বিক্রি করি তা দিয়েই আমাদের পেট চলে। এটা না করলে আমরা চলবো কেমনে তাইতো লোকজনের কাছে গিয়ে চা, কফি কি লাগবে জিজ্ঞেস করি। কিন্তু আমরা জায়গা নোংরা করিনা। লোকজন যারা আসেন তারাই খেয়ে দেয়ে যেখানে সেখানে ময়লা ফেলেন।’

অশ্বারোহী গিয়াস উদ্দিন বলেন, ‘লোকজন সাগর পাড়ে এসে ঘোড়ায় চড়বে না তা কি হয়? আমরা ঘোড়ার পিঠে মানুষ চড়িয়ে কিছু টাকা আয় করি। সেটা না করলে তো ভাতে মরবো।’

পরিবেশ দূষণ নিয়ে তিনি বলেন, ‘ঘোড়ার মল-মূত্র ত্যাগ করলে তা আমরা পরিস্কার করে থাকি।’

পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতার বিষয়ে ৪১ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ছালেহ আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত প্রজেক্টের সৌন্দর্যবর্ধনের দায়িত্ব সিডিএর। সিডিএ পরিস্কার পরিচ্ছন্নতার দায়িত্ব আমাদের কাছে হস্তান্তর না করলেও পরিস্কার পরিচ্ছন্নতার কাজ আমরা করে থাকি। কোথাও ময়লার স্তুপ নেই। তবে পর্যটকরাই এসে বিভিন্ন ময়লা আবর্জনা ফেলে পরিবেশটা নষ্ট করছে। তবে আপনি আমাকে জানিয়েছেন বিষয়টি আমি আমার সুপারভাইজারকে জানাচ্ছি তারা যেনো দ্রুত পদক্ষেপ নেই। আমার এলাকা আমি সবসময় পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে পছন্দ করি।’

সিডিএর উপ-প্রকল্প পরিচালক রাজিব দাস দৈনিক চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত প্রজেক্ট এখনো চলমান একটি প্রজেক্ট আমাদের। কয়েক মাস পূর্বে সৌন্দর্যবর্ধনের যে কাজ আমরা করেছি সেটা দেখছি কিছুদিন যেতে না যেতেই হারিয়ে যাচ্ছে। শুরুতে আমরা পর্যটকদের প্রেরণা যুগিয়েছি যেন তারা ময়লা আবর্জনা ডাস্টবিনে ফেলেন। শুরুতে সেটা মানলেও কিন্তু এখন পর্যটক সংখ্যা ও হকারদের সংখ্যা এতই বেড়েছে যে কাউকে মানানো যাচ্ছে না।’

তিনি আরও বলেন, ‘পরিস্কার পরিচ্ছন্নতার দায়িত্বটা এখনও আমরা দেখছি। আমাদের ঠিকাদারদের দিয়েই এই দ্বায়িত্ব পালন করা হয়। তারা হয়তো সবসময় ময়লা আবর্জনা পরিস্কার না করার কারণে ময়লা আবর্জনায় পরিবেশটা নষ্ট হয়ে আছে। তবে আমরা খুব দ্রুত পরিস্কার পরিচ্ছন্নতার দায়িত্বটা অন্য কাউকে দেওয়ার চিন্তা করছি যারা সার্বক্ষণিক এই দ্বায়িত্বে থাকবেন। আমরা চাইবো পর্যটকদের সুন্দর একটা পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত উপহার দিতে।’

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!